স্বাধীন খাদ্যাভাসের অধিকার by কান্তি গাঙ্গুলি
ভারতে
বিগত লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট লোকসভার ৫২
শতাংশ আসনে জয় লাভ করেছি, যদিও ভোট পেয়েছিল মাত্র ৩১ শতাংশ। রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মাথারা ভালো করেই জানে ৩১ ভাগ জনসমর্থনের এই মোদি ম্যাজিক
অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচনের ফলাফলে সে লক্ষণও ক্রমশ
ফুটে উঠছে। তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে বিরোধীদের সমর্থনে থাকা ৬৯ শতাংশ
ভোটকে ভাগ করা দরকার। আর বহু ভাষা ও বহু ধর্মের এই দেশকে ভাগ করার
শাসকশ্রেণীর ঐতিহাসিকভাবে চিরন্তন কৌশল হচ্ছে, এই কাজে ধর্ম-সম্প্রদায়গত
ভাবাবেগকে কাজে লাগাও। মানুষ যত ভাগ হবে বিশ্বায়নের আগ্রাসী নীতিতে
কর্পোরেট দুনিয়ার তত সুদিন আসবে এবং নির্বিত্ত গরিব মানুষ ততোধিক অন্ধকারে
নিমজ্জিত হবে। একদিকে জলের দরে সরকারী সম্পত্তি বিক্রি হবে, শ্রম আইন
মালিকদের অনুকূলে পালটানো হবে, বীমা-ব্যাঙ্ক চলে যাবে বিদেশী পুঁজির হাতে,
খেতমজুর কৃষকদের গলায় পা দিয়ে জমি অধিগ্রহণ আইন আসবে; অন্যদিকে মানুষকে
ধর্ম জাতপাতের পরিচয়ে বিভক্ত করতে হবে। কর্পোরেট পুঁজি আর তার তাঁবেদারদের
এটাই হচ্ছে কৌশল। ইতোমধ্যেই ‘ঘরওয়াপসি’, ‘রামজাদা-হারামজাদা’ দিয়ে শুরু
হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর প্রক্রিয়া, সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থানে,
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে নির্বিচারে হামলা। পাশাপাশি সুচতুর কৌশলে বিষিয়ে
দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে মানুষের শান্তি সম্প্রীতির মনোজগৎকে। যে মনে জন্ম নেয়
শ্রেণী চেতনা সেই মনটাকেই ভেঙে দাও, বিষিয়ে দাও—এই হচ্ছে আর এস এস-বি
জেপি’র গোলওয়ালকর কথিত ‘হিন্দু জাতি পুনর্গঠিত’ করার ডকট্রিন। চিন্তার
জগতের এই সাম্প্রদায়িকীকরণে যুক্ত করা হয়েছে বেশকিছু সংঘ ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ও
বুদ্ধিজীবীকে। আর এস এস ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী সুদর্শন রাওকে ভারতীয় ইতিহাস
গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাবা রামদেবসহ ঘনিষ্ঠ
ধর্মব্যবসায়ীদের পরামর্শে জাতীয় শিক্ষা নীতিকে ভারতীয়করণ অথবা গৈরিকীকরণের
প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। আর এই চক্রান্তের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে গোহত্যা ও
গোমাংস নিষিদ্ধকরণ আইন। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে নতুন নির্বাচিত বিজেপি
সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে উপরোক্ত আইন চালু করা। মহারাষ্ট্রের পর এবার
বিজেপি শাসিত অন্য আর এক রাজ্য হরিয়ানাতেও একইভাবে আরও কঠোর গোহত্যা ও
গোমাংস নিষিদ্ধকরণ আইন তৈরির জন্য বিল উত্থাপিত হয়েছে। এই দানবীয় আইনটি
ব্যক্তির রুচি অনুযায়ী খাদ্যাভাসের সাংবিধানিক অধিকারকে সরাসরি লঙ্ঘণ করছে।
এই আইনের ফলে সংবিধানের ১৯নং ধারা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অধিকন্তু গোমাংস
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক মান্যতাপ্রাপ্ত খাদ্য।
মহারাষ্ট্রে এই আইনে বলা হয়েছে, কেউ গরুর মাংস বিক্রয় করলে বা কারোর কাছে
গরুর মাংস পাওয়া গেলে তার পাঁচ বছরের জেল এবং জরিমানা হবে। এমনকি রাজ্যের
বাইরে থেকে কাঁচা অথবা রান্না করা মাংস আনাও বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য।
হরিয়ানায় প্রস্তাবিত বিলে ক্যান বা কৌটায়ভরা গোমাংস নিষিদ্ধ হতে চলেছে।
এক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা। প্রস্তাবিত
আইনটির গালভরা নাম হচ্ছে ‘‘গরু সুরক্ষা, গরু সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন’’।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বুড়ো, অশক্ত গবাদি পশুগুলোকে নিয়ে উন্মুক্ত গোচারণ
ক্ষেত্র তৈরির পরিকল্পনা আমাদের মতো গরিব দেশে কতটা বাস্তব প্রয়োজনের,
যেখানে শিশুমৃত্যু, প্রস্রুতিমৃত্যু, প্রান্তিক মানুষদের যক্ষা, কুষ্ঠ —
এমনকি সাপের কামড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়। একইসঙ্গে
মনে রাখতে হবে, মাংস বিক্রেতারা জীবিকার সঙ্কটে নিমজ্জিত হবেন এবং
ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সেইসব কৃষকরা যারা বুড়ো অশক্ত গবাদি পশুকে বিক্রয় করে
দোন। সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরো এই দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ
জানিয়েছে। কেরালা বিধানসভায় ইতোমধ্যেই এই সর্বনাশা আইনের বিরুদ্ধে সর্বদলীয়
প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই সর্বনাশা আইন আসলে ধর্মীয় মেরুকরণকেই শক্তিশালী
করবে। পূর্বতন বাজপেয়ী সরকারের ছিল মুখ ও মুখোশের কারসাজি, আর বর্তমান মোদি
সরকারের ক্ষেত্রে একইসঙ্গে অনেক রূপ। আমরা বিপদটা কতটা অনুধাবন করতে
পারছি, সেটাই হচ্ছে আসল কথা। নরেন্দ্র মোদির দ্বিচারিতা আজ দিনের আলোর মতো
স্পষ্ট। একদিকে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে ‘বীর’, ‘দেশপ্রেমিক’
বানাবার অপকৌশল, অন্যদিকে গান্ধীজীর চশমার ছবিকে সামনে রেখে স্বচ্ছ ভারত
অভিযান। একদিকে যেমন কর্পোরেট ক্ষেত্রের জন্য পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার শুল্প ও
কর ছাড়ের ব্যবস্থা করা, তেমনি একশোদিনের কাজ সহ বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে
ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে আনা। অতএব মোদিবাবুর সরকার যেমন সাধারণ মানুষের সুদিন
আনতে পারেনি তেমনি এও নিশ্চিত গরুদের সুদিনও আসবে না। আসলে মানুষের
খাদ্যাভাস তার রুচি এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের এই
দেশে খ্রিস্টান, মুসলমান, আদিবাসী, উপজাতি, দলিত, অরণ্যচারী, পাহাড়ী
জনজাতির মানুষদের খাদ্যাভাসের রকমারি বৈচিত্রে আমরা বিস্মিত হই। সাপ,
ব্যাঙ, গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বেজি, কচ্ছপ-হরেক কিসিমের পাখি,
বনবিড়াল, শুকর; এমনকি পতঙ্গ পর্যন্ত বিভিন্ন অংশের মানুষের খাদ্যাভাসের
সঙ্গে জড়িত। আবার দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তর ভারতের যেমন খাদ্যাভাসে
পার্থক্য আছে; তেমনি পূর্ব ভারত, পশ্চিম ভারত, উত্তর-পূর্ব ভারত; আবার এইসব
অঞ্চলের ভিতরও স্থানভেদে খাদ্যাভাসের বিবিধ পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু
শুধুমাত্র গরুর মাংস নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের
এজেন্ডাই সামনে আসে। ‘হিন্দু’ ধর্ম বলে যদিও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ,
মহাকাব্যে কোথাও স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই এবং ‘হিন্দু’ শব্দটা পশ্চিম ও
উত্তর-পশ্চিম ভারতের বহিঃশক্তির মানুষদের দ্বারা ‘সিন্ধু’র অপভ্রংশ হিসাবে
উচ্চারিত একটি শব্দ। তদুপরি এই হিন্দু ধর্মও আবার বিভিন্ন ধরনের
গুণ-কর্ম-স্বভাব-বিভাগে বিন্যস্ত। তবু ঋকবেদে গোমাংস নিষিদ্ধ নয়; বরং তা
একটি বহুল প্রচলিত খাদ্য। আসলে যাযাবর আর্যদের ঋকবেদকালীন সময়ে খাদ্য নিয়ে
কোনো বাছবিছারের অবকাশই ছিল না। (অধ্যাপক ডি এন ঝা) বৈদিক যুগে এবং
তৎপরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে, গোমাংস যথেষ্ঠ পরিমাণে আকাঙ্ক্ষিত খাদ্য বস্তু
হিসাবে মান্যতা পেত। শিক্ষক, ছাত্র, পুরোহিত, রাজা, রাজকর্মচারী,
নববিবাহিত দম্পতি অতিথি হিসাবে বাড়িতে এলে নধর ষাঁড়, গরুর মাংস দিয়ে
আপ্যায়নের রেওয়াজ ছিল এবং এই ‘অতিথি’ শব্দকে বৈদিক ভাষ্যে ‘গোঘ্ন’ বলে
উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ গো-হনন করা হয় যার নিমিত্ত। সিকিম এবং নেপালের
ব্রাহ্মণরা গোমাংস আহার করতেন কেননা প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থায় আমিষ আহারের
তেমন কিছু বিকল্প ছিল না। তাই ঋকবেদের দশম অধ্যায়ের (৮৫, ১৩-১৪) স্বয়ং
দেবরাজ ইন্দ্রের গাভী আহারের ইচ্ছা প্রকাশ পাবার মধ্যে অন্যায় কিছু ছিল না।
তৈত্তরীয় ব্রাহ্মাণে বিষ্ণু, ইন্দ্র, রুদ্র এবং সূর্যকে পৃথক পৃথকভাবে
বিভিন্ন ধরনের ষাঁড় ও গাভী উৎসর্গ করা হয়েছে। সূত্র, কল্পসূত্র,
গার্হস্থসূত্রে গোমাংসকে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে খাদ্য
হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, অশ্বমেধ এবং গোমেধ যজ্ঞ করা হতো
নিশ্চয়ই শুধু বলি এবং নৈবদ্য নিবেদনের জন্য নয়, বরং প্রসাদ পাবার স্বাভাবিক
আকাঙ্ক্ষাও অবশ্যই উল্লেখনীয়। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ তার ‘ধর্ম ও সমাজ’
গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন -‘‘প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণরা
খাদ্য হিসাবে মাংস গ্রহণ করতেন। বৈদিক যুগে ছাগল, ভেড়া, গরু, ষাঁড় ও ঘোড়ার
মাংস খাদ্য হিসাবে প্রচলিত ছিল।’’ এতসব আলোচনা করে গোমাংসের ন্যায্যতার
প্রমাণ বা অপ্রমাণের সে অর্থে কোনো তাৎপর্য আজকের আধুনিক জীবনে নেই। মানুষ
বেদ-উপনিষদ পড়ে জীবন চর্চা করেন তাও না, কিন্তু মানুষের মনে ধর্মবোধের একটা
সুপ্ত আশৈশব ধারণা থাকে। আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই জায়গাটা দখল করে কৌশলে
ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়ায়। তাই ধর্মগ্রন্থকে হাতিয়ার করেই এসব
প্রশ্নগুলিকে আলোচনা করতে হয়। সংঘ পরিবারের কোনো এক উর্বর মস্তিষ্ক খাদ্যকে
সত্ত, রজ ও তম - এই তিন সত্তা বিশিষ্ট হিসাবে বিভক্ত করেছেন এবং গোমাংস
তারে মতে অবশ্যই তামসিক খাদ্য। এবং এই তামসের প্রভাবেই নাকি বর্তমান
জনজীবনের মূল্যবোধ কলুষিত হচ্ছে। যদিও সারা পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত সব থেকে
বেশি সংখ্যক নিরামিষাশি বসবাস করেন ভারতবর্ষেই। এত ব্যাপক সংখ্যায়
নিরামিষাশি থাকার পরেও শুধুমাত্র গতকয়েক বছরে নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং
নৃশংসতায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য বিষয়ক নীতি বলছে,
সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে গোমাংস অবশ্যই একটি বিকল্প হতে পারে। যদিও
যার যেমন রুচি, সংস্কার সেই অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করতে কোনো বাধা থাকা উচিত
নয় এবং এই অধিকার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারও বটে। এক্ষেত্রে খাওয়া এবং না
খাওয়ার অধিকার দুটোই একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য বক্তব্যে বিষয়বস্তুর
সমালোচনা করতে গিয়ে যারা তির্যক মন্তব্য করবেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলা
প্রয়োজন যে -হ্যাঁ, খাওয়ার দুটো অধিকারই আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
একটা আর একটার থেকে ছোট বা বড়ো নয়। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে
তাই আমাদের সকলকেই সাবধান ও সচেতন হতে হবে। হ্যাঁ, সকলকেই! এই লড়াইয়ে নামার
