মাননীয় ছিনতাইকারীগণ সমীপে আকুল আবেদন -গদ্যকার্টুন by আনিসুল হক
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও অভিনন্দন গ্রহণ করুন। খবরের কাগজে পড়িলাম, না পড়িলেও জানিতাম, আপনারা কুশলে আছেন। শুধু কুশলে আছেন তাহা বলিলে কম বলা হয়, আপনাদের এখন পোয়াবারো চলিতেছে। ঢাকা শহরে আপনাদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়াছে, কাগজে লিখিয়াছে। খবরের কাগজওয়ালাদের কী ধৃষ্টতা। তাহারা দৌরাত্ম্য শব্দটি ব্যবহার করিল! দৌরাত্ম্য বাড়ে তাহাদের যাহারা দুরাত্মা। আপনারা তো মহাত্মা। আপনাদের বাড়িবে মাহাত্ম্য। খবরের কাগজওয়ালারা ভুল লিখিয়াছে। তাহাদের লেখা উচিত ছিল, ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টির মাহাত্ম্য বাড়িয়াছে।
কেন আপনারা মহাত্মা। কারণ আপনারা বাঁচিয়া রাখিয়াছেন, তাই আমরা এখনো কেহ কেহ বাঁচিয়া আছি। বাঁচিয়া তো নাও রাখিতে পারিতেন! আপনাদের উদ্যত ছুরিকা (ভোঁতা, মরিচাপূর্ণ) আমাদের যেকোনো কাহারও পাঁজর, বক্ষ, উদর এফোঁড় ওফোঁড় করিয়া দিতে পারে যেকোনো সময়, যখন তখন। আপনাদের দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র নির্গত অগ্নিতপ্ত বুলেট যেকোনো করোটি চূর্ণ করিতে পারে, যেকোনো বক্ষ বিদীর্ণ করিতে পারে যত্রতত্র, দিবারাত্র চব্বিশ ঘণ্টার যেকোনো সময়। আপনাদের বিষাক্ত মলম যেকোনো ব্যক্তির চক্ষু অন্ধ করিয়া দিতে পারে চিরকালের জন্যে। আপনাদের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেকোনো কাউকে চেতনাহীন করিয়া পাঠাইয়া দিতে পারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে। ১৮ দিনে মাত্র ৩৭ জনকে আপনারা হাসপাতালে পাঠাইয়াছেন, পাতালে কতজনকে পাঠাইয়াছেন কে জানে, কিন্তু পুরো এক কোটি মানুষের শহরে মাত্র ৩৭ জনকে হাসপাতালে প্রেরণ যে আপনাদের দায়িত্বশীলতা ও মহানুভবতার প্রমাণ, তাহা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।
এই শহরটা তো পুরাপুরি আপনাদেরই পদতলগত। এমনও হইয়াছে, একই রাস্তায় দাঁড়াইয়া আপনারা সিরিজ ছিনতাই করিয়াছেন, একটার পর একটা, এক হালি, এক ডজন, এক কুড়ি, যতটা ইচ্ছা। এমনও হইয়াছে, একই ব্যক্তি রাস্তার এক মোড়ে তাহার সর্বস্ব হারাইয়া পরের মোড়ে গিয়া পৌঁছিবা মাত্র আপনাদেরই আরেক দলের হাতে পড়িয়াছে, তাহার পরনের কাপড় ছাড়া দিবার মতো কিছু নাই, আপনারা তাহাও কাড়িয়া লইয়াছেন, তিনি অতঃপর আরও একদল ছিনতাইকারীর কবলে পড়িয়াছেন। দিবার মতো যাহার কিছু নাই, তাহাকে সামনে পাইয়াও যে আপনারা তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন, সে আপনাদের মহানুভবতা ছাড়া আর কী! আপনারা চলন্ত বাস হইতে ধাক্কা মারিয়া ছিনতাইয়ের শিকারকে প্রাণে মারিয়াছেন, তেমন ঘটনা তো আরও পাঁচ হাজার ঘটিতে পারিত, তাহা তো ঘটে নাই। বাসও আপনাদের, দিনের বেলায় পুরা বাস দখল করিয়া আপনারা ছিনতাই করিতে পারেন। ট্যাক্সিও আপনাদের, ট্যাক্সিওয়ালা যাত্রী লইয়া আপনাদের আস্তানায় আসিয়াই দাঁড়ায়, আপনারা আয়েশের সঙ্গে তাহাতে উঠিয়া যাত্রীকে ঠাসিয়া ধরেন। আপনারা চলন্ত বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি, গাড়ি, রিকশা, স্কুটারের যাত্রীর কানের দুল, গলার চেইন, হাতের ব্যাগ ছোঁ মারিয়া টানিয়া লন, যাত্রীর কান ছিঁড়িয়া যায়, কিন্তু কী মহত্ আপনারা যে মাথাটা আপনারা ছিঁড়িয়া লন না। ধাবন্ত মোটরসাইকেলযোগে আপনারা পথচারী বা রিকশাযাত্রীর ব্যাগ এক থাবায় উড়াইয়া লইয়া যান, যাত্রী যান হইতে পড়িয়া যায়, কি যায় না, তাহা আপনাদের দেখিবার অবকাশ নাই, তবে সকল যাত্রী যে মারাত্মক আহত বা একেবারে নিহত হয় না, তাহা আপনাদের পেশাদারি দক্ষতারই সামান্য প্রকাশ মাত্র। সবচেয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ আপনারা দিয়া থাকেন ব্যাংক হইতে টাকা তুলিয়া যাহারা বাহির হয়, তাহাদের ওপর পরিচালিত অভিযানের ব্যাপারে। গুলি ছুড়িতে হয়। আপনারা দুই-চারিজনকেই মারেন। কিন্তু ব্যাপক গোলাবর্ষণ কিংবা বোমাবাজিতে গণহত্যা করিয়াছেন, এমন কখনো শোনা যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা, আপনারা ধরা পড়েন না। ধরা পড়িলেও আপনাদের কী শাস্তি হয়, জনগণ জানিতে পারে না। শুধু অবিবেচক জনতা মাঝেমধ্যে আপনাদিগকে গণপিটুনি দিয়া থাকে। স্বীকার করি, গণপিটুনি জিনিসটা মোটেও মুখরোচক নয়, ইহাতে আপনাদের কোনো কোনো ইয়ারদোস্ত কোনো কুক্ষণে প্রাণও হারাইয়া থাকিতে পারে। এই উচ্ছৃঙ্খল জনতার এইরূপ বেয়াদবিতে আমরা যাহার পর নাই কুণ্ঠিত ও শরমিন্দা। আপনারা এই অবিমৃষ্যকারীদের গোস্তাকিটুকুন হিসাবে লইবেন না, এই আমাদের আশা।
আপনারাই আমাদের শহরের একমাত্র কায়েমি শক্তি। আপনারাই আছেন, আর কেহ নাই। পুলিশ আছে, তা তো থাকিবেই। ফুল থাকিলে পাতা থাকিবেই। আপনারা হইলেন এই ঢাকা নামক কাননের ফুল আর পুলিশ পাতা মাত্র। পাতা যেমন জানে ফুল আছে, ফুলও তেমনি জানে পাতা আছে। দুইটা মিলিয়াই বাগানের শোভা।
আপনাদের নিকট আমাদের করজোড়ে নিবেদন, প্রতিটা পেশারই একটা পেশাগত নীতিরীতি আছে। সকলেই ইহা মানিয়া চলে। আপনাদেরও একটা ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধি আপনারা স্থির করুন। আপনারা ইহা মানিয়া চলুন। আমরাও, দেশের নাগরিকেরা ইহাতে সহযোগিতা করিব।
আপনারা যখন ছিনতাই করিবেন, তখন কেবল ছিনতাইটুকুই করিবেন, দয়া করিয়া খুনজখম করিবেন না। আপনাদের ছুরি, তরবারি, চাপাতিগুলি দয়া করিয়া ধার দিয়া আনিবেন। ইহাতে যেন মরিচা না থাকে। আর নিতান্ত পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়া না গেলে দয়া করিয়া অস্ত্র পরিচালনা করিবেন না। যে পথচারী বা যাত্রী স্বেচ্ছায় সর্বস্ব আপনাদের হাতে তুলিয়া দিবে, তাহাকে আপনারা দয়া করিয়া আঘাত করিবেন না। যাহা চান, তাহা পাইবার পরেও কেন আপনারা আঘাত করেন? ইহা পেশাগত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যখন আপনারা কাহাকেও টার্গেট করেন, তাহার ওপর চড়াও হন, তখন এই দেশের নাগরিক হিসাবে সেই ব্যক্তি ও আপনারা একটা নির্মল স্পষ্ট চুক্তির অধীনে আসেন। তাহা হইল, সে তাহার সঙ্গে যাহা কিছু আছে, তাহা আপনাদের হাতে তুলিয়া দিবে, কোনো রকমের আপত্তি করিবে না, পলায়নের চেষ্টা করিবে না, পুলিশ বা পথচারীদের ডাকাডাকি করিবে না, পরে আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করিবে না। দেশের বেশির ভাগ নাগরিক তাহাদের অংশে এই চুক্তি রক্ষা করে। তাহার বিনিময়ে সে এই আশ্বাসটুকু প্রত্যাশা করে যে আপনারাও তাহার শরীরে আঘাত করিবেন না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আপনারা সেই চুক্তি রক্ষা করেন না। তাত্ক্ষণিক উত্তেজনাবশত আপনারা আঘাত করিয়া বসেন। স্বীকার করিতে বাধ্য যে আমাদের দিক হইতেও কখনো কখনো চুক্তিভঙ্গের ঘটনা ঘটে। অনেকেই তাহার সবকিছু তুলিয়া দিতে দ্বিধা করে। তবে জানিবেন, তাহা আপনাদের প্রাপ্য প্রদানের অনীহা নয়, ঘটনাচক্রের তাত্ক্ষণিকতায় তাহারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়ে। ফলে কী করিতে হইবে তাহা তাহারা বুঝিয়া উঠিতে পারে না। এইরূপ ক্ষেত্রে আপনাদিগকেও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হইবে।
দ্বিতীয় আকুল আবেদনটি হইল, দয়া করিয়া চোখে অতি বিষাক্ত মলম দিবেন না। আপনারা সরকার ও বিএসটিআই অনুমোদিত চোখে-সাময়িক-অন্ধকার মলম ব্যবহার করিবেন। সরকার বাহাদুরের নিকট আরজ, এই মলম আপনারা খোলাবাজারে ছাড়ুন এবং ছিনতাইকারীরা যাহাতে কেবল এই মলমটিই আক্রান্তের চোখে ব্যবহার করে, তাহা নিশ্চিত করুন। এনজিওগুলিও এই প্রকল্প হাতে লইতে পারে। ‘নিরাপদ ছিনতাই মলম’ ছিনতাইকারীদের দোরগোড়ায় পৌঁছাইয়া দিতে পারে।
আমাদের তিন নম্বর আরজ হইল, অজ্ঞান করিবার জন্যেও দয়া করিয়া ধুতুরার বিষজাতীয় প্রাণঘাতী চেতনানাশক ব্যবহার করিবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তি মিনিট বিশেক অজ্ঞান থাকিয়া আবার নিরাপদে উঠিয়া দাঁড়াইবে, এই রূপ নিরাপদ চেতনানাশক আপনারা ব্যবহার করিবেন। স্থানীয় থানায় এই রূপ চেতনানাশকের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করিবার জোর দাবি আমরা সরকার বাহাদুরের নিকট পেশ করি।
শ্রদ্ধেয় ছিনতাইকারীগণ, ঢাকা শহরে একজন ব্যক্তিও নাই, যিনি জীবনে একবারও আপনাদের কবলে পড়েন নাই। আপনারা এই শহরে আছেন আলো আর হাওয়ার মতো, রিকশা আর যানজটের মতো, মশা আর ময়লার মতো, ফিরিওয়ালা ও পুলিশের মতো। আপনাদিগকে উচ্ছেদের কথা আমাদের সরকার কল্পনাও করিতে পারিবেন না, কারণ তাহাতে একটি মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কাজেই আপনারা থাকুন।
আমরাও থাকি। ধরুন ঢাকা শহরের সব লোক আপনাদের কবলে পড়িয়া মরিয়া গেল, তখন আপনারা কাহাদের ধরিবেন, কাহাকে ছিনতাই করিবেন?
একটি জাতি কী রূপ তাহা বোঝা যায়, সে-জাতির ছিনতাইকারীরা তাহাদের শিকারের সঙ্গে কী রূপ আচরণ করিয়া থাকে তাহা দেখিয়া। দেশ ও জাতির সম্মানের স্বার্থে আপনারা মানুষ মারা বন্ধ করুন। আর বিশেষ করিয়া বিদেশিদের ছিনতাই করা বর্জন করুন। কারণ তাহা এই দেশে অনভিপ্রেত বিদেশি হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনিতে পারে। যাহা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত করিতে পারে।
অতএব আসুন, আপনাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে আপনারা সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ হোন। আর আমরা নাগরিক কর্তব্য হিসাবে সকল ছিনতাইকারীকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়াইয়া দিই।
পরস্পরের সহযোগিতাই আমাদের অগ্রযাত্রা ও পরিপূর্ণ বিকাশের পূর্বশর্ত।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কেন আপনারা মহাত্মা। কারণ আপনারা বাঁচিয়া রাখিয়াছেন, তাই আমরা এখনো কেহ কেহ বাঁচিয়া আছি। বাঁচিয়া তো নাও রাখিতে পারিতেন! আপনাদের উদ্যত ছুরিকা (ভোঁতা, মরিচাপূর্ণ) আমাদের যেকোনো কাহারও পাঁজর, বক্ষ, উদর এফোঁড় ওফোঁড় করিয়া দিতে পারে যেকোনো সময়, যখন তখন। আপনাদের দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র নির্গত অগ্নিতপ্ত বুলেট যেকোনো করোটি চূর্ণ করিতে পারে, যেকোনো বক্ষ বিদীর্ণ করিতে পারে যত্রতত্র, দিবারাত্র চব্বিশ ঘণ্টার যেকোনো সময়। আপনাদের বিষাক্ত মলম যেকোনো ব্যক্তির চক্ষু অন্ধ করিয়া দিতে পারে চিরকালের জন্যে। আপনাদের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেকোনো কাউকে চেতনাহীন করিয়া পাঠাইয়া দিতে পারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে। ১৮ দিনে মাত্র ৩৭ জনকে আপনারা হাসপাতালে পাঠাইয়াছেন, পাতালে কতজনকে পাঠাইয়াছেন কে জানে, কিন্তু পুরো এক কোটি মানুষের শহরে মাত্র ৩৭ জনকে হাসপাতালে প্রেরণ যে আপনাদের দায়িত্বশীলতা ও মহানুভবতার প্রমাণ, তাহা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।
এই শহরটা তো পুরাপুরি আপনাদেরই পদতলগত। এমনও হইয়াছে, একই রাস্তায় দাঁড়াইয়া আপনারা সিরিজ ছিনতাই করিয়াছেন, একটার পর একটা, এক হালি, এক ডজন, এক কুড়ি, যতটা ইচ্ছা। এমনও হইয়াছে, একই ব্যক্তি রাস্তার এক মোড়ে তাহার সর্বস্ব হারাইয়া পরের মোড়ে গিয়া পৌঁছিবা মাত্র আপনাদেরই আরেক দলের হাতে পড়িয়াছে, তাহার পরনের কাপড় ছাড়া দিবার মতো কিছু নাই, আপনারা তাহাও কাড়িয়া লইয়াছেন, তিনি অতঃপর আরও একদল ছিনতাইকারীর কবলে পড়িয়াছেন। দিবার মতো যাহার কিছু নাই, তাহাকে সামনে পাইয়াও যে আপনারা তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন, সে আপনাদের মহানুভবতা ছাড়া আর কী! আপনারা চলন্ত বাস হইতে ধাক্কা মারিয়া ছিনতাইয়ের শিকারকে প্রাণে মারিয়াছেন, তেমন ঘটনা তো আরও পাঁচ হাজার ঘটিতে পারিত, তাহা তো ঘটে নাই। বাসও আপনাদের, দিনের বেলায় পুরা বাস দখল করিয়া আপনারা ছিনতাই করিতে পারেন। ট্যাক্সিও আপনাদের, ট্যাক্সিওয়ালা যাত্রী লইয়া আপনাদের আস্তানায় আসিয়াই দাঁড়ায়, আপনারা আয়েশের সঙ্গে তাহাতে উঠিয়া যাত্রীকে ঠাসিয়া ধরেন। আপনারা চলন্ত বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি, গাড়ি, রিকশা, স্কুটারের যাত্রীর কানের দুল, গলার চেইন, হাতের ব্যাগ ছোঁ মারিয়া টানিয়া লন, যাত্রীর কান ছিঁড়িয়া যায়, কিন্তু কী মহত্ আপনারা যে মাথাটা আপনারা ছিঁড়িয়া লন না। ধাবন্ত মোটরসাইকেলযোগে আপনারা পথচারী বা রিকশাযাত্রীর ব্যাগ এক থাবায় উড়াইয়া লইয়া যান, যাত্রী যান হইতে পড়িয়া যায়, কি যায় না, তাহা আপনাদের দেখিবার অবকাশ নাই, তবে সকল যাত্রী যে মারাত্মক আহত বা একেবারে নিহত হয় না, তাহা আপনাদের পেশাদারি দক্ষতারই সামান্য প্রকাশ মাত্র। সবচেয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ আপনারা দিয়া থাকেন ব্যাংক হইতে টাকা তুলিয়া যাহারা বাহির হয়, তাহাদের ওপর পরিচালিত অভিযানের ব্যাপারে। গুলি ছুড়িতে হয়। আপনারা দুই-চারিজনকেই মারেন। কিন্তু ব্যাপক গোলাবর্ষণ কিংবা বোমাবাজিতে গণহত্যা করিয়াছেন, এমন কখনো শোনা যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা, আপনারা ধরা পড়েন না। ধরা পড়িলেও আপনাদের কী শাস্তি হয়, জনগণ জানিতে পারে না। শুধু অবিবেচক জনতা মাঝেমধ্যে আপনাদিগকে গণপিটুনি দিয়া থাকে। স্বীকার করি, গণপিটুনি জিনিসটা মোটেও মুখরোচক নয়, ইহাতে আপনাদের কোনো কোনো ইয়ারদোস্ত কোনো কুক্ষণে প্রাণও হারাইয়া থাকিতে পারে। এই উচ্ছৃঙ্খল জনতার এইরূপ বেয়াদবিতে আমরা যাহার পর নাই কুণ্ঠিত ও শরমিন্দা। আপনারা এই অবিমৃষ্যকারীদের গোস্তাকিটুকুন হিসাবে লইবেন না, এই আমাদের আশা।
আপনারাই আমাদের শহরের একমাত্র কায়েমি শক্তি। আপনারাই আছেন, আর কেহ নাই। পুলিশ আছে, তা তো থাকিবেই। ফুল থাকিলে পাতা থাকিবেই। আপনারা হইলেন এই ঢাকা নামক কাননের ফুল আর পুলিশ পাতা মাত্র। পাতা যেমন জানে ফুল আছে, ফুলও তেমনি জানে পাতা আছে। দুইটা মিলিয়াই বাগানের শোভা।
আপনাদের নিকট আমাদের করজোড়ে নিবেদন, প্রতিটা পেশারই একটা পেশাগত নীতিরীতি আছে। সকলেই ইহা মানিয়া চলে। আপনাদেরও একটা ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধি আপনারা স্থির করুন। আপনারা ইহা মানিয়া চলুন। আমরাও, দেশের নাগরিকেরা ইহাতে সহযোগিতা করিব।
আপনারা যখন ছিনতাই করিবেন, তখন কেবল ছিনতাইটুকুই করিবেন, দয়া করিয়া খুনজখম করিবেন না। আপনাদের ছুরি, তরবারি, চাপাতিগুলি দয়া করিয়া ধার দিয়া আনিবেন। ইহাতে যেন মরিচা না থাকে। আর নিতান্ত পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়া না গেলে দয়া করিয়া অস্ত্র পরিচালনা করিবেন না। যে পথচারী বা যাত্রী স্বেচ্ছায় সর্বস্ব আপনাদের হাতে তুলিয়া দিবে, তাহাকে আপনারা দয়া করিয়া আঘাত করিবেন না। যাহা চান, তাহা পাইবার পরেও কেন আপনারা আঘাত করেন? ইহা পেশাগত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যখন আপনারা কাহাকেও টার্গেট করেন, তাহার ওপর চড়াও হন, তখন এই দেশের নাগরিক হিসাবে সেই ব্যক্তি ও আপনারা একটা নির্মল স্পষ্ট চুক্তির অধীনে আসেন। তাহা হইল, সে তাহার সঙ্গে যাহা কিছু আছে, তাহা আপনাদের হাতে তুলিয়া দিবে, কোনো রকমের আপত্তি করিবে না, পলায়নের চেষ্টা করিবে না, পুলিশ বা পথচারীদের ডাকাডাকি করিবে না, পরে আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করিবে না। দেশের বেশির ভাগ নাগরিক তাহাদের অংশে এই চুক্তি রক্ষা করে। তাহার বিনিময়ে সে এই আশ্বাসটুকু প্রত্যাশা করে যে আপনারাও তাহার শরীরে আঘাত করিবেন না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আপনারা সেই চুক্তি রক্ষা করেন না। তাত্ক্ষণিক উত্তেজনাবশত আপনারা আঘাত করিয়া বসেন। স্বীকার করিতে বাধ্য যে আমাদের দিক হইতেও কখনো কখনো চুক্তিভঙ্গের ঘটনা ঘটে। অনেকেই তাহার সবকিছু তুলিয়া দিতে দ্বিধা করে। তবে জানিবেন, তাহা আপনাদের প্রাপ্য প্রদানের অনীহা নয়, ঘটনাচক্রের তাত্ক্ষণিকতায় তাহারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়ে। ফলে কী করিতে হইবে তাহা তাহারা বুঝিয়া উঠিতে পারে না। এইরূপ ক্ষেত্রে আপনাদিগকেও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হইবে।
দ্বিতীয় আকুল আবেদনটি হইল, দয়া করিয়া চোখে অতি বিষাক্ত মলম দিবেন না। আপনারা সরকার ও বিএসটিআই অনুমোদিত চোখে-সাময়িক-অন্ধকার মলম ব্যবহার করিবেন। সরকার বাহাদুরের নিকট আরজ, এই মলম আপনারা খোলাবাজারে ছাড়ুন এবং ছিনতাইকারীরা যাহাতে কেবল এই মলমটিই আক্রান্তের চোখে ব্যবহার করে, তাহা নিশ্চিত করুন। এনজিওগুলিও এই প্রকল্প হাতে লইতে পারে। ‘নিরাপদ ছিনতাই মলম’ ছিনতাইকারীদের দোরগোড়ায় পৌঁছাইয়া দিতে পারে।
আমাদের তিন নম্বর আরজ হইল, অজ্ঞান করিবার জন্যেও দয়া করিয়া ধুতুরার বিষজাতীয় প্রাণঘাতী চেতনানাশক ব্যবহার করিবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তি মিনিট বিশেক অজ্ঞান থাকিয়া আবার নিরাপদে উঠিয়া দাঁড়াইবে, এই রূপ নিরাপদ চেতনানাশক আপনারা ব্যবহার করিবেন। স্থানীয় থানায় এই রূপ চেতনানাশকের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করিবার জোর দাবি আমরা সরকার বাহাদুরের নিকট পেশ করি।
শ্রদ্ধেয় ছিনতাইকারীগণ, ঢাকা শহরে একজন ব্যক্তিও নাই, যিনি জীবনে একবারও আপনাদের কবলে পড়েন নাই। আপনারা এই শহরে আছেন আলো আর হাওয়ার মতো, রিকশা আর যানজটের মতো, মশা আর ময়লার মতো, ফিরিওয়ালা ও পুলিশের মতো। আপনাদিগকে উচ্ছেদের কথা আমাদের সরকার কল্পনাও করিতে পারিবেন না, কারণ তাহাতে একটি মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কাজেই আপনারা থাকুন।
আমরাও থাকি। ধরুন ঢাকা শহরের সব লোক আপনাদের কবলে পড়িয়া মরিয়া গেল, তখন আপনারা কাহাদের ধরিবেন, কাহাকে ছিনতাই করিবেন?
একটি জাতি কী রূপ তাহা বোঝা যায়, সে-জাতির ছিনতাইকারীরা তাহাদের শিকারের সঙ্গে কী রূপ আচরণ করিয়া থাকে তাহা দেখিয়া। দেশ ও জাতির সম্মানের স্বার্থে আপনারা মানুষ মারা বন্ধ করুন। আর বিশেষ করিয়া বিদেশিদের ছিনতাই করা বর্জন করুন। কারণ তাহা এই দেশে অনভিপ্রেত বিদেশি হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনিতে পারে। যাহা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত করিতে পারে।
অতএব আসুন, আপনাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে আপনারা সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ হোন। আর আমরা নাগরিক কর্তব্য হিসাবে সকল ছিনতাইকারীকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়াইয়া দিই।
পরস্পরের সহযোগিতাই আমাদের অগ্রযাত্রা ও পরিপূর্ণ বিকাশের পূর্বশর্ত।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments