সেই আছিরন এই আছিরন by আরিফুল হক
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জয়রামপুর গ্রামে আছিরন নেছার বাড়িতে পাটপণ্য তৈরি করছেন নারীরা। কর্মীদের কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন আছিরন (ডানে)। ছবি l প্রথম আলো |
১৯৯২
সালে এই বাড়িতে এসেছিলেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। এবার গেলাম আমি।
মোনাজাত উদ্দিন লিখেছেন আছিরনের দৈন্য নিয়ে। আমি লিখব আছিরনের ‘বৈভব’
নিয়ে। মাঝখানের ২৩ বছরের জীবন আছিরনের নিজের হাতে গড়া।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বিখ্যাত পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের আছিরন নেছা (৪২) দুই মেয়েকে নিয়েই পাটজাত পণ্য তৈরি করেন। তিনি গ্রামের মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দেন। পায়রাবন্দসহ সাতটি গ্রামের ৬০০ মহিলাকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন তিনি। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। এখন বাড়িতে দুটি ঘর, চারটি তাঁত আছে তাঁর। আছে পাটপণ্যের একটি শোরুম। পুকুরে মাছ চাষ করছেন। আট শতক জমি কিনে ছোট মেয়েকে বাড়ি করে দিয়েছেন।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বাড়ি এই পায়রাবন্দে। সেই ইউনিয়নের আছিরন তাঁর সাত বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। সেই আলোচনার ঝড়ে বেরিয়ে এসেছিল, আছিরনেরও বিয়ে হয়েছিল মাত্র নয় বছর বয়সে। স্বামী খলিলুর রহমান ছিলেন দিনমজুর। এই দম্পতির দুটি কন্যাসন্তান হয়। নাম রাখা হয় কোহিনুর বেগম ও গোলেনুর বেগম।
সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন এই দম্পতির বড় মেয়ে কোহিনুরের বাল্যবিবাহ নিয়ে প্রতিবেদন করতে পায়রাবন্দে গিয়েছিলেন। আছিরন দম্পতির সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গ তুলে মোনাজাত উদ্দিন ১৯৯২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘কথাবার্তায় বোঝা গেল: এই বাল্যবিবাহের বিষয়টি তাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অল্প বয়সে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়া যে আইনসিদ্ধ নয়, এই খবরটুকুও জানে না তারা, কেউ বলেনি।’ ‘...ইচিরন জানায়, তার দুটি মেয়ে। এরপর ছেলে নেওয়ার আশা ছিল। কিন্তু হলো না। একদিন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এক লোক এসে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলো তাকে, নগদ টাকা আর শাড়ির লোভ দেখিয়ে “অপারেশন” করলো। এখন আর কী করা যাবে! ছেলের আশা বাদ দিতে হয়েছে। জামাই ঘরে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে।’
এই খবর নজরে পড়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের। গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে ঢাকা থেকে মালেকা বেগমসহ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে আসেন। তাঁরা গ্রামের নারী-পুরুষদের নিয়ে বৈঠক করেন। বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনা করেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের আত্মীয় রঞ্জিনা সাবের। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘ওই বৈঠকে লজ্জায় আছিরনের চোখ থেকে পানি ঝরতে দেখেছি। সেটাই হয়তো আছিরনকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।’
