রোজার কাজা-কাফ্ফারা ও ফিদ্ইয়া by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
রমজান মাসে যাঁরা পীড়িত, অতিবৃদ্ধ, যাঁদের অত্যধিক দৈহিক দুর্বলতার কারণে সিয়াম পালন করা খুব কষ্টদায়ক হয়ে যায়, যাঁরা সফরে থাকার কারণে মাহে রমজানে সিয়াম পালন করতে পারেন না, তাঁদের জন্য রোজার কাজা, কাফ্ফারা, ফিদ্ইয়া ইত্যাদি বদলা ব্যবস্থা স্থির করে ইসলামি শরিয়তে সুনির্দিষ্ট বিধিব্যবস্থা রয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এ (সিয়াম) যাদের অতিশয় কষ্ট দেয়, তাদের কর্তব্য হচ্ছে এর পরিবর্তে ফিদ্ইয়া বা একজন মিসকিনকে অন্নদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সত্ কাজ করে, তবে সেটা তার পক্ষে অধিকতর কল্যাণকর। তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। আর কেউ পীড়িত থাকলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যেটা সহজ সেটাই চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪-১৮৫)
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যায়, তবে পরে কাজা করে নিতে হয়, তা হচ্ছে; ১. মুসাফির অবস্থায়, ২. রোগবৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে, ৩. গর্ভের সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, ৪. এমন তৃষ্ণা বা ক্ষুধা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে, ৫. শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে, ৬. কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে, ৭. মেয়েদের হায়েজ-নেফাসের সময় রোজা ভঙ্গ করা যায়। আর যেসব কারণ রোজার কাজা ও কাফ্ফারা দুটোই ওয়াজিব হয় তা হলো—জেনেশুনে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করলে রোজা ভেঙে যাবে। এমতাবস্থায় কাজা ও কাফ্ফারা দুটোই ওয়াজিব হয়।
মনে রাখা দরকার, শরিয়তে কঠোর নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাঁর ওপর অবশ্যই কাজা-কাফ্ফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যে কটি রোজা ভঙ্গ হবে, সে কটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি। অর্থাত্ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফ্ফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে—১. একেকটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফ্ফারা ধারাহিকভাবে ৬০টি রোজাই রাখতে হবে, মাঝে কোনো একটি রোজা ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ২. যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয়, তাহলে সে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খানা দেবে। অপরদিকে কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খানা খাওয়াতে হবে। ৩. গোলাম বা দাসিকে আজাদ বা স্বাধীন করে দিতে হবে।
মাহে রমজানে নেক আমলের ফজিলত যেমন বেশি, তেমনি এ মাসে গুনাহ করলে এর শাস্তিও বেশি। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত রোজা না রাখলে যে কঠিন শাস্তির হুকুম এসেছে, সেই ব্যক্তি ইহকালে তা না পেলেও পরকালে তার শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে যে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়ত অনুমোদিত ওজর ছাড়া মাহে রমজানের একটি রোজাও ছেড়ে দেয়, সে নয় লাখ বছর জাহান্নামের দাউদাউ করে প্রজ্বলিত আগুনে জ্বলতে থাকবে।’
বিনা কারণে যে ব্যক্তি মাহে রমজানের মাত্র একটি রোজা না রাখে এবং পরে যদি ওই রোজার পরিবর্তে সারা বছরও রোজা রাখে, তবু সে ততটুকু সওয়াব পাবে না, যতটুকু মাহে রমজানে ওই একটি রোজার কারণে পেত। এ সম্পর্কে ফিকহিবদদের মতে, দুই মাস একাধারে রোজা রাখলে স্বেচ্ছায় ভাঙা একটি রোজার কাফ্ফারা আদায় হয়, আর এই কাফ্ফারার বিনিময়ে একটি রোজার ফরজের দায়িত্বটাই কেবল আদায় হয়। আর যারা নানা অজুহাতে ও স্বেচ্ছায় পুরো মাহে রমজানের রোজা রাখে না, তাদের শাস্তি কত যে ভয়াবহ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এ বিষয়ে প্রত্যেক মুসলমানের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের এক দিনে রোজা কোনো (শরিয়ত অনুমোদিত) ওজর বা অসুস্থতা ব্যতীত ভঙ্গ করবে, সারা জীবনের রোজায়ও এর ক্ষতি পূরণ হবে না, যদি সে সারা জীবনও রোজা রাখে।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদ)
ইসলামের অনুসারী দাবি করেও যেসব ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা রাখে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কঠোরতর বিধান এসেছে। ইসলামি আইনশাস্ত্র ‘হিদায়া’য় বিভিন্ন ফিকহ্ গ্রন্থের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ আছে যে, ‘যারা মাহে রমজানে কোনো রকম শরিয়ত অনুমোদনসাপেক্ষ ওজর (অর্থাত্ শরিয়ত যাদের সাময়িকভাবে রোজা না রাখার অনুমতি দেয়) ছাড়া প্রকাশ্যভাবে পানাহার করে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিত। অনুরূপভাবে, যারা তাদের এ কাজে সহায়তা করে, তাদেরও একই দণ্ড প্রয়োগ করতে হবে।’
রোজার ফিদ্ইয়া: রোজা রাখা দুঃসাধ্য হলে একটা রোজার পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে অন্নদান করা অবশ্যকর্তব্য। শরিয়ত মোতাবেক রোজা রাখায় সামর্থ্যহীন হলে প্রতিটি রোজার জন্য একটি করে ‘সাদাকাতুল ফিতর’-এর সমপরিমাণ গম বা এর মূল্য গরিবদের দান করাই হলো রোজার ‘ফিদ্ইয়া’ তথা বিনিময় বা মুক্তিপণ। অতিশয় বৃদ্ধ বা গুরুতর রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাঁর সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথবা রোজা রাখলে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে, তিনি রোজার বদলে ফিদ্ইয়া আদায় করবেন। পরবর্তী সময়ে ওই ব্যক্তি যদি সুস্থ হয়ে রোজা রাখার মতো শক্তি ও সাহস পান, তাহলে তাঁকে আগের রোজার কাজা আদায় করতে হবে। তখন আগে আদায়কৃত ফিদ্ইয়া গণ্য হবে সাদকা হিসেবে।
অসুস্থ ব্যক্তি ফিদ্ইয়া বা মুক্তিপণ আদায় না করে মারা গেলে তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ফিদ্ইয়া আদায় করা কর্তব্য; যদি মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে যান। অন্যথায় আদায় করা মুস্তাহাব। উল্লেখ্য, প্রত্যেক রোজার ফিদ্ইয়া হলো একটি সাদাকাতুল ফিতর, অর্থাত্ এক কেজি ৬৫০ গ্রাম আটা বা এর সমমূল্য দরিদ্র, এতিম বা মিসকিনকে দান করা, অথবা একজন ফকির বা গরিবকে দুই বেলা পেটপুরে খাওয়ানো। অনেক জায়গায় দেখা যায়, গরিব লোক কোনো ধনীর বদলি রোজা পালন করে দিচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই একজনের রোজা অন্যজন বদলি হিসেবে পালন করতে পারবে না। কেউ কারও রোজা বদলি হিসেবে রাখলে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা শুদ্ধ হবে না। রোজার ফিদ্ইয়া গুনাহ্মাফির মাধ্যমে মানুষকে নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল করে। রোজাকে আল্লাহ তাআলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বান্দার জন্য নির্ধারণ করেছেন। রোজার কাজা, কাফ্ফারা ও ফিদ্ইয়ার মাধ্যমে আল্লাহ পাক বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রমজানের মাসে রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি)
একজন মুমিন রোজাদার যদি পরচর্চা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অসাধুতা, দুর্নীতিপরায়ণতা, আত্মকলহ, বিবাদ-বিসংবাদ ইত্যাদি শরিয়তগর্হিত ও অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিহার করে আত্মসংযমী হয় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, সহিহ শুদ্ধভাবে রোজা পালন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া-ইস্তেগফার—এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর একজন খাঁটি আবেদ বা প্রিয় মকবুল বান্দা হিসেবে গণ্য হবেন। অতএব