সময় আমাদের নিজেদের সামনেও ধরতে হবে আয়নাটা। এই আয়না হচ্ছে আমাদের জীবন
দর্শন, আমাদের মতাদর্শ। চোখ, কান, মন খোলা রেখে দেখতে হবে হাজার হাজার বছর
ধরে গড়ে ওঠা আমাদের সমাজের মর্মমূলে কিভাবে শান্তি, সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার
ফল্গু নদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সম্প্রতি বেশকিছু সময় ধরে আমরা দেখতে
পাচ্ছি, শারদোৎসবের বিভিন্ন কমিটির কর্মকর্তা হচ্ছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর
মানুষরা। এঁরা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। আন্তরিকভাবেই তারা অংশগ্রহণ করছেন
শারদোৎসবে। একইভাবে হিন্দু সন্তানরাও মুসলমান বন্ধুর বাড়ির উৎসবে-পার্বণে
সাগ্রহে অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম এবং হজরত ইসমাইলের সর্বোত্তম
ত্যাগের আদর্শে প্রাণিত কোরবানির উৎসবে আজ যদি ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ
উৎকণ্ঠিত হন, ব্যথার্ত হন, অভিমানী হন, তাহলে উৎসবের আনন্দে জীবনের সঙ্গে
জীবনের যোগ হবে না। ছাগল একটা বিকল্প অবশ্যই, তবে দামের নিরিখে তা বেশ চড়া।
অধিকন্তু তিন হক আদায়ের পরে গেরস্থের পাতে মাংস থাকবেইবা কতটা! কারণ
অধিকাংশ গরিব মুসলমান পরিবারের পক্ষে দুম্বা খাসি বা উট সংগ্রহ করা সম্ভব
হবে, এমনটা নয়। মানুষের ঐক্য বিঘ্নিত হবে। একবার দেশটা ভেঙেছে, লক্ষ লক্ষ
মানুষের অশ্রু, রক্তপাত, অভিমান, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের রাস্তা মাড়িয়ে
আমরা এসেছি। তাই আমরা অবশ্যই চাইব — ‘‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি দাও আমার
সন্ততি স্বপ্নে থাক’’। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যেন কোনভাবেই
ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প না ঢোকে। এখানে অবশ্যই একটা কথা
উল্লেখ করা দরকার, আর তা হল মুসলমান মাত্রই যেমন গোমাংস আহার করেন না,
তেমনি আমাদের পরিচিত অনেক হিন্দু সন্তানও গোমাংস তৃপ্তি করে খান। অর্থাৎ
শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকেও ব্যক্তিগত খাদ্যাভাসের একটি সর্বজনীন
অধিকার অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য যদি হয় জনসাধারণের মধ্যে
ধর্মীয় মেরুকরণ তাহলে সেই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের আবার নতুন করে
মানবতার অন্বেষণ জরুরী। আমাদের সমাজজীবনের ভিত্তিমূলে যে সম্প্রীতি ও
সহাবস্থানের রঙিন বর্ণমালা খোদাই করা আছে, তার পুনরাবিষ্কারের প্রয়োজন।
মনস্বী অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী সদর মফস্বলের আখ্যানে বিবৃত করেছে সেরকমই
একটি মন ভালো করে দেওয়া শ্যামল কাহিনী। নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে নদীয়া
জেলার অখ্যাত একটি গ্রাম চারাতলা সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। গ্রামে ৮০০ ঘর
মুসলমান এবং মাত্র এক ঘর হিন্দুর বাস। হিন্দু পরিবারটি জাতিতে কর্মকার।
কাস্তে, কাঁচি, বঁটি, দা-কোদাল, গরুর গাড়ির চাকার লোহার বেড় দেওয়া ইত্যাদি
কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মুসলমান প্রধান গ্রামে হিন্দু পরিবারটি
সম্প্রীতি ও সৌভ্রাত্বের আবহেই বসবাস করতো। উল্লেখ্য, এই যে মুসলমানরা
সাধারণত হাপর দিয়ে কামারের কাজ তেমন জানে না। এমতাবস্থায় একদিন কর্মকার
পরিবারের কর্তা কিছুদিন রোগভোগের পর নাবালক সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে প্রয়াত
হন। এইরকম বিপদের দিনে ঐ হিন্দু পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ায়, সাধ্যমতো
গ্রামের সকলেই। মুসলমান ধর্মের এই গ্রামীণ মানুষেরা চাঁদা তুলে কর্মকারের
