রাজনীতিতে ব্যক্তিকর্তৃত্ব প্রকট
দেশের
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যাপক অভাব
রয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব আরও প্রকট হয়েছে। দেশ ও সরকারের ওপর
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা হয়ে
যায় গৌণ। গতকাল শনিবার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহানের
পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এমন মত
দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক করতে ভাবনার সময়
এসেছে। রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে
বইটির প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা প্রকাশন। বইয়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু দলব্যবস্থা ও
বহুত্ববাদের ধারক হলেও প্রয়োগের দিক থেকে বিশাল ফারাক রয়েছে। এখানে দল
পরিচালিত হয় নেতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নির্বাচনকে প্রায়শই গণতন্ত্রের
লক্ষ্যপূরণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দলীয় উদাসীনতা
দেখা যায়। যে দল হেরে যায় তার ওপর সুনামি শুরু হয়। দেশে সংসদীয় কাঠামো
বজায় থাকলেও এর সুষ্ঠু কার্যকারিতা না থাকায় সরকারের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব ও
বিরোধী দলের বিরোধিতার নেতিবাচক আচরণ অব্যাহত রয়েছে। গণতন্ত্র বা
ডেমোক্রেসি পরিণত হয়েছে ‘পার্টিক্রেসি’তে ।
বইয়ের লেখক রওনক জাহান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভালো সম্পর্ক থাকলে সংঘাতের রাজনীতি থাকত না। ’৯১-এর পর থেকে কে কীভাবে ক্ষমতায় যাবে, দলগুলো এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মধ্যে সংঘাত বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে অন্তর্দলীয় কোন্দল বেড়ে যায়। ক্ষমতায় থাকাকালে নেতা যদি চান, দলকে সংগঠিত ও সংস্কার করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন না। কারণ, তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনে যদি হেরে যান, তখন মাস্তান লাগবে।
বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় দিক হলো, ৩০ বছর ধরে বড় তিনটি দলেরই প্রধান একই ব্যক্তি রয়ে গেছেন। সব কটি দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য রয়েছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। এ ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দের বিষয়টি গৌণ। এ প্রবণতার কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঠামোগত দিক থেকে দাঁড়াতে পারছে না বলে তিনি মনে করেন।
রওনক জাহান বলেন, দেশে ক্ষমতাসীনেরা আইন ভঙ্গ করে সুবিধা নিচ্ছে। বিরোধীদের শাস্তি দিচ্ছে। আইনের শাসন বলে কিছু থাকছে না। আইনে যা থাকুক না কেন, কেউ সেটা মানছে না। এটা যে শুধু কোনো একটি দল করছে তা নয়, যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে, সবাই করেছে। তাই কেবল আইন করে বা সংবিধান পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না। এর জন্য মৌলিক কিছু নীতি থাকা উচিত। সেই মৌলিক নীতির মধ্যে থাকবে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন তাঁরা আইন ভাঙবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র নেই, এটা অস্বীকার না করেই বলছি, তার পরও এই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে কিছু দিতে পারছে। অনেক সমালোচনার মধ্যেও প্রধান দুটি দলের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা দিয়ে তারা বিপুলসংখ্যক ভোটারকে আকর্ষণ করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি কাউন্সিলে উপস্থিত থেকে যেমনটি দেখেছি, সভাপতি ও সাধারণ নির্বাচনের পর বাকি পদগুলো পূরণ করার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে সমর্পণ করা হয়। একজনের এক ভোট—এ ব্যবস্থায় তাঁরা ভোটে যেতে চান না।’
গওহর রিজভী বলেন, নির্বাচন হচ্ছে ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে একটি চুক্তি। ভোটার কি প্রার্থীকে সংসদে না যাওয়ার জন্য ভোট দিয়েছেন? এটা দেখার জন্য ৯০ দিন কেন অপেক্ষা করতে হবে—এ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সফল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমাদের দেশে কি সেই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আছে? আমরা নির্বাচনে হেরে গেলে তা মেনে নিই না। এ সমস্যার সমাধানে কি পদ্ধতি বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? এখন সময় এসেছে সংবিধান নিয়ে নতুন করে ভাবার।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্তৃত্ববাদ এত বেশি আঁকড়ে ধরেছে যে এ থেকে বের হওয়া কঠিন। তাঁর মতে, একটি দায়িত্বশীল নির্বাচন কমিশন একটা রাজনৈতিক দলের চরিত্র ও কর্মকাণ্ড বদলে দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এত অকেজো ও অথর্ব যে এর ওপর আস্থা রাখা যায় না।
ইনাম আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের স্ফুলিঙ্গ হলে জিয়াউর রহমান ছিলেন যোগসূত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য সত্যকে উপলব্ধি করতে চাই না।’ শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করেন, দলকে সংগঠিত করতে বিএনপি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। জবাবে ইনাম আহমেদ বলেন, ‘এটা তো ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ভালো বলতে পারবেন। পুলিশ বিএনপিকে কী কী কর্মসূচি করতে দিয়েছে, তার কাছে হিসাব আছে। আজ পত্রিকায় দেখলাম তিন মাস পর পুলিশ বিএনপি অফিস খুলে দিয়েছে।’
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জি এম কাদের বলেন, পাশ্চাত্যের উদাহরণ হলো নিয়মিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হতে থাকলে নির্বাচনপদ্ধতি ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের একই পদ্ধতি প্রায় ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও রাজপথে আন্দোলন বন্ধ হয়নি; বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘গণতন্ত্রকে টেকসই করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকার করতে হবে যে তারা নিজেদের দলে ও দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা উৎসাহিত করবে’—বইয়ের লেখকের এমন বক্তব্য সমর্থন করে জি এম কাদের বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিভেদ কমিয়ে আনতে একটি সামাজিক সনদ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কী কী ভূমিকা থাকবে, তা ওই সনদে উল্লেখ থাকবে। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে পরিবর্তন না আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও দলগুলো বড়জোর ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট পায়। ৬০ শতাংশ ভোটারকে বাইরে রেখে সংবিধান পরিবর্তন না করে এ ক্ষেত্রে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত।
ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়ে গবেষণা করতে গেলে বাকশাল কেন তৈরি করা হয়েছিল, তার ওপরও আলোচনা হওয়া উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, এক-এগারোর পর দলগুলোতে শীর্ষ নেতৃত্বের কর্তৃত্ব আরও সুসংহত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে আছে অস্বচ্ছ রাজনৈতিক অর্থায়ন। দলগুলোতে অরাজনৈতিক উপাদানের অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বিস্তার ঘটেছে, যা রাজনৈতিক মনোনয়নের সময় দৃশ্যমান হয়েছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়েছে, আরও এগোনোর সম্ভাবনা আছে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি। দেশের প্রধান চারটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সমস্যা-সংকট নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান গবেষণা ও পর্যালোচনা তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন। বক্তারা শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, ড. রওশন জাহান, সাবেক কূটনৈতিক সচিব ফারুক সোবহান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর, অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমদ, লেখক মাহবুব আলম, সৈয়দ বদরুল আহসান, নিলুফার হুদা, মহিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ার উল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক রওনক জাহান ঢাকা, হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নারীবিষয়ক কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
বইয়ের লেখক রওনক জাহান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভালো সম্পর্ক থাকলে সংঘাতের রাজনীতি থাকত না। ’৯১-এর পর থেকে কে কীভাবে ক্ষমতায় যাবে, দলগুলো এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মধ্যে সংঘাত বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে অন্তর্দলীয় কোন্দল বেড়ে যায়। ক্ষমতায় থাকাকালে নেতা যদি চান, দলকে সংগঠিত ও সংস্কার করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন না। কারণ, তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনে যদি হেরে যান, তখন মাস্তান লাগবে।
বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় দিক হলো, ৩০ বছর ধরে বড় তিনটি দলেরই প্রধান একই ব্যক্তি রয়ে গেছেন। সব কটি দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য রয়েছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। এ ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দের বিষয়টি গৌণ। এ প্রবণতার কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঠামোগত দিক থেকে দাঁড়াতে পারছে না বলে তিনি মনে করেন।
রওনক জাহান বলেন, দেশে ক্ষমতাসীনেরা আইন ভঙ্গ করে সুবিধা নিচ্ছে। বিরোধীদের শাস্তি দিচ্ছে। আইনের শাসন বলে কিছু থাকছে না। আইনে যা থাকুক না কেন, কেউ সেটা মানছে না। এটা যে শুধু কোনো একটি দল করছে তা নয়, যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে, সবাই করেছে। তাই কেবল আইন করে বা সংবিধান পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না। এর জন্য মৌলিক কিছু নীতি থাকা উচিত। সেই মৌলিক নীতির মধ্যে থাকবে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন তাঁরা আইন ভাঙবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র নেই, এটা অস্বীকার না করেই বলছি, তার পরও এই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে কিছু দিতে পারছে। অনেক সমালোচনার মধ্যেও প্রধান দুটি দলের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা দিয়ে তারা বিপুলসংখ্যক ভোটারকে আকর্ষণ করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি কাউন্সিলে উপস্থিত থেকে যেমনটি দেখেছি, সভাপতি ও সাধারণ নির্বাচনের পর বাকি পদগুলো পূরণ করার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে সমর্পণ করা হয়। একজনের এক ভোট—এ ব্যবস্থায় তাঁরা ভোটে যেতে চান না।’
