দশ ফুট বাই সাত ফুট by আশীষ-উর-রহমান
টিনের
ছাপরা দেওয়া ইটের দেয়ালের দশ ফুট বাই সাত ফুট মাপের ঘর। গায়ে গায়ে লাগোয়া
পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা সারি। দুই সারির মাঝখানে কোনোমতে পায়ে চলার সরু পথ।
তৈরি করা হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের জন্য। মিরপুর
১২ নম্বরের ই-ব্লকে। নাম কুর্মিটোলা রিলিফ ক্যাম্প। তবে রিলিফ দেওয়া বন্ধ
বহুকাল থেকে। কালশী এলাকার এ ক্যাম্পে তিনটি সেকশন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ৩
নম্বর সেকশনের গভীর নলকূপের সামনে পানি সংগ্রহ করতে কলস, জগ, বোতল নিয়ে
ভিড় জমিয়েছিলেন কয়েকজন শিশু ও নারী। তাঁদের কাছে জানা গেল, প্রতিটি সেকশনে
একটি করে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। সেখান থেকেই তাঁরা খাবার ও দৈনন্দিন
প্রয়োজনের পানি সংগ্রহ করেন। মো. আলম এমনি একটি নলকূপের তত্ত্বাবধায়ক।
এটি ২ নম্বর সেকশনে। তিনি জানালেন, ক্যাম্পে পানির সংকট ছিল প্রচণ্ড। তিন
সেকশনে মাত্র তিনটি চাপকল ছিল। পানির জন্য লম্বা লাইন পড়ে যেত কলের সামনে।
গ্রীষ্মকালে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চাপকলে পর্যাপ্ত পানিও পাওয়া যেত
না। একটি বেসরকারি সংস্থা বছর পাঁচেক আগে ক্যাম্পের তিন সেকশনে তিনটি গভীর
নলকূপ বসিয়ে দেওয়ায় আপাতত পানির কষ্ট লাঘব হয়েছে। পানির জন্য প্রতি
পরিবারকে সপ্তাহে ১০ টাকা করে দিতে হয়।
‘কুর্মিটোলা বিহারি’ ক্যাম্প নামে পরিচিত অবাঙালিদের এই আবাসনটি পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। ক্যাম্পের প্রবীণ বাসিন্দা মো. সিরাজ জানান, ১ নম্বর সেকশনে ৬০০, ২ নম্বরে ৬২০ ও ৩ নম্বরে ৬৩০টিসহ মোট ১ হাজার ৮৫০টি পরিবার রয়েছে ক্যাম্পে। তবে লোকসংখ্যা কত, তা বলা তাঁদের পক্ষেও দুষ্কর। প্রতি পরিবারের জন্য দশ ফুট বই সাত ফুটের একটি করে ঘর বরাদ্দ। তাতে বাস করেন ন্যূনতম চার থেকে আট-নয়জন সদস্য। বেনারসি শাড়িতে কারচুপির কাজ করেন মো. সেলিম। ক্যাম্পের ৩ নম্বর সেকশনের ঘরটি তাঁর বাবার নামে বরাদ্দ। তিনি মারা গেছেন। এখন এই ঘরে সেলিম তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে, মা ও দুই বোন নিয়ে বসবাস করেন। এই ঘরেই তাঁদের রান্না, গোসল ও সংসারের অনিবার্য জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
কয়েকটি ঘরে দেখা গেল, কেউ কেউ খাঁচায় ভরে মুরগি বা কোয়েল পাখি পালন করছেন। খাঁচাগুলো রাখা চৌকির তলায়। কোনো কোনো ঘরে তাঁত বসিয়ে জামদানি, বেনারসি বয়ন করা হচ্ছে; কোনো ঘরে চলছে শাড়ি বা থ্রিপিসে জরি, পুঁতি বা কারচুপির কাজ। সেসব কাজে ব্যস্ত নারী ও শিশুরা। এসব ঘরে কোনো জানালা নেই। চুলার ধোঁয়া নির্গমন ও কিঞ্চিৎ আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য ছাউনির সুবিধামতো স্থানে একটি করে টিন বিশেষ কায়দায় খুঁটি দিয়ে খানিকটা উঁচু করে রাখা। বৃষ্টি-বাদলার দিনে মুসিবত হয় ভীষণ। তখন টিন নামিয়ে দিতে হয় বলে ধোঁয়া আর গুমটে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পরিবেশ।
মিরপুর এলাকায় অবাঙালিদের ক্যাম্প ছয়টি। অন্য ক্যাম্পগুলো হলো নতুন ক্যাম্প (কুর্মিটোলা ক্যাম্পের সম্প্রসারিত অংশ), মুরাপাড়া ক্যাম্প, ইরানি ক্যাম্প, মেডিকেল ক্যাম্প ও কালাপানি ক্যাম্প। ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারেরই আবাসিক অবস্থা প্রায় একই রকম। গ্যাসের সংযোগ নেই কোনোটাতেই।
কুর্মিটোলা ক্যাম্প ও নতুন ক্যাম্পের সাহিদা খাতুন, মো. জাহাঙ্গীর, মো. মিন্টু, মো. রনি, রুমাসহ আরও অনেকেই জানালেন, পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আশা তাঁরা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। ক্যাম্পের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ ভোটার হয়েছেন। তবে রাজনীতিতে তাঁরা এখনো সক্রিয় নন। ভোট দেন এ পর্যন্তই। তাঁরা জানান, বাসস্থানের সংকট ছাড়াও ক্যাম্পের অনেক সমস্যা। নর্দমাগুলো পরিষ্কার করা হয় না। ছাউনির টিন পুরোনো হয়ে গেছে। ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে। তবু ছাউনি বদলানো হয় না। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা বেনারসিপল্লি। নারীরা প্রায় সবাই শাড়িতে নকশার কাজ করেন। পুরুষদের একটি অংশ করেন তাঁত বয়নের কাজ। অনেকে রিকশা চালান, আছেন কল-কারখানাতেও।
