কি হবে? by ড. মাহফুজ পারভেজ
ফরাসি
সমাজতাত্ত্বিক ল্যুই ডুমোঁ তাঁর ‘হোমো হায়ারারকিকাস’ গ্রন্থে বলেছেন,
‘সমাজ প্রধানত সাম্য ও ব্যক্তির ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত।’ অন্যান্য
দার্শনিকরাও আধুনিক সমাজের মৌলিক আদর্শস্বরূপ সাম্য, স্বাধীনতা আর ব্যক্তির
অধিকারের কথা বলেছেন। বলেছেন, এসব আদর্শ রূপায়িত হয়েছে ব্যক্তিমানুষের
মাধ্যমে। ফলে সমাজে ব্যক্তির বৈধ ও আইনগত অধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। এরই
ভিত্তিতে ব্যক্তিমানুষ নিজ নিজ সমাজে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ
বহুবিধ বৈধ ও আইনগত অধিকার ভোগ করে, যে অধিকারসমূহ কোন দেশের সর্বোচ্চ আইন
তথা সংবিধান এবং আইনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ থাকে। এ কারণেই আইনের
শাসন ব্যক্তির অধিকারকে নিশ্চিত করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেটাকে পুষ্ট
করে। অন্যদিকে স্বৈরশাসন, একদলীয় শাসন, ফ্যাসিস্ট, নাৎসী ইত্যাদি কুশাসন
মানুষের অধিকারকে নস্যাৎ করার মাধ্যমে সাম্য, স্বাধীনতা ও ব্যক্তির
অধিকারহীন সমাজ তৈরি করে এবং সেই সমাজে চরম জুলুম-নির্যাতন চালায়। সেখানে
স্বাধীনতা মানে কেবল শাসকদের স্বাধীনতা আর অধিকার মানে নিজেদের মধ্যে
অধিকারচর্চা; শাসিত তথা জনগণ বা সাধারণ ব্যক্তিমানুষের বেলায়
স্বাধীন-অধিকার থাকে না। বৃটিশের বিরুদ্ধে বা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে
আন্দোলনের কারণও ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বাধীনতার পূর্ণ বিকাশ
ঘটানো, যাতে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি সাধন সম্ভব
হয়। কিন্তু সব সময়ই সদ্য-স্বাধীন দেশগুলোতে সাম্য আর ব্যক্তির অধিকার
পূর্ণতর রূপ লাভ করতে পারে না। গত ৪০/৫০ বছরে যেসব দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে
মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছে, তার মধ্যে কিছু দেশ প্রচণ্ড এগিয়ে গেছে
গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও ব্যক্তি অধিকারের পথে। কিছু দেশ আবর্তিত হচ্ছে কুশাসন ও
অধিকারহীনতায়। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বৈরাচার এবং ক্ষমতার মোহ এমনটি করেছে।
এসব ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে কিছু কিছু দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন আসতে
দেয়া হয় না। এর ফলে ব্যক্তির অধিকারহীনতা তৈরি হয়। এই অধিকারহীন ব্যক্তিদের
দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সমাজ অন্ধকার ও নির্যাতনের আখড়ায় পরিণত হয় এবং
কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সুশাসন সেখানে সম্ভবপর হয় না। কখনো একব্যক্তি
বা একটি দলের কারণে এই অন্ধকার নেমে আসে। পরে দেখা যায়, কেউই সে অন্ধকার
দূর করতে চায় না। মুখে মুখে বললেও মনে মনে নিজের বা দলীয় ক্ষমতা ধরে রাখে।
এই দুষ্টচক্র ব্যক্তি ও সমাজে আবর্তিত হয়ে মানুষের সকল অধিকার নষ্ট করে।
রাজনীতির এই সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ প্রকট। পাকিস্তান কতো আগে স্বাধীন
হলেও সেখানে জনগণের পূর্ণ মুক্তি ও অধিকার আজও আসে নি। বাংলাদেশেও
প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক শাসনের শান্তিপূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। রাজনৈতিক
সংঘাত লেগেই থাকছে। বছরের পর বছর, থেমে থেমে কেন এসব হচ্ছে? গণতন্ত্র বা
আইনের শাসনের ত্রুটির জন্য? নাকি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্রে ভুল পদক্ষেপ ও ব্যর্থতার জন্য? কারণ যাই হোক, সমস্যার কুফল বা
আঘাত প্রধানত ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা জনগণকেই। দেশ আর সমাজও
পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, শান্তি, নিরাপত্তাসহ নানা ক্ষেত্রেও ধস
নেমে আসছে। এসবের প্রতিক্রিয়ায়ও প্রধানত মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণকে
উদ্ধারের জন্য কি করা হচ্ছে? জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সংঘাতরত
পক্ষসমূহের পদক্ষেপগুলোও তো ইতিবাচক কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না। সর্বশেষ
খবর হলো: আন্দোলনকারীরা সাফ বলে দিয়েছে, যৌক্তিক পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত
আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। গত শুক্রবার বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের
মর্মকথা এটাই। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই সরকার পক্ষ বলেছে, আলোচনা বা
সমঝোতার দরকার নেই। এমন কথা উভয়পক্ষই প্রথম থেকে বলে আসছে। অর্থাৎ কারোর
অবস্থানেরই কোন হেরফের হয় নি। মাঝখান দিয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন ও তৎজনিত
সমস্যায় মানুষ মরেছে এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যা প্রবল
থেকে প্রবলতর হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেমে থেমে সংলাপ ও সমঝোতার
তাগিদ দিয়ে চলেছে। মানুষও মনে প্রাণে চাইছেন, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সমঝোতা।
কিন্তু যারা চাইলে কাজ হবে, তাদের সাড়া না-পাওয়া গেলে সঙ্কট মিটবে কি করে?
ফলে বাধ্য হয়েই বিপদগ্রস্ত মানুষ এখন আতঙ্কিত গলায় উদ্বেগের সঙ্গেই বলাবলি
করছেন, ‘কি হবে?’ আসলেই কেউ জানে না, বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান
কিভাবে হবে? কিরূপ হবে? কেমন করে হবে? কখন হবে? ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক
পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ বলতে এখন আপাতত অখণ্ড অনিশ্চয়তাই দেখা যাচ্ছে। সবার
মুখে মুখে আর চিন্তায় প্রবলভাবে একটি জিজ্ঞাসাই থেকে যাচ্ছে: ‘কি হবে?’ >>>১৫ মার্চ ২০১৫, রবিবার
No comments