বাঙালির স্বাধীনতা—বাঙালির অপহরণ স্পৃহা -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বড় বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন। সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাত জেগে মুখস্থ করে। ঠিকমতো মুখস্থ করতে না পারলে চিরকুটে লিখে নিয়ে যায় পরীক্ষার হলে। নিজের দলীয় সরকার না হলে আন্ডারওয়্যারের ভেতরে লুকিয়ে নিতে হয়। ওটা দেখে পরীক্ষার খাতায় টুকতে হয় সাবধানে। পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের মতো অরাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সাধারণ বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো—একটি রাষ্ট্র শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয়, তার জনগণ ও সরকার-প্রশাসন প্রভৃতি। তবে রাষ্ট্রে জনগণই আসল, সরকার পরে।
পত্রপত্রিকায় যাঁরা প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় বা সম্পাদকীয়ের ডানদিকের পাতায় রচনা লেখেন তাঁরা সরকারের কড়া সমালোচনা করতে পারলে বিশেষ আনন্দ পান। সরকারকে ধোলাই দিতে না পারলে মন ভরে না। কিন্তু রাষ্ট্রের আসল যে জনগণ, যারা সংখ্যায় অনেক, তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ সরকারপ্রধানকে হাতের নাগালে পাওয়া যায়, বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে হাত বাড়ালেই ধরা যায়, কিন্তু জনগণের প্রধানকে? সব জনগণকে এক সঙ্গে ধরে কীভাবে? সুতরাং জনগণের ভালো-মন্দ, দোষ-ত্রুটি আড়ালে থেকে যায়—তা আড়ালে থাকে অল্পকাল নয়—শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারপর কোনো মহান সংস্কারক এসে তা সংশোধনের চেষ্টা করেন। তবে বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী সহজে সংশোধনযোগ্য নয়।
সীমাহীন ত্যাগ ও কঠোর সাধনার পর কোনো জাতির জীবনে স্বাধীনতা আসে। যেমন উপমহাদেশের মানুষের জীবনে এসেছিল ১৪-১৫ আগস্ট ১৯৪৭। তার আগে এ দেশের মানুষের নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না ১৯০ বছর—তারা ছিল নিজ বাসভূমে পরবাসী। তখন দেশটির মালিকানা ছিল মহামহিম ব্রিটিশ সম্রাটের। এ দেশের মানুষ ছিল তাঁর সাবজেক্ট—অর্থাত্ প্রজা বা দাস। বাঙালিসহ উপমহাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের অধিকারী হলো বা মালিকানা পেল ১৫ আগস্ট থেকে। অমন আনন্দের দিন, অমন স্মরণীয় দিবস, কোনো জাতির জীবনে শত শত নয়, হাজার বছরেও আসে না।
বাঙালি সেই দিনটি কীভাবে উদ্যাপন করেছিল। সেই ১৫ আগস্ট। ১৯৪৭ সাল। আজ খুব কম মানুষই জানে সেদিন বাঙালি কী করেছিল। বাঙালি সেদিন দিয়েছিল তার