উগ্রপন্থার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ -আউটলুক ইন্ডিয়ার নিবন্ধ
সহিংসতা
প্রায়ই বাংলাদেশে ঘুরে ফিরে আসে। ৭১ এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশটির
জন্ম। রাজপথে দীর্ঘ দিনের আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় বর্বরতা, গণহত্যার পর দেশটি
স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতার আগে প্রত্যক্ষ করেছে ভারত-পাকিস্তান
যুদ্ধ। এরপর পূর্বপাকিস্তানের ধংসাবশেষ থেকে উত্থাণ হয়েছে নতুন এক
রাষ্ট্রের। কিন্তু সহিংসতা সেখানে থেমে থাকে নি। গত সাড়ে চার দশকে
প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর মতো বাংলাদেশ তাদের দুজন প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ড
প্রত্যক্ষ করেছে। এছাড়া একাধিক রাজনৈতিক নেতা আর শ’ শ’ নাগরিকের সহিংস
মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। তবে, দেশটিকে সফররত ও কর্মরত বিদেশীরা
বহুলাংশে নিরাপদ ও অক্ষত থেকেছেন। কিন্তু সেটা এখন পাল্টে যাচ্ছে বলে মনে
হচ্ছে। ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিনের সিনিয়র এডিটর প্রণয় শর্মা এক নিবন্ধে এসব
কথা লিখেছেন। ‘এ রাশ অব ব্লাড, টু ফরেইনার্স আর কিলড; বাংলাদেশ ক্রিপস
টুয়ার্ডস এ র্যাডিক্যাল ব্রিঙ্ক’ শীর্ষক ওই নিবন্ধে তিনি সম্প্রতি দুই
বিদেশী নাগরিক হত্যা ও খিষ্ট্রান যাজকের ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,
এসব হামলা বাংলাদেশী ও বাংলাদেশে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক বিদেশীদের মধ্যে
আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশী দুই নাগরিক হত্যার দায় দ্রুতই স্বীকার করে
আইসিস। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষনকারী মার্কিন ভিত্তিক
সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপও একই কথা বলেছে। কিন্তু অনেকেই আইসিসের
সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দিহান। আর এ সন্দেহপ্রকাশে সবথেকে জোরালো বক্তব্য
বাংলাদেশ সরকারের। তারা দায় চাপিয়েছে বিরোধী বিএনপি ও তদের জোটশরিক জামাতে
ইসলামির ওপর। বিএনপি এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব হামলার জন্য কাকে
দোষারোপ করা যায় বা হামলার সম্ভাব্য হেতু কি তা নিয়ে মানুষ নিশ্চিত না
হলেও, ঢাকার আকাশে বাতাসে ষঢ়যন্ত্রের নানা মতবাদ ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশে
নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক চক্রবর্তী বলেন, ‘শেখ হাসিনা
সরকারের তরফ থেকে অব্যাহত চাপের মুখে থাকা ইসলামপন্থী মৌলবাদিরা হয়তো এসব
হামলার মধ্য দিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে।’ এ কথা বলেই
আবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, ‘তবে এটা অনুমান। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি
না, যেহেতু তদন্ত এখনও চলছে।’ ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের নির্মন হত্যাকা-ের
কয়েকটি ঘটনায় বাংলদেশে উগ্রপন্থী দলগুলোর উত্থানের ইঙ্গিত মেলে। এরপরই দুই
বিদেশী হত্যা ও খ্রিষ্টান এক যাজকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলো। এ পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের উদারমনা ভাবমূর্তি কঠিন পরীক্ষার মুখে। সবথেকে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো,
এসব হত্যাকান্ড প্রত্যন্ত কোন গ্রামে গভীর রাতের ঘটনা নয়। বেশিরভাগ জনবহুল
শহরগুলোতে জনসমক্ষে সংঘটিত হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব হত্যাকান্ডে শুধু
হামলাকারীদের দুসাহসের ওপর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে তা নয়, এমন ঘটনায় হস্তক্ষেপ
আর বন্ধ করতে সংখ্যাগরিষ্ঠের নিরুৎসাহিতা ফুটে উঠেছে। আর রাজনৈতিক পরিসরে
এসব নিয়মিত হামলার ঘটনা এমন সময় ঘটছে যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ
কট্টরপন্থীদের ওপর কঠোর অভিযান শুরু করেছে। জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয়
নির্বাহি কমিটির সদস্য হামিদুর রহমান বলেন, ‘সাম্প্রতিক বিদেশী নাগরিক
হত্যাকান্ডে জামাতে ইসলামির কোন সম্পৃক্ততা নেই। হত্যাকা-গুলোর পরপরই জামাত
সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।’ তিনি বরং
জোর দিয়ে বলেন, ‘বিদেশীদের হত্যাকান্ডে আরও একবার নাগরিকদের জানমাল রক্ষায়
সরকারের ব্যর্থতা উন্মোচিত হয়েছে।’ মজার বিষয় হলো, বহির্বিশ্বের
বিশেষজ্ঞরা এখনই আইসিসের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে
বাংলাদেশ সরকার আর বেশিরভাগ বাংলাদেশী নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এটাকে দেখছেন
প্রকৃত দোষীদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে। কিন্তু
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট বলছেন, ‘তার
সরকার আইসিসের দায় স্বীকারকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে আর আসব দাবি সত্যি কি
না তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে। মঙ্গলবার ঢাকায় বিদেশী, কুটনীতিক,
জাতিসংঘ কর্মকর্তা আর অন্যান্য এজেন্সির প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে সরকারের
সিনিয়র মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং
তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আস্বস্ত করেন। দুই বিদেশী নাগরিক হত্যায়
অবধারিতভাবে বিদেশীদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দর ইতিমধ্যে তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে।
উগ্রপন্থীদের প্রভাব বিস্তার হতে থাকা এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে
বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে অর্থনীতিতে।
সবথেকে বড় উদ্বেগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেশে ২৫০০ কোটি ডলারের অধিক
সমমূল্যের গার্মেন্ট শিল্প যা দেশটির অর্থনীতির শক্তিশালী স্তম্ভ। ইতিমধ্যে
ইঙ্গিত মিলেছে, বছরের এ সময়টাতে যেসব বিদেশী ক্রেতা বাংলাদেশ সফর করে
থাকেন তারা সফর বাতিল করেছেন। একইভাবে সফর বাতিল করেছেন বা অনিদৃষ্টকালের
জন্য পিছিয়ে দিয়েছেন অনেক পর্যটক। ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ এবং তাদের বিরোধী
বিএনপি ও জামাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই যখন ক্ষীপ্রগতিতে চলছে তখন
ভারতের প্রতিবেশী ও বিশ্বের অন্যতম বড় মুসলিম রাষ্ট্রটি যে তীব্র মাত্রায়
মৌলবাদ প্রত্যক্ষ করছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্যই।
No comments