আমরা যেন সঠিকভাবে রোজার হক আদায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের পরিপূর্ণ সংশোধন এবং কলুষতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিষ্কৃতি লাভের নিমিত্তে তওবা-ইস্তেগফার করে অশেষ রহমত, বরকত, নিয়ামত, ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে খাঁটি বান্দা হতে পারি, আল্লাহ পাক আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান,। সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যায়, তবে পরে কাজা করে নিতে হয়, তা হচ্ছে; ১. মুসাফির অবস্থায়, ২. রোগবৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে, ৩. গর্ভের সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, ৪. এমন তৃষ্ণা বা ক্ষুধা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে, ৫. শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে, ৬. কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে, ৭. মেয়েদের হায়েজ-নেফাসের সময় রোজা ভঙ্গ করা যায়। আর যেসব কারণ রোজার কাজা ও কাফ্ফারা দুটোই ওয়াজিব হয় তা হলো—জেনেশুনে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করলে রোজা ভেঙে যাবে। এমতাবস্থায় কাজা ও কাফ্ফারা দুটোই ওয়াজিব হয়।
মনে রাখা দরকার, শরিয়তে কঠোর নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাঁর ওপর অবশ্যই কাজা-কাফ্ফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যে কটি রোজা ভঙ্গ হবে, সে কটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি। অর্থাত্ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফ্ফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে—১. একেকটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফ্ফারা ধারাহিকভাবে ৬০টি রোজাই রাখতে হবে, মাঝে কোনো একটি রোজা ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ২. যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয়, তাহলে সে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খানা দেবে। অপরদিকে কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খানা খাওয়াতে হবে। ৩. গোলাম বা দাসিকে আজাদ বা স্বাধীন করে দিতে হবে।
মাহে রমজানে নেক আমলের ফজিলত যেমন বেশি, তেমনি এ মাসে গুনাহ করলে এর শাস্তিও বেশি। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত রোজা না রাখলে যে কঠিন শাস্তির হুকুম এসেছে, সেই ব্যক্তি ইহকালে তা না পেলেও পরকালে তার শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে যে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়ত অনুমোদিত ওজর ছাড়া মাহে রমজানের একটি রোজাও ছেড়ে দেয়, সে নয় লাখ বছর জাহান্নামের দাউদাউ করে প্রজ্বলিত আগুনে জ্বলতে থাকবে।’
বিনা কারণে যে ব্যক্তি মাহে রমজানের মাত্র একটি রোজা না রাখে এবং পরে যদি ওই রোজার পরিবর্তে সারা বছরও রোজা রাখে, তবু সে ততটুকু সওয়াব পাবে না, যতটুকু মাহে রমজানে ওই একটি রোজার কারণে পেত। এ সম্পর্কে ফিকহিবদদের মতে, দুই মাস একাধারে রোজা রাখলে স্বেচ্ছায় ভাঙা একটি রোজার কাফ্ফারা আদায় হয়, আর এই কাফ্ফারার বিনিময়ে একটি রোজার ফরজের দায়িত্বটাই কেবল আদায় হয়। আর যারা নানা অজুহাতে ও স্বেচ্ছায় পুরো মাহে রমজানের রোজা রাখে না, তাদের শাস্তি কত যে ভয়াবহ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এ বিষয়ে প্রত্যেক মুসলমানের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের এক দিনে রোজা কোনো (শরিয়ত অনুমোদিত) ওজর বা অসুস্থতা ব্যতীত ভঙ্গ করবে, সারা জীবনের রোজায়ও এর ক্ষতি পূরণ হবে না, যদি সে সারা জীবনও রোজা রাখে।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদ)
ইসলামের অনুসারী দাবি করেও যেসব ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা রাখে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কঠোরতর বিধান এসেছে। ইসলামি আইনশাস্ত্র ‘হিদায়া’য় বিভিন্ন ফিকহ্ গ্রন্থের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ আছে যে, ‘যারা মাহে রমজানে কোনো রকম শরিয়ত অনুমোদনসাপেক্ষ ওজর (অর্থাত্ শরিয়ত যাদের সাময়িকভাবে রোজা না রাখার অনুমতি দেয়) ছাড়া প্রকাশ্যভাবে পানাহার করে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিত। অনুরূপভাবে, যারা তাদের এ কাজে সহায়তা করে, তাদেরও একই দণ্ড প্রয়োগ করতে হবে।’
রোজার ফিদ্ইয়া: রোজা রাখা দুঃসাধ্য হলে একটা রোজার পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে অন্নদান করা অবশ্যকর্তব্য। শরিয়ত মোতাবেক রোজা রাখায় সামর্থ্যহীন হলে প্রতিটি রোজার জন্য একটি করে ‘সাদাকাতুল ফিতর’-এর সমপরিমাণ গম বা এর মূল্য গরিবদের দান করাই হলো রোজার ‘ফিদ্ইয়া’ তথা বিনিময় বা মুক্তিপণ। অতিশয় বৃদ্ধ বা গুরুতর রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাঁর সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথবা রোজা রাখলে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে, তিনি রোজার বদলে ফিদ্ইয়া আদায় করবেন। পরবর্তী সময়ে ওই ব্যক্তি যদি সুস্থ হয়ে রোজা রাখার মতো শক্তি ও সাহস পান, তাহলে তাঁকে আগের রোজার কাজা আদায় করতে হবে। তখন আগে আদায়কৃত ফিদ্ইয়া গণ্য হবে সাদকা হিসেবে।
অসুস্থ ব্যক্তি ফিদ্ইয়া বা মুক্তিপণ আদায় না করে মারা গেলে তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ফিদ্ইয়া আদায় করা কর্তব্য; যদি মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে যান। অন্যথায় আদায় করা মুস্তাহাব। উল্লেখ্য, প্রত্যেক রোজার ফিদ্ইয়া হলো একটি সাদাকাতুল ফিতর, অর্থাত্ এক কেজি ৬৫০ গ্রাম আটা বা এর সমমূল্য দরিদ্র, এতিম বা মিসকিনকে দান করা, অথবা একজন ফকির বা গরিবকে দুই বেলা পেটপুরে খাওয়ানো। অনেক জায়গায় দেখা যায়, গরিব লোক কোনো ধনীর বদলি রোজা পালন করে দিচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই একজনের রোজা অন্যজন বদলি হিসেবে পালন করতে পারবে না। কেউ কারও রোজা বদলি হিসেবে রাখলে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা শুদ্ধ হবে না। রোজার ফিদ্ইয়া গুনাহ্মাফির মাধ্যমে মানুষকে নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল করে। রোজাকে আল্লাহ তাআলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বান্দার জন্য নির্ধারণ করেছেন। রোজার কাজা, কাফ্ফারা ও ফিদ্ইয়ার মাধ্যমে আল্লাহ পাক বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রমজানের মাসে রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি)
একজন মুমিন রোজাদার যদি পরচর্চা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অসাধুতা, দুর্নীতিপরায়ণতা, আত্মকলহ, বিবাদ-বিসংবাদ ইত্যাদি শরিয়তগর্হিত ও অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিহার করে আত্মসংযমী হয় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, সহিহ শুদ্ধভাবে রোজা পালন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া-ইস্তেগফার—এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর একজন খাঁটি আবেদ বা প্রিয় মকবুল বান্দা হিসেবে গণ্য হবেন। অতএব আমরা যেন সঠিকভাবে রোজার হক আদায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের পরিপূর্ণ সংশোধন এবং কলুষতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিষ্কৃতি লাভের নিমিত্তে তওবা-ইস্তেগফার করে অশেষ রহমত, বরকত, নিয়ামত, ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে খাঁটি বান্দা হতে পারি, আল্লাহ পাক আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান,। সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
No comments