মৃতদেহ যথাযথ সম্মান-মর্যাদা সহকারে হরিধ্বনি দিয়ে নবদ্বীপ শ্মশানে নিয়ে
গিয়ে দাহ করে। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে নিয়ম মতো শ্রাদ্ধশান্তি সহ
কীর্তনের সমস্ত আয়োজন দাঁড়িয়ে থেকে সংগঠিত করে। লোকায়ত জীবনের মরমী গবেষক
সুধীরবাবু তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হরিধ্বনি দেওয়ার সময় কোনো সংকোচ,
আড়ষ্টতা হয়নি! উত্তরে একজন প্রায় নিরক্ষর বৃদ্ধ মুসলমান এগিয়ে এসে বলেছিল,
‘‘দেখুনবাবু আমরা ধর্মের দিকটা ভাবিনি... আমরা শুধু আমাদের গাঁয়ের ছেলেটার
গঙ্গার কথা ভেবেছি... তাতে আল্লা কোনো গোস্তাকি নেবেন না।’’ আসলে সাধারণ
আমজনতার ধর্মবোধ অত্যন্ত সহজ সরল নির্বিরোধী, যেখানে ধর্মান্ধতার কোনো
স্থান নেই। কিন্তু কি করে একটি অতি সাধারণ গ্রামীণ জীবনে এইরকম উদার
সমন্বয়বাদী ভাবধারা বিকশিত হতে পারে - সুধীরবাবুর দরদী জিজ্ঞাসু মন সে
প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিল। ‘‘আসলে এই গ্রামের প্রায় সবাই সাহেবধনী লোকধর্ম
সম্প্রদায়ের শিষ্য। আঠারো শতকের শেষে চরণ পাল নামে এক নিম্নবর্গের মানুষ
হিন্দু মুসলমানকে একত্র করে এক উদার সমন্বয়বাদী সেকুলার ধর্ম ধারণার পত্তন
করেছিলেন। এদের উপাস্য আল্লাও নয়, হরিও নয়। এদের উপাস্য দীনদয়াল। যারা এই
ধর্মে দীক্ষিত তারা বাহ্যত হিন্দু-মুসলমান ধর্মের আচরণ পালন করেন, কিন্তু
বিশ্বাসে তারা সেকুলারবাদী। ‘দীনদয়ালের ঘরে’ হিন্দু গুরুর যেমন মুসলমান
শিষ্য থাকে, তেমনি মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্যও থাকে।’’ এই লোকধর্মের
মানবিক শিক্ষার কথাই বলে গেছেন কবীর লালনসহ লোকায়ত জীবনের বিশিষ্ট
দার্শনিকরা। আজ শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই আমাদের আত্তীকরণ করতে হবে
নিম্নবর্গের মানুষের এই সমন্বয়বাদী চেতনাকে। নদীয়ার অখ্যাত গ্রাম চারাতলা।
যেখানে কোনো পাঠাগার নেই, সাকুল্যে দুটি সংবাদপত্র আসে। প্রাইমারি স্কুল
একটি, তবে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী নেই। চাষ আবাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই ধুলো
কাদার মানুষগুলো চারাতলা গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব পালন
করেছে অনায়াসে, কোনো ভনিতা ছাড়াই। ধর্ম আর অধর্মের মাঝে আজ আমাদের তাই
সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে, ধর্মসম্প্রদায়গত মেরুকরণের
বিরুদ্ধে আমরা আমাদের চেতনাকে কিভাবে অগ্রবর্তী করতে পারবো। নব্বইয়ের দশকে
রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে যখন গোটা দেশটাই ঝলসে
যাচ্ছিল, তখন সমাজের গভীরে ক্রিয়াশীল ছিল মানবিক সম্পর্কের এইরকম হাজারো
আখ্যান। আসলে মানুষের সমাজে মানুষই হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিষয়; গরু নয়। এবং গরু
জানেও না, গরুকে নিয়ে এবং বিধ তৎপরতা শুরু হয়েছে যাতে করে মানুষের ঐক্য
বিঘ্নিত হয়। তাই গরু এখানে উপলক্ষ্য; অন্য আরো বহুবিধ বিষয়কে সামনে এনে
মানুষকে ভাগ করার ষড়যন্ত্র চলবে। আমরা সচেতন হব, সাবধান হব। কারণ দেশটা
আমাদের, সংবিধানের উৎস হচ্ছে এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। আমাদের
স্বাধীন রুচি এবং খাদ্যাভাসের অধিকার আমরা কেড়ে নিতে দেব না। আজ যদি আমরা
প্রতিবাদে সামিল না হই তাহলে আগামীদিনে বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা,
ধর্মচারণ, মত প্রকাশ ইত্যাদি মৌলিক অধিকারও বিপর্যস্ত হবে। কেননা আমরা
জানি, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় রক্ষা পায় না’। কান্তি গাঙ্গুলি: ভারতীয় গণমাধ্যমকর্মী
No comments