সম্প্রতি আছিরনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি দোচালা টিনের ঘর। একটি ঘরে চারটি তাঁত। অন্য একটি ঘরের অংশে দোকান ও প্রশিক্ষণের স্থান। বাড়ির আঙিনাতেও চলছে কাজ। আছিরন জানালেন, ৮ শতাংশ জমির ওপর তাঁর বসতভিটা। উপার্জনের টাকা দিয়ে ২০ শতাংশের একটি পুকুর কিনেছেন। তাতে মাছ চাষ হচ্ছে। ছোট মেয়ে গোলেনুর বেগমকে ৮ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন। দুই মেয়েই আছেন মায়ের পাশে, কাজকর্মে-জীবনযাপনে।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম বললেন, আছিরন-খলিল দম্পতির একটি মাত্র খড়ের ঘর ছিল। তা-ও আবার ভাঙা। ঘরের ভেতর থেকে আকাশ দেখা যেত। বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ত। মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাত। কিন্তু আছিরন দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে বদলে যেতে হয়। কীভাবে গ্রামকে আলোকিত করা যায়। তিনি বলেন, তাঁর নাম আছিরন হলেও সংবাদ-এর প্রতিবেদনে ‘ইচিরন’ ছাপা হয়েছিল। লোকজন তাঁকে আছিরন নামেই ডাকে। তবে ওই প্রতিবেদনে দুই মেয়ে, স্বামী, গ্রামসহ অন্যান্য তথ্য ঠিক ছিল।
তবে আছিরনের এই যাত্রা সহজ ছিল না। স্বামী অসুস্থ। মেয়ের বাল্যবিবাহ নিয়ে হইচইয়ের কারণে সমাজে কোণঠাসা। কিন্তু আছিরনকে কিছু একটা করতেই হবে। চড়া সুদে চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। কিনেছিলেন সেলাই মেশিন। কিন্তু রোজগার শুরুর আগেই স্বপ্ন ভেঙে খানখান। অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাতে দাদনের বাকি টাকা শেষ। সেলাই মেশিনটিও বিক্রি করে দিতে হলো।
কয়েক বছরে ঋণের চার হাজার টাকা সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারে। টাকা পরিশোধে চাপ আসতে থাকে। দাদন ব্যবসায়ীর হাত থেকে বাঁচতে আছিরন ঢাকায় যান চাকরির আশায়। কিন্তু কিছু খুঁজে পেলেন না। এক মাস পর ফিরে আসেন গ্রামে।
শাশুড়ি খোদেজা বেগম নিজের একখণ্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণের সব টাকা পরিশোধ করলেন। একটি সেলাই মেশিনও কিনে দিলেন আছিরনকে। এই সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক কাজ শুরু হয়। দিনে ৪০-৫০ টাকা রোজগার হতে থাকে। একে একে ছয় হাজার টাকা সঞ্চয় করলেন। এ টাকা নিয়ে আবারও নতুন স্বপ্ন বুনতে লাগলেন আছিরন।
আছিরন জানালেন, ওই সময় গ্রামে অনেক পাট। দামও খুব কম। এই পাট দিয়ে পণ্য তৈরির চিন্তা মাথায় এল। প্রশিক্ষণ না থাকলেও বুননের কাজে তাঁর সহজাত দক্ষতা ছিল। পাট দিয়ে তৈরি করতে থাকেন পাপোশ, ছোট ব্যাগ, শিকা, কলমদানি, ছোটদের খেলনা পুতুল, কচ্ছপ, হরিণসহ নানা কিছু। এসব পণ্য নিয়ে যেতেন গ্রামের ছোট ছোট মেলায়। এতে আর্থিক লাভের পাশাপাশি প্রচারও পাওয়া যায়। পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। দুই মেয়েসহ গ্রামের ১০ মহিলাকে কাজ শেখান। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ দেন।
আছিরন বলেন, ‘২০০৭ সালে বগুড়ার নুনগোলার একটা বড় মেলায় অংশ নিই। কিন্তু দোকানের কোনো নাম দিবার পাই নাই। মেলার একজন মোর দোকানের নাম দেলে “অনেক আশা কুটির শিল্প”। সেটে পণ্য বিক্রি খুব ভালো হইল। ১২ হাজার টাকা লাভ হয়।’