ভোটার হওয়ার পরও আসন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে তেমন বিশেষ আগ্রহ নেই। কেমন যেন নিরাসক্তভাব সবার মধ্যে। বেশ ঝাঁজালো স্বরেই মো. ফখরে আলম বললেন, ‘আমাদের দিনকাল কীভাবে যাচ্ছে তা বলে কোনো লাভ নেই। ৪২ বছর ধরে আমরা এ অবস্থার মধ্যে আছি। কোনো পরিবর্তন নেই। নেতারা বলেন এক রকম, করেন আরেক রকম।’
সবার মনের কথাটিই আওড়ানোয় ফখরে আলমকে সমর্থন জানালেন আশপাশে উপস্থিত সবাই।
‘কুর্মিটোলা বিহারি’ ক্যাম্প নামে পরিচিত অবাঙালিদের এই আবাসনটি পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। ক্যাম্পের প্রবীণ বাসিন্দা মো. সিরাজ জানান, ১ নম্বর সেকশনে ৬০০, ২ নম্বরে ৬২০ ও ৩ নম্বরে ৬৩০টিসহ মোট ১ হাজার ৮৫০টি পরিবার রয়েছে ক্যাম্পে। তবে লোকসংখ্যা কত, তা বলা তাঁদের পক্ষেও দুষ্কর। প্রতি পরিবারের জন্য দশ ফুট বই সাত ফুটের একটি করে ঘর বরাদ্দ। তাতে বাস করেন ন্যূনতম চার থেকে আট-নয়জন সদস্য। বেনারসি শাড়িতে কারচুপির কাজ করেন মো. সেলিম। ক্যাম্পের ৩ নম্বর সেকশনের ঘরটি তাঁর বাবার নামে বরাদ্দ। তিনি মারা গেছেন। এখন এই ঘরে সেলিম তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে, মা ও দুই বোন নিয়ে বসবাস করেন। এই ঘরেই তাঁদের রান্না, গোসল ও সংসারের অনিবার্য জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
কয়েকটি ঘরে দেখা গেল, কেউ কেউ খাঁচায় ভরে মুরগি বা কোয়েল পাখি পালন করছেন। খাঁচাগুলো রাখা চৌকির তলায়। কোনো কোনো ঘরে তাঁত বসিয়ে জামদানি, বেনারসি বয়ন করা হচ্ছে; কোনো ঘরে চলছে শাড়ি বা থ্রিপিসে জরি, পুঁতি বা কারচুপির কাজ। সেসব কাজে ব্যস্ত নারী ও শিশুরা। এসব ঘরে কোনো জানালা নেই। চুলার ধোঁয়া নির্গমন ও কিঞ্চিৎ আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য ছাউনির সুবিধামতো স্থানে একটি করে টিন বিশেষ কায়দায় খুঁটি দিয়ে খানিকটা উঁচু করে রাখা। বৃষ্টি-বাদলার দিনে মুসিবত হয় ভীষণ। তখন টিন নামিয়ে দিতে হয় বলে ধোঁয়া আর গুমটে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পরিবেশ।
মিরপুর এলাকায় অবাঙালিদের ক্যাম্প ছয়টি। অন্য ক্যাম্পগুলো হলো নতুন ক্যাম্প (কুর্মিটোলা ক্যাম্পের সম্প্রসারিত অংশ), মুরাপাড়া ক্যাম্প, ইরানি ক্যাম্প, মেডিকেল ক্যাম্প ও কালাপানি ক্যাম্প। ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারেরই আবাসিক অবস্থা প্রায় একই রকম। গ্যাসের সংযোগ নেই কোনোটাতেই।
কুর্মিটোলা ক্যাম্প ও নতুন ক্যাম্পের সাহিদা খাতুন, মো. জাহাঙ্গীর, মো. মিন্টু, মো. রনি, রুমাসহ আরও অনেকেই জানালেন, পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আশা তাঁরা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। ক্যাম্পের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ ভোটার হয়েছেন। তবে রাজনীতিতে তাঁরা এখনো সক্রিয় নন। ভোট দেন এ পর্যন্তই। তাঁরা জানান, বাসস্থানের সংকট ছাড়াও ক্যাম্পের অনেক সমস্যা। নর্দমাগুলো পরিষ্কার করা হয় না। ছাউনির টিন পুরোনো হয়ে গেছে। ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে। তবু ছাউনি বদলানো হয় না। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা বেনারসিপল্লি। নারীরা প্রায় সবাই শাড়িতে নকশার কাজ করেন। পুরুষদের একটি অংশ করেন তাঁত বয়নের কাজ। অনেকে রিকশা চালান, আছেন কল-কারখানাতেও।
ভোটার হওয়ার পরও আসন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে তেমন বিশেষ আগ্রহ নেই। কেমন যেন নিরাসক্তভাব সবার মধ্যে। বেশ ঝাঁজালো স্বরেই মো. ফখরে আলম বললেন, ‘আমাদের দিনকাল কীভাবে যাচ্ছে তা বলে কোনো লাভ নেই। ৪২ বছর ধরে আমরা এ অবস্থার মধ্যে আছি। কোনো পরিবর্তন নেই। নেতারা বলেন এক রকম, করেন আরেক রকম।’
সবার মনের কথাটিই আওড়ানোয় ফখরে আলমকে সমর্থন জানালেন আশপাশে উপস্থিত সবাই।
No comments