গওহর রিজভী বলেন, নির্বাচন হচ্ছে ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে একটি চুক্তি। ভোটার কি প্রার্থীকে সংসদে না যাওয়ার জন্য ভোট দিয়েছেন? এটা দেখার জন্য ৯০ দিন কেন অপেক্ষা করতে হবে—এ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সফল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমাদের দেশে কি সেই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আছে? আমরা নির্বাচনে হেরে গেলে তা মেনে নিই না। এ সমস্যার সমাধানে কি পদ্ধতি বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? এখন সময় এসেছে সংবিধান নিয়ে নতুন করে ভাবার।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্তৃত্ববাদ এত বেশি আঁকড়ে ধরেছে যে এ থেকে বের হওয়া কঠিন। তাঁর মতে, একটি দায়িত্বশীল নির্বাচন কমিশন একটা রাজনৈতিক দলের চরিত্র ও কর্মকাণ্ড বদলে দিতে পারে। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এত অকেজো ও অথর্ব যে এর ওপর আস্থা রাখা যায় না।
ইনাম আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের স্ফুলিঙ্গ হলে জিয়াউর রহমান ছিলেন যোগসূত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য সত্যকে উপলব্ধি করতে চাই না।’ শ্রোতাদের একজন প্রশ্ন করেন, দলকে সংগঠিত করতে বিএনপি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। জবাবে ইনাম আহমেদ বলেন, ‘এটা তো ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ভালো বলতে পারবেন। পুলিশ বিএনপিকে কী কী কর্মসূচি করতে দিয়েছে, তার কাছে হিসাব আছে। আজ পত্রিকায় দেখলাম তিন মাস পর পুলিশ বিএনপি অফিস খুলে দিয়েছে।’
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জি এম কাদের বলেন, পাশ্চাত্যের উদাহরণ হলো নিয়মিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হতে থাকলে নির্বাচনপদ্ধতি ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের একই পদ্ধতি প্রায় ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন প্রমাণ করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও রাজপথে আন্দোলন বন্ধ হয়নি; বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘গণতন্ত্রকে টেকসই করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকার করতে হবে যে তারা নিজেদের দলে ও দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা উৎসাহিত করবে’—বইয়ের লেখকের এমন বক্তব্য সমর্থন করে জি এম কাদের বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিভেদ কমিয়ে আনতে একটি সামাজিক সনদ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কী কী ভূমিকা থাকবে, তা ওই সনদে উল্লেখ থাকবে। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে পরিবর্তন না আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও দলগুলো বড়জোর ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট পায়। ৬০ শতাংশ ভোটারকে বাইরে রেখে সংবিধান পরিবর্তন না করে এ ক্ষেত্রে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত।
ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়ে গবেষণা করতে গেলে বাকশাল কেন তৈরি করা হয়েছিল, তার ওপরও আলোচনা হওয়া উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, এক-এগারোর পর দলগুলোতে শীর্ষ নেতৃত্বের কর্তৃত্ব আরও সুসংহত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে আছে অস্বচ্ছ রাজনৈতিক অর্থায়ন। দলগুলোতে অরাজনৈতিক উপাদানের অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বিস্তার ঘটেছে, যা রাজনৈতিক মনোনয়নের সময় দৃশ্যমান হয়েছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়েছে, আরও এগোনোর সম্ভাবনা আছে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি। দেশের প্রধান চারটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সমস্যা-সংকট নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান গবেষণা ও পর্যালোচনা তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন। বক্তারা শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, ড. রওশন জাহান, সাবেক কূটনৈতিক সচিব ফারুক সোবহান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর, অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমদ, লেখক মাহবুব আলম, সৈয়দ বদরুল আহসান, নিলুফার হুদা, মহিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ার উল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক রওনক জাহান ঢাকা, হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নারীবিষয়ক কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
No comments