ওই মেলা থেকে নতুন উদ্দীপনা পান আছিরন। এর দুই বছরের মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মী বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ জনে। পণ্যের উৎপাদন বাড়তে থাকে। এসব পণ্য নিয়ে পর্যায়ক্রমে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারীসহ আরও কিছু এলাকার মেলায় অংশ নেন। প্রতি মেলা থেকে আয় হতে থাকে ২০-২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য সারা বছর পাটপণ্য তৈরি করেন আছিরন।
আছিরনের স্বামী খলিলুর রহমান বললেন, ‘একসময় না খায়া থাকতে থাকতে পেটোত ব্যথা আছলো। কাজ-কাম কইরবার গেইলে জ্ঞান হারে যাইতো। এলা অনেক গেরস্থের থাকিয়া ভালো আছি। পড়ালেখা না জানলেও বউয়ের সাথোত থাকিয়া কামের যোগারি দেও মুই।’
মানুষজন পরিদর্শনে এসে আছিরনের উৎপাদিত পণ্য যেন খুব সহজে দেখতে পান, সে জন্য একটি ছোট্ট শোরুমও দিয়েছেন আছিরন।
২০০৯ সালে বাড়িতে টিনের দুটি ঘরে তাঁত বসিয়ে গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন আছিরন। পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর, খোর্দ মুরাদপুর, তকেয়া, কেশবপুর, জোত ষষ্ঠি ও ইসলামপুর গ্রাম এবং কুড়িগ্রামের কিছু এলাকায় মহিলারা তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে ১৩টি গ্রুপে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। প্রতি গ্রুপে ২৫ জন করে সদস্য। গত ছয় বছরে আনুমানিক ৬০০ মহিলাকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরাও এখন নিজেদের মতো করে কাজ করছেন।
আছিরনের দুই মেয়েও আছেন মায়ের সঙ্গে। বড় মেয়ে কোহিনুর থাকেন মায়ের বাড়ির সামনে আলাদা বাড়িতে। তাঁকে নিয়ে ’৯২ সালে মোনাজাত উদ্দিন লিখেছিলেন, ‘আমরা যখন বিয়ের প্রসঙ্গে আলাপ করছিলাম, কোহিনুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে। সর্বাঙ্গে ধুলোমাখা, উদোম গা, মেয়েটি মিটমিট করে হাসছিল। মাঝে মাঝে লজ্জা পাবার ভান করছিল সে। আমি যখন ছবি তোলার কথা বললাম, তখন খুব খুশি। ছুটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো, ফ্রক গায়ে চাপা চোখে কাজল টানলো এবং দাঁড়ালো ক্যামেরার সামনে। আমি বললাম, “কোহিনুর, হাসতো একটুখানি”।’
সেই কোহিনুর এখন তিন ছেলের মা। বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে, মেজো ছেলে তৃতীয় আর ছোট ছেলে পড়ে শিশু শ্রেণিতে। স্বামীর একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। আট শতকের বসতভিটা ছাড়া আবাদি জমি আছে ৪০ শতাংশ।
‘দিন ভালোই কাটছে’ বলে কোহিনুর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আগের দিনের কথা কয়া আর কী হইবে। এলা হামরা অনেক ভালো আছি।’
সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন যখন আছিরনের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখন ছোট মেয়ে গোলেনুর বেগমের বয়স ছিল পাঁচ বছর। তাকে আঠারো বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন বলে জানালেন আছিরন। গোলেনুরের দুই ছেলে। তারাও স্কুলে পড়ছে। তাঁর স্বামী হাফিজার রহমানেরও অটোরিকশা আছে। গোলেনুরের বসতভিটা ছাড়াও ৮ শতাংশ আবাদি জমি ও দুটি টিনের ঘর আছে।
আছিরনের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে পুরোনো দিনের কথা ঘুরেফিরে আসছিল। একপর্যায়ে আছিরন বলে উঠলেন, ‘ওই সময় কত কী না হইছে। এইগলা কথা এলা মনে পড়লে গাওখান ছমছম করি ওঠে।’
আছিরনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া মরিয়ম বেগম, মনজিলা বেগম, পারভীন বেগম, নাজনীন আক্তার ও সায়দা বেগমরা যা বললেন তার সারমর্ম দাঁড়ায়, ‘মনোত জোর থাকলে যে অনেক কিছু করা যায়, তা হামার গ্রামের আছিরন বু (আপা) কইরে দেখাইছে।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বিখ্যাত পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের আছিরন নেছা (৪২) দুই মেয়েকে নিয়েই পাটজাত পণ্য তৈরি করেন। তিনি গ্রামের মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দেন। পায়রাবন্দসহ সাতটি গ্রামের ৬০০ মহিলাকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন তিনি। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। এখন বাড়িতে দুটি ঘর, চারটি তাঁত আছে তাঁর। আছে পাটপণ্যের একটি শোরুম। পুকুরে মাছ চাষ করছেন। আট শতক জমি কিনে ছোট মেয়েকে বাড়ি করে দিয়েছেন।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বাড়ি এই পায়রাবন্দে। সেই ইউনিয়নের আছিরন তাঁর সাত বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। সেই আলোচনার ঝড়ে বেরিয়ে এসেছিল, আছিরনেরও বিয়ে হয়েছিল মাত্র নয় বছর বয়সে। স্বামী খলিলুর রহমান ছিলেন দিনমজুর। এই দম্পতির দুটি কন্যাসন্তান হয়। নাম রাখা হয় কোহিনুর বেগম ও গোলেনুর বেগম।
সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন এই দম্পতির বড় মেয়ে কোহিনুরের বাল্যবিবাহ নিয়ে প্রতিবেদন করতে পায়রাবন্দে গিয়েছিলেন। আছিরন দম্পতির সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গ তুলে মোনাজাত উদ্দিন ১৯৯২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘কথাবার্তায় বোঝা গেল: এই বাল্যবিবাহের বিষয়টি তাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অল্প বয়সে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়া যে আইনসিদ্ধ নয়, এই খবরটুকুও জানে না তারা, কেউ বলেনি।’ ‘...ইচিরন জানায়, তার দুটি মেয়ে। এরপর ছেলে নেওয়ার আশা ছিল। কিন্তু হলো না। একদিন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এক লোক এসে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলো তাকে, নগদ টাকা আর শাড়ির লোভ দেখিয়ে “অপারেশন” করলো। এখন আর কী করা যাবে! ছেলের আশা বাদ দিতে হয়েছে। জামাই ঘরে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে।’
এই খবর নজরে পড়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের। গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে ঢাকা থেকে মালেকা বেগমসহ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে আসেন। তাঁরা গ্রামের নারী-পুরুষদের নিয়ে বৈঠক করেন। বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনা করেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের আত্মীয় রঞ্জিনা সাবের। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘ওই বৈঠকে লজ্জায় আছিরনের চোখ থেকে পানি ঝরতে দেখেছি। সেটাই হয়তো আছিরনকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।’
সম্প্রতি আছিরনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি দোচালা টিনের ঘর। একটি ঘরে চারটি তাঁত। অন্য একটি ঘরের অংশে দোকান ও প্রশিক্ষণের স্থান। বাড়ির আঙিনাতেও চলছে কাজ। আছিরন জানালেন, ৮ শতাংশ জমির ওপর তাঁর বসতভিটা। উপার্জনের টাকা দিয়ে ২০ শতাংশের একটি পুকুর কিনেছেন। তাতে মাছ চাষ হচ্ছে। ছোট মেয়ে গোলেনুর বেগমকে ৮ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন। দুই মেয়েই আছেন মায়ের পাশে, কাজকর্মে-জীবনযাপনে।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম বললেন, আছিরন-খলিল দম্পতির একটি মাত্র খড়ের ঘর ছিল। তা-ও আবার ভাঙা। ঘরের ভেতর থেকে আকাশ দেখা যেত। বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ত। মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাত। কিন্তু আছিরন দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে বদলে যেতে হয়। কীভাবে গ্রামকে আলোকিত করা যায়। তিনি বলেন, তাঁর নাম আছিরন হলেও সংবাদ-এর প্রতিবেদনে ‘ইচিরন’ ছাপা হয়েছিল। লোকজন তাঁকে আছিরন নামেই ডাকে। তবে ওই প্রতিবেদনে দুই মেয়ে, স্বামী, গ্রামসহ অন্যান্য তথ্য ঠিক ছিল।
তবে আছিরনের এই যাত্রা সহজ ছিল না। স্বামী অসুস্থ। মেয়ের বাল্যবিবাহ নিয়ে হইচইয়ের কারণে সমাজে কোণঠাসা। কিন্তু আছিরনকে কিছু একটা করতেই হবে। চড়া সুদে চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। কিনেছিলেন সেলাই মেশিন। কিন্তু রোজগার শুরুর আগেই স্বপ্ন ভেঙে খানখান। অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাতে দাদনের বাকি টাকা শেষ। সেলাই মেশিনটিও বিক্রি করে দিতে হলো।
কয়েক বছরে ঋণের চার হাজার টাকা সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারে। টাকা পরিশোধে চাপ আসতে থাকে। দাদন ব্যবসায়ীর হাত থেকে বাঁচতে আছিরন ঢাকায় যান চাকরির আশায়। কিন্তু কিছু খুঁজে পেলেন না। এক মাস পর ফিরে আসেন গ্রামে।
শাশুড়ি খোদেজা বেগম নিজের একখণ্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণের সব টাকা পরিশোধ করলেন। একটি সেলাই মেশিনও কিনে দিলেন আছিরনকে। এই সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক কাজ শুরু হয়। দিনে ৪০-৫০ টাকা রোজগার হতে থাকে। একে একে ছয় হাজার টাকা সঞ্চয় করলেন। এ টাকা নিয়ে আবারও নতুন স্বপ্ন বুনতে লাগলেন আছিরন।
আছিরন জানালেন, ওই সময় গ্রামে অনেক পাট। দামও খুব কম। এই পাট দিয়ে পণ্য তৈরির চিন্তা মাথায় এল। প্রশিক্ষণ না থাকলেও বুননের কাজে তাঁর সহজাত দক্ষতা ছিল। পাট দিয়ে তৈরি করতে থাকেন পাপোশ, ছোট ব্যাগ, শিকা, কলমদানি, ছোটদের খেলনা পুতুল, কচ্ছপ, হরিণসহ নানা কিছু। এসব পণ্য নিয়ে যেতেন গ্রামের ছোট ছোট মেলায়। এতে আর্থিক লাভের পাশাপাশি প্রচারও পাওয়া যায়। পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। দুই মেয়েসহ গ্রামের ১০ মহিলাকে কাজ শেখান। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ দেন।
আছিরন বলেন, ‘২০০৭ সালে বগুড়ার নুনগোলার একটা বড় মেলায় অংশ নিই। কিন্তু দোকানের কোনো নাম দিবার পাই নাই। মেলার একজন মোর দোকানের নাম দেলে “অনেক আশা কুটির শিল্প”। সেটে পণ্য বিক্রি খুব ভালো হইল। ১২ হাজার টাকা লাভ হয়।’
ওই মেলা থেকে নতুন উদ্দীপনা পান আছিরন। এর দুই বছরের মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মী বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ জনে। পণ্যের উৎপাদন বাড়তে থাকে। এসব পণ্য নিয়ে পর্যায়ক্রমে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারীসহ আরও কিছু এলাকার মেলায় অংশ নেন। প্রতি মেলা থেকে আয় হতে থাকে ২০-২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য সারা বছর পাটপণ্য তৈরি করেন আছিরন।
