শোকস্তব্ধ কেনিয়া- আল-শাবাবের বর্বর হত্যাযজ্ঞ, নিহত ১৪৭
আল-শাবাব
জঙ্গিদের বর্বর হত্যাযজ্ঞে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে পবিত্র
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কেনিয়ার গারিসা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হামলা চালিয়ে
কমপক্ষে ১৪৭ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে হত্যা করেছে তারা। নিরাপত্তা বাহিনীর
অভিযানে প্রায় ১৫ ঘণ্টার জিম্মিদশার অবসান হয়েছে। কিন্তু কেনিয়ার আকাশে
বাতাসে এখন লাশের গন্ধ। স্বজনদের হৃদয়বিদারক হাহাকারে স্তব্ধ পুরো দেশ।
নির্বাক বিশ্ব। বৃহস্পতিবার বন্দুকধারী জঙ্গিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা
চালিয়ে মৃত্যুর হোলিখেলায় মেতেছিল। শ’ শ’ মায়ের বুক খালি করে তারা কেড়ে
নিয়েছে এতগুলো প্রাণ। ১৯৯৮ সালে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার পর এটা
কেনিয়ার মাটিতে সবথেকে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। বৃহস্পতিবার সকালে জঙ্গিরা
অতর্কিত হামলা চালায়। মুসলিম শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিয়ে জিম্মি করে অনেক
খ্রিষ্টানকে। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কলিন্স ওয়েতাগুলা
নামের এক ছাত্র জানিয়েছে, বন্দুকধারীরা হোস্টেলে প্রবেশ করে সবার কাছে
জনাতে চায় ভেতরে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিরা মুসলিম নাকি খ্রিষ্টান। এরপর,
খ্রিষ্টানদের তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। কেনিয়ার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ এনকাইসারি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, তাদের অভিযান
সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। চার জঙ্গি এতে নিহত হয়েছে। কেনিয়ার পুলিশ প্রধান
জোসেফ বইনেট বলেন, হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি
করা শুরু করে। পরে পুলিশ ও সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে।
তাদের সঙ্গে বন্দুকধারীদের ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এ অবস্থা চলে সারা দিন।
কমপক্ষে আহত ৭৯ জনকে হেলিকপ্টারে করে নাইরোবিতে নিয়ে যাওয়া হয়। উত্তরপূর্ব
কেনিয়ার গারিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ন্যক্কারজনক হামলার দায় শিকার করেছে জঙ্গি
গোষ্ঠী আল-শাবাদ। এ দলটির সঙ্গে আল কায়েদার যোগসূত্র রয়েছে। আর তাদের নিজ
দেশ সোমালিয়াতে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কেনিয়া সরকারের সেনা পাঠানোর
জবাবে একাধিকবার তারা কেনিয়ার মাটিতে হামলা চালিয়েছে। গারিসা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বর এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ আল-শাবাবের সঙ্গে
লড়াই করতে কেনিয়া সরকারকে সবধরনের সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
মোহাম্মদ মোহামুদ নামের এক ব্যক্তির এ হামলার পেছনে হাত রয়েছে বলা হচ্ছে।
কেনিয়া সরকার তার গ্রেপ্তারে সহায়ক যে কোন তথ্যের জন্য ২ লাখ ১৫ হাজার ডলার
পুরস্কার ঘোষণা করেছে। পুলিশ প্রধান বইনেট জানিয়েছেন, কেনিয়া সরকার
সোমালিয়া সীমান্তবর্তী চারটি অঞ্চলে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ জারি
করেছে। হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে আসা শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে কিভাবে হত্যা করার
আগে সবাইকে বিদ্রূপ করেছে হামলাকারীরা। অনেককে বাধ্য করা হয়েছে তাদের
পিতা-মাতাকে ফোন করে বলতে যে কেনিয়ার সেনারা যেন সোমালিয়া ছেড়ে যায়। একের
পর এক রুমে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা চালায় তারা। অনেকে তাদের মৃত বন্ধু
সহপাঠীদের রক্ত শরীরে মেখে মরার ভান করে পড়ে ছিল বাঁচার চেষ্টায়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, চার বন্দুকধারী তাদের শরীরে স্থাপিত
আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর দিনব্যাপী জিম্মিদশার সমাপ্তি হয়। মৃতের
সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জিম্মিদশার অবসানের পর এক
হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আগে থেকেই
ভীতসন্ত্রস্ত শোকস্তব্ধ স্বজন ও পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হওয়া শিক্ষার্থীরা ভিড়
জমিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে। শোকে বিমূর্ত স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস
ভারী হয়ে ওঠে। অশ্রুসিক্ত বয়স্ক এক ব্যক্তি হাবেল মুতিন্দা বলেন, আটকে পড়া
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আমার ছেলে রয়েছে। গতকাল থেকে তার কোন খবর পাইনি।
মৃতদের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। সন্তানকে মৃত ধরে নিয়েই
বিপর্যস্ত হাবেল বললেন, গরমে মৃতদেহের অবস্থা আরও খারাপ হবার আগেই আমাকে তা
খুঁজে বের করতে হবে। এ কথা বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জরুরি
সহায়তা কর্মীরা মৃতদেহগুলো একত্র করতে কাজ শুরু করে। আর কেনিয়ার সেনারা
পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে টহল দেয়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শপথ
করে বলেছেন, কেনিয়া সন্ত্রাসী হুমকিতে মাথা নত করবে না। সাংবাদিকদের তিনি
বলেন, কেনিয়া সরকার সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভীত হবে না যারা সরকারকে অপদস্থ
করার একটি উপায় হিসেবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা বেছে নিয়েছে। তার সরকার
পাল্টা লড়াই করবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। গতকাল কেনিয়ার দৈনিকগুলোকে
হামলার আগে গোয়েন্দা হুঁশিয়ারিগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়নি বলে
সমালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে বর্বর এ হত্যাযজ্ঞের পর জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়
দেশের প্রতিষ্ঠিত দৈনিকগুলো।
No comments