বাসায় ফিরেছেন খালেদা
তিন
মাস নিজ কার্যালয়ে অবস্থানের পর আজ বাসায় ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়া। দুই মামলায় হাজিরা দিতে সকালে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়
থেকে বের হন তিনি। মামলায় জামিন লাভের পর আদালত থেকে গুলশানের ভাড়া বাসা
ফিরোজায় ফিরেন তিনি। ২০ দল ঘোষিত ৫ই জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের
কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি বিকাল থেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর
তৎপরতা বাড়ানো হয় খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও
সন্ধ্যার পর নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানেও বাড়ানো হয়
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। রাত ১০টার দিকে খালেদা জিয়া খবর পান নয়াপল্টন
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব
রিজভী আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবর পেয়ে তিনি কার্যালয় থেকে কেন্দ্রীয়
কার্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে মোতায়েন করা হয়
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। সেই সঙ্গে তার কার্যালয়ের সামনের
রাস্তায় দুইপাশে দেয়া হয় ব্যারিকেড। একপর্যায়ে দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ১১টি
বালু, ইট ও মাটিভর্তি ট্রাক রেখে অবরুদ্ধ রাখা হয় কার্যালয়। এভাবেই
কার্যালয়ে দীর্ঘ অবস্থানের শুরু হয় খালেদা জিয়া। এরপর একে একে ঘটে গেছে
নানা নাটকীয় ও বিয়োগান্তক ঘটনা। ব্যারিকেডের পর তালা লাগিয়ে দেয়া হয় তার
কার্যালয়ের মূল ফটকে। ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে গাড়িতে ওঠে
বেরুতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে
দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচী ঘোষনা করেন তিনি। এ
সময় তার ওপর পেপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
কিন্তু ১৯শে জানুয়ারি ভোর রাতে বিনা ঘোষণায় খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে
অবরোধ তুলে নেয় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। তবে কার্যালয়ের তিনদিকে কিছু দূরে পুলিশ
মোতায়েন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা অব্যাহত রাখা হয়। সেদিনই দলের
স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি সার্বিক
পরিস্থিতি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। পুলিশের ব্যারিকেড তুলে নেয়া হলেও কৌশলগত
কারণে কার্যালয় ছেড়ে যাননি তিনি। তবে ২২শে জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার
কার্যালয়কে কেন্দ্র করে সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন নানা ব্যানারে বিক্ষোভ
শুরু করে। ওদিকে ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোট
ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ওয়ান ইলেভেনের সময় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর
চিকিৎসার উদ্দেশে থাইল্যান্ড এবং পরে মালয়েশিয়া যান কোকো। ছোট ছেলের
আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ওইদিন রাত ৮টা
৩৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে
যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, অপ্রস্তুতিসহ নানা কারণে
তাকে অভ্যর্থনা জানাননি বিএনপি নেতারা। ওদিকে খালেদা জিয়া যখন ছেলে হারিয়ে
শোকাহত তখনই তাকে হুকুমের আসামি করে দায়ের করা হয় একের পর এক মামলা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় দায়ের করার গাড়ি পোড়ানো
মামলায় হুকুমের আসামি করা হয় খালেদা জিয়াকে। ৩০শে জানুয়ারি খালেদা জিয়ার
কার্যালয়ে যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
মাহমুদুর রহমান মান্না। ৩০শে জানুয়ারি শেষ রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের
বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, কেবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল
নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর
সেখানে অবস্থানকারী দলের নেতা ও কর্মকর্তাদের তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যত
কিছুই হোক কার্যালয় ছাড়বেন না। নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর তার
কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। ৩১শে জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ
অভিযোগ করেন খালেদাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। ২রা ফেব্রুয়ারি অবরোধ ও
হরতালে ৪২ জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোনে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে
খালেদা জিয়া ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদকে আসামি করে
নালিশি মামলা দায়ের করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী। পরদিন ৩রা
ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফায় কড়াকাড়ি আরোপ করা হয় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে।
ওইদিন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ
করার এক পর্যায়ে ওই সংগঠনের মফিজুল নামে এক নেতা পিস্তল হাতে কার্যালয়ের
দিকে ছুটে যান। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিজেদের সংলাপের উদ্যোগ প্রসঙ্গে খালেদা
জিয়াকে একটি চিঠি দেয় নাগরিক সমাজ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকালে খালেদা জিয়ার
সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ
হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর খালেদা জিয়ার
কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য নেয়া খাবার ভ্যানটি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর
থেকে খালেদা জিয়া ছাড়া কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য খাবার সরবরাহ বন্ধ
করে দেয় পুলিশ। কার্যালয়ের গেটে একটি টেবিল ও খাতা-কলম নিয়ে বসে স্পেশাল
ব্রাঞ্চের সদস্যরা। কার্যালয়ের আশপাশের দূতাবাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই
এলাকায় সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। এরপর সরকারপন্থী সংগঠনগুলো প্রতিদিন
গুলশান এলাকায় বিক্ষোভ করতে থাকে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে খালেদা
জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ
ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই সময় কুমিল্লা, খুলনা ও পঞ্চগড়েও
কয়েকটি মামলা হয়। এদিকে সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার
কাছে চিঠি দেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। বিএনপির তরফে সে চিঠির জবাবও
দেয়া হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি
করে আদালত। ১লা মার্চ গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশির অনুমতি দেয় আদালত। এ সময়
তাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে নানা গুঞ্জন ছড়ায় রাজনৈতিক মহলে। তবে খালেদা
জিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে কোন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন
তিনি। গ্রেপ্তারের গুঞ্জনের মধ্যেই ৩রা মার্চ অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার
গ্রেক উইলককের নেতৃত্বে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা
জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ১৬ কূটনীতিক। ১১ই মার্চ আত্মগোপনে থেকে দলের
মুখপাত্রের দায়িত্বপালনকারী যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর
উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। ১৩ই মার্চ সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া
ঘোষণা দেন যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আরাফাত রহমান কোকোর সোনালী
ব্যাংকের একটি ঋণ সংক্রান্ত মামলায় ১৬ই মার্চ খালেদা জিয়া ও কোকোর দুই
মেয়েকে বিবাদী করা হয়। ১৮ই মার্চ নির্বাচন কমিশন ঢাকা ও চট্টগ্রাম তিন সিটি
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে একদিন পর প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন
বিশিষ্ট নাগরিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জানান বিএনপি নির্বাচনে
ইতিবাচক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের
আওতামুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। এদিকে চলমান আন্দোলন কর্মসূচির কারণে নানা
প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় ছেড়ে বের হননি খালেদা জিয়া।
এমনকি ছেলের মৃত্যুর ঘটনায়ও তিনি ঘোষিত কর্মসূচি শিথিল করেননি। কর্মসূচির
কারণে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ও ২৬শে মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা
জানাতে যাননি তিনি। অবশেষে আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে ৯২দিন পর কার্যালয়
থেকে বের হন বিএনপি চেয়ারপারসন।
No comments