আছিরনের স্বামী খলিলুর রহমান বললেন, ‘একসময় না খায়া থাকতে থাকতে পেটোত ব্যথা আছলো। কাজ-কাম কইরবার গেইলে জ্ঞান হারে যাইতো। এলা অনেক গেরস্থের থাকিয়া ভালো আছি। পড়ালেখা না জানলেও বউয়ের সাথোত থাকিয়া কামের যোগারি দেও মুই।’
মানুষজন পরিদর্শনে এসে আছিরনের উৎপাদিত পণ্য যেন খুব সহজে দেখতে পান, সে জন্য একটি ছোট্ট শোরুমও দিয়েছেন আছিরন।
২০০৯ সালে বাড়িতে টিনের দুটি ঘরে তাঁত বসিয়ে গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন আছিরন। পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর, খোর্দ মুরাদপুর, তকেয়া, কেশবপুর, জোত ষষ্ঠি ও ইসলামপুর গ্রাম এবং কুড়িগ্রামের কিছু এলাকায় মহিলারা তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে ১৩টি গ্রুপে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। প্রতি গ্রুপে ২৫ জন করে সদস্য। গত ছয় বছরে আনুমানিক ৬০০ মহিলাকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরাও এখন নিজেদের মতো করে কাজ করছেন।
আছিরনের দুই মেয়েও আছেন মায়ের সঙ্গে। বড় মেয়ে কোহিনুর থাকেন মায়ের বাড়ির সামনে আলাদা বাড়িতে। তাঁকে নিয়ে ’৯২ সালে মোনাজাত উদ্দিন লিখেছিলেন, ‘আমরা যখন বিয়ের প্রসঙ্গে আলাপ করছিলাম, কোহিনুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে। সর্বাঙ্গে ধুলোমাখা, উদোম গা, মেয়েটি মিটমিট করে হাসছিল। মাঝে মাঝে লজ্জা পাবার ভান করছিল সে। আমি যখন ছবি তোলার কথা বললাম, তখন খুব খুশি। ছুটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো, ফ্রক গায়ে চাপা চোখে কাজল টানলো এবং দাঁড়ালো ক্যামেরার সামনে। আমি বললাম, “কোহিনুর, হাসতো একটুখানি”।’
সেই কোহিনুর এখন তিন ছেলের মা। বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে, মেজো ছেলে তৃতীয় আর ছোট ছেলে পড়ে শিশু শ্রেণিতে। স্বামীর একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। আট শতকের বসতভিটা ছাড়া আবাদি জমি আছে ৪০ শতাংশ।
‘দিন ভালোই কাটছে’ বলে কোহিনুর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আগের দিনের কথা কয়া আর কী হইবে। এলা হামরা অনেক ভালো আছি।’
সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন যখন আছিরনের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখন ছোট মেয়ে গোলেনুর বেগমের বয়স ছিল পাঁচ বছর। তাকে আঠারো বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন বলে জানালেন আছিরন। গোলেনুরের দুই ছেলে। তারাও স্কুলে পড়ছে। তাঁর স্বামী হাফিজার রহমানেরও অটোরিকশা আছে। গোলেনুরের বসতভিটা ছাড়াও ৮ শতাংশ আবাদি জমি ও দুটি টিনের ঘর আছে।
আছিরনের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে পুরোনো দিনের কথা ঘুরেফিরে আসছিল। একপর্যায়ে আছিরন বলে উঠলেন, ‘ওই সময় কত কী না হইছে। এইগলা কথা এলা মনে পড়লে গাওখান ছমছম করি ওঠে।’
আছিরনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া মরিয়ম বেগম, মনজিলা বেগম, পারভীন বেগম, নাজনীন আক্তার ও সায়দা বেগমরা যা বললেন তার সারমর্ম দাঁড়ায়, ‘মনোত জোর থাকলে যে অনেক কিছু করা যায়, তা হামার গ্রামের আছিরন বু (আপা) কইরে দেখাইছে।’
No comments