ক্ষমতাসীন দলের অক্ষমতা by আব্দুল কাইয়ুম
ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাদের টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির প্রতিটি ঘটনা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তারা বোধ হয় ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নিতে চায় না। সবাই জানে, ক্ষমতাসীনেরা লুটপাট করলে কী করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে লুটপাটে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এ রকম কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন সময় বলেছেন। মানুষের সেই আস্থার প্রতি মর্যাদা না দিলে অবস্থা যে কী হবে তা বোঝার ক্ষমতা অন্তত এসব ছাত্রনেতার থাকা উচিত।
মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে ৩১ আগস্ট ছাত্রলীগ আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজির ব্যাপারে তাঁর মনোবেদনার কথা বলে তাদের আদর্শ মেনে রাজনীতি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথায় কান দেওয়ার মতো সময়, ধৈর্য ও মনোবৃত্তি হয়তো তাদের নেই। না হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী ভালো ভালো কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু শুনবে কে?
কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের নির্ভয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরে কোনো সমস্যা হলে দায়িত্ব তিনি নিজে নেবেন, সচিবেরা থাকবেন দায়মুক্ত। এখন সময় এসেছে বলার যে, কোথাও ছিনতাই, চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজিতে সরকারদলীয় লোকজন জড়িত থাকলে থানা-পুলিশ যেন নির্ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়; এ জন্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে হয়রানির শিকার হতে হবে না। সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ভয় পায়। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কিছু করতে গেলে তাঁদের কোনো দুর্গম অঞ্চলে বদলি করে দেওয়া হয়। স্থানীয় সাংসদ বা দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করেন। তাই গা বাঁচিয়ে চলতেই তাঁরা অভ্যস্ত।
এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুলিশকে নির্ভয়ে কাজের পরিবেশ দিতে হবে। শুধু কথায় নয়, বাস্তবেও দেখাতে হবে। পত্রপত্রিকায় তো প্রায় প্রতিদিনই দলীয় লোকজনের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির খবর নামধামসহ বেরোচ্ছে। সুতরাং পুলিশের কাজের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে পত্রিকা। তার ভিত্তিতে তদন্ত করে যদি সুস্পষ্ট অভিযোগে কোনো দলীয় নেতা-কর্মীর ব্যাপারে পুলিশ উপযুক্ত ধারায় মামলা করে, তাহলে অন্তত টেন্ডারবাজির জন্য তাকে কারাগারে ঢোকানো সম্ভব। একবার কারারুদ্ধ হলে মামলার জটিল প্রক্রিয়ায় জামিন পেতে মাস ছয়েক লাগবে। এ রকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে দলীয় লোকজনের উপদ্রব অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দিতে প্রধানমন্ত্রী কতটা প্রস্তুত। দল এমন একটা যন্ত্র যা ক্ষমতায় গেলে দানবীয় রূপ ধারণ করে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সে দশাই হয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল বঙ্গবন্ধুকে কঠোর হওয়ার জন্য বলতে থাকল। তিনি কঠোর হলেন। ১৯৭৪ সালে সরকার চোরাচালান ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার দৃঢ় পদক্ষেপ নিল। সেনা নিয়োগ করা হলো। দেখা গেল, বেশ কিছু স্থানে দলীয় লোকজন টপাটপ ধরা পড়ছে। তখন দল থেকে অভিযোগ আসতে থাকল যে আওয়ামী লীগকে হেয় করার জন্য মিথ্যা অভিযোগে দলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও হয়রানি করা হচ্ছে। বাধার মুখে একসময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অকার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু সে সময় দৃঢ়তার সঙ্গে নীতিগত অবস্থান ধরে রাখা হলে সেটা এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হতে পারত। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী কোনো দল যে নিজেদের লোকজনের অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অভিযান চালাতে পারে, সে রকম অদ্বিতীয় উদাহরণ স্থাপন করা সম্ভব হতো। আর সে পথে রচিত হতে পারত অন্য রকম ইতিহাস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমি যখন পত্রিকায় পড়ি ছাত্রলীগের ছেলেরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে, তখন আমার কষ্ট লাগে।’ (প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) কিন্তু এরপর তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আর নিচ্ছেন না। বরং ছাত্রলীগের ছেলেরা পত্রিকায় যেন খবর না বেরোয় সে ব্যবস্থা করতে তত্পর হয়ে উঠেছে। চুয়াডাঙ্গা, যশোর, গলাচিপাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের নানা অপকীর্তির খবর পত্রিকায় প্রকাশের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে, পরিবার-পরিজনকে হয়রানি করছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নীরব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও চুপ। দল ও সরকারের ওপর মহলের নির্লিপ্ত মনোভাবের কারণে সাংবাদিকদের এভাবে হয়রানি করা সম্ভব হচ্ছে।
অবশ্য সরকারি দলের নেতারা সম্প্রতি দু-একটি ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাজধানীর কল্যাণপুর খালের ওপর ছাত্রলীগ তাদের ওয়ার্ড কার্যালয় বানালে খবরটি পত্রিকায় আসে। এরপর সম্প্রতি স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতারা সেটি ভেঙে ফেলে। খালটি আপাতত দখলমুক্ত হয়। পটুয়াখালীতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানির বিষয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এসব ঘটনা কালো মেঘের রুপালি পাড়ের মতো ক্ষণস্থায়ী কি না তা দেখার বিষয়।
বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি দল ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র সাড়ে আট মাসের মাথায় যে এমন বিতর্কিত অবস্থানে চলে যেতে পারে, এটা সত্যিই দুঃখজনক। সব সময় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের চারপাশে একশ্রেণীর চাটুকার ভিড় জমায়। তারা নেতৃত্বকে নানা কথা বলে ভুল বোঝায় এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে দুর্ভেদ্য বলয় সৃষ্টি করে মূল নেতৃত্বকে পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই চাটুকারদের নানা দুরভিসন্ধি থাকে। মুখে সাধু, কাজে চক্রান্তকারী। এটা আগেও দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময় যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর চারপাশ ঘিরে ছিলেন, যাঁদের কথায় প্রধানমন্ত্রী বেশি গুরুত্ব দিতেন, তাঁদের বেশির ভাগই আজ আর প্রধানমন্ত্রীর পাশে নেই। দেখা গেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাঁদের বেশির ভাগ সেই যে দেশ ছেড়েছেন, সাত বছরে তাঁদের মুখ আর দেখা যায়নি। সে সময় আওয়ামী লীগের ভরাডুবির জন্য তাঁদের দুর্নীতি ও লুটপাটের নানা অভিযোগ অনেকাংশে দায়ী ছিল। অনেক দেরিতে প্রধানমন্ত্রী সেটা বুঝেছেন। আজ তাঁদের অনেকে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে।
প্রধানমন্ত্রী কি অতীতের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করছেন? তাঁর চারপাশে কারা ভিড় জমাচ্ছে, সে সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়। একবার কপট সমর্থকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লে অনেক ক্ষমতাধর নেতাও নিজের অজান্তেই ক্ষমতাবঞ্চিত হয়ে পড়েন। এভাবেই ক্ষমতাসীনরা অক্ষমতার চোরাবালিতে আটকে যান। আওয়ামী লীগ আজ যেন সে পথেই চলছে। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা বিএনপিকেও একই দশায় পড়তে দেখেছি। বিএনপির সরকারের আমলে ২০০৫-০৬ সালে দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ঘরোয়া আলোচনায় হাওয়া ভবনের নেতিবাচক ভূমিকার সমালোচনা করতে শুনেছি। কিন্তু তাঁরা কখনো সেসব কথা তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে পারতেন না। তাঁরা শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কাছে অনুযোগ করার সুযোগই পেতেন না। তাঁদের উচ্চমহলে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না, সেখানেও সেই চাটুকারদের প্রভাববলয়। এর পরিণাম যে শুভ হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিগত বিএনপির সরকারের শেষ দিকে দুর্নীতি ও লুটপাটে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একজন নেতা আমাকে বলেন, মানুষ এত উত্তেজিত যে সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন হাওয়া ভবনের প্রতিটি ইট খুলে নেবে। তাঁর কথায় মনে পড়ল ১৯৮৭ সালের কথা। তখন এরশাদ ক্ষমতায়। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে। ২২ জুলাই থেকে শুরু হয় বিরোধী জোট ও দলের ৫৪ ঘণ্টার হরতাল। তখন ৭২ ঘণ্টার হরতালও হতো। সে রকম এক উত্তাল হরতালের দিনে বিক্ষুব্ধ জনতা জাতীয় পার্টি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর অফিস মতিঝিলের আল্লাহওয়ালা ভবনে অভিযান চালায়। তারা চারতলা ভবনের সব আসবাবপত্র রাস্তায় ফেলে আগুন দেয়। পরে ভবনটি জ্বালিয়ে দেয়। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অফিসের ভেতরে যে কয়জন কর্মী ছিল, তারা প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে বাঁচে। হাওয়া ভবনেরও সেই দশা হবে, এটাই ছিল ওই আওয়ামী লীগ নেতার ধারণা। এরপর সে বছর অক্টোবরে হাওয়া ভবন আক্রান্ত না হলেও যা হয়েছে তা কোনো অংশে কম নয়। বিএনপিরই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে বিএনপিকে তছনছ করে দেয়। আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও চলে নানা অভিযান।
সাম্প্রতিক অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের সব সময় স্মরণ করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের অক্ষমতা যেন সেই কঠিন দিনগুলোয় ফিরে যেতে বাধ্য না করে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে ৩১ আগস্ট ছাত্রলীগ আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজির ব্যাপারে তাঁর মনোবেদনার কথা বলে তাদের আদর্শ মেনে রাজনীতি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথায় কান দেওয়ার মতো সময়, ধৈর্য ও মনোবৃত্তি হয়তো তাদের নেই। না হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী ভালো ভালো কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু শুনবে কে?
কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের নির্ভয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরে কোনো সমস্যা হলে দায়িত্ব তিনি নিজে নেবেন, সচিবেরা থাকবেন দায়মুক্ত। এখন সময় এসেছে বলার যে, কোথাও ছিনতাই, চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজিতে সরকারদলীয় লোকজন জড়িত থাকলে থানা-পুলিশ যেন নির্ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়; এ জন্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে হয়রানির শিকার হতে হবে না। সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ভয় পায়। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কিছু করতে গেলে তাঁদের কোনো দুর্গম অঞ্চলে বদলি করে দেওয়া হয়। স্থানীয় সাংসদ বা দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করেন। তাই গা বাঁচিয়ে চলতেই তাঁরা অভ্যস্ত।
এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুলিশকে নির্ভয়ে কাজের পরিবেশ দিতে হবে। শুধু কথায় নয়, বাস্তবেও দেখাতে হবে। পত্রপত্রিকায় তো প্রায় প্রতিদিনই দলীয় লোকজনের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির খবর নামধামসহ বেরোচ্ছে। সুতরাং পুলিশের কাজের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে পত্রিকা। তার ভিত্তিতে তদন্ত করে যদি সুস্পষ্ট অভিযোগে কোনো দলীয় নেতা-কর্মীর ব্যাপারে পুলিশ উপযুক্ত ধারায় মামলা করে, তাহলে অন্তত টেন্ডারবাজির জন্য তাকে কারাগারে ঢোকানো সম্ভব। একবার কারারুদ্ধ হলে মামলার জটিল প্রক্রিয়ায় জামিন পেতে মাস ছয়েক লাগবে। এ রকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে দলীয় লোকজনের উপদ্রব অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দিতে প্রধানমন্ত্রী কতটা প্রস্তুত। দল এমন একটা যন্ত্র যা ক্ষমতায় গেলে দানবীয় রূপ ধারণ করে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সে দশাই হয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল বঙ্গবন্ধুকে কঠোর হওয়ার জন্য বলতে থাকল। তিনি কঠোর হলেন। ১৯৭৪ সালে সরকার চোরাচালান ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার দৃঢ় পদক্ষেপ নিল। সেনা নিয়োগ করা হলো। দেখা গেল, বেশ কিছু স্থানে দলীয় লোকজন টপাটপ ধরা পড়ছে। তখন দল থেকে অভিযোগ আসতে থাকল যে আওয়ামী লীগকে হেয় করার জন্য মিথ্যা অভিযোগে দলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও হয়রানি করা হচ্ছে। বাধার মুখে একসময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অকার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু সে সময় দৃঢ়তার সঙ্গে নীতিগত অবস্থান ধরে রাখা হলে সেটা এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হতে পারত। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী কোনো দল যে নিজেদের লোকজনের অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অভিযান চালাতে পারে, সে রকম অদ্বিতীয় উদাহরণ স্থাপন করা সম্ভব হতো। আর সে পথে রচিত হতে পারত অন্য রকম ইতিহাস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমি যখন পত্রিকায় পড়ি ছাত্রলীগের ছেলেরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে, তখন আমার কষ্ট লাগে।’ (প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) কিন্তু এরপর তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আর নিচ্ছেন না। বরং ছাত্রলীগের ছেলেরা পত্রিকায় যেন খবর না বেরোয় সে ব্যবস্থা করতে তত্পর হয়ে উঠেছে। চুয়াডাঙ্গা, যশোর, গলাচিপাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের নানা অপকীর্তির খবর পত্রিকায় প্রকাশের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে, পরিবার-পরিজনকে হয়রানি করছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নীরব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও চুপ। দল ও সরকারের ওপর মহলের নির্লিপ্ত মনোভাবের কারণে সাংবাদিকদের এভাবে হয়রানি করা সম্ভব হচ্ছে।
অবশ্য সরকারি দলের নেতারা সম্প্রতি দু-একটি ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাজধানীর কল্যাণপুর খালের ওপর ছাত্রলীগ তাদের ওয়ার্ড কার্যালয় বানালে খবরটি পত্রিকায় আসে। এরপর সম্প্রতি স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতারা সেটি ভেঙে ফেলে। খালটি আপাতত দখলমুক্ত হয়। পটুয়াখালীতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানির বিষয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এসব ঘটনা কালো মেঘের রুপালি পাড়ের মতো ক্ষণস্থায়ী কি না তা দেখার বিষয়।
বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি দল ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র সাড়ে আট মাসের মাথায় যে এমন বিতর্কিত অবস্থানে চলে যেতে পারে, এটা সত্যিই দুঃখজনক। সব সময় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের চারপাশে একশ্রেণীর চাটুকার ভিড় জমায়। তারা নেতৃত্বকে নানা কথা বলে ভুল বোঝায় এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে দুর্ভেদ্য বলয় সৃষ্টি করে মূল নেতৃত্বকে পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই চাটুকারদের নানা দুরভিসন্ধি থাকে। মুখে সাধু, কাজে চক্রান্তকারী। এটা আগেও দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময় যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর চারপাশ ঘিরে ছিলেন, যাঁদের কথায় প্রধানমন্ত্রী বেশি গুরুত্ব দিতেন, তাঁদের বেশির ভাগই আজ আর প্রধানমন্ত্রীর পাশে নেই। দেখা গেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাঁদের বেশির ভাগ সেই যে দেশ ছেড়েছেন, সাত বছরে তাঁদের মুখ আর দেখা যায়নি। সে সময় আওয়ামী লীগের ভরাডুবির জন্য তাঁদের দুর্নীতি ও লুটপাটের নানা অভিযোগ অনেকাংশে দায়ী ছিল। অনেক দেরিতে প্রধানমন্ত্রী সেটা বুঝেছেন। আজ তাঁদের অনেকে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে।
প্রধানমন্ত্রী কি অতীতের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করছেন? তাঁর চারপাশে কারা ভিড় জমাচ্ছে, সে সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়। একবার কপট সমর্থকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লে অনেক ক্ষমতাধর নেতাও নিজের অজান্তেই ক্ষমতাবঞ্চিত হয়ে পড়েন। এভাবেই ক্ষমতাসীনরা অক্ষমতার চোরাবালিতে আটকে যান। আওয়ামী লীগ আজ যেন সে পথেই চলছে। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা বিএনপিকেও একই দশায় পড়তে দেখেছি। বিএনপির সরকারের আমলে ২০০৫-০৬ সালে দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে ঘরোয়া আলোচনায় হাওয়া ভবনের নেতিবাচক ভূমিকার সমালোচনা করতে শুনেছি। কিন্তু তাঁরা কখনো সেসব কথা তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে পারতেন না। তাঁরা শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কাছে অনুযোগ করার সুযোগই পেতেন না। তাঁদের উচ্চমহলে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না, সেখানেও সেই চাটুকারদের প্রভাববলয়। এর পরিণাম যে শুভ হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিগত বিএনপির সরকারের শেষ দিকে দুর্নীতি ও লুটপাটে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একজন নেতা আমাকে বলেন, মানুষ এত উত্তেজিত যে সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন হাওয়া ভবনের প্রতিটি ইট খুলে নেবে। তাঁর কথায় মনে পড়ল ১৯৮৭ সালের কথা। তখন এরশাদ ক্ষমতায়। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে। ২২ জুলাই থেকে শুরু হয় বিরোধী জোট ও দলের ৫৪ ঘণ্টার হরতাল। তখন ৭২ ঘণ্টার হরতালও হতো। সে রকম এক উত্তাল হরতালের দিনে বিক্ষুব্ধ জনতা জাতীয় পার্টি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর অফিস মতিঝিলের আল্লাহওয়ালা ভবনে অভিযান চালায়। তারা চারতলা ভবনের সব আসবাবপত্র রাস্তায় ফেলে আগুন দেয়। পরে ভবনটি জ্বালিয়ে দেয়। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অফিসের ভেতরে যে কয়জন কর্মী ছিল, তারা প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে বাঁচে। হাওয়া ভবনেরও সেই দশা হবে, এটাই ছিল ওই আওয়ামী লীগ নেতার ধারণা। এরপর সে বছর অক্টোবরে হাওয়া ভবন আক্রান্ত না হলেও যা হয়েছে তা কোনো অংশে কম নয়। বিএনপিরই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে বিএনপিকে তছনছ করে দেয়। আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও চলে নানা অভিযান।
সাম্প্রতিক অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের সব সময় স্মরণ করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের অক্ষমতা যেন সেই কঠিন দিনগুলোয় ফিরে যেতে বাধ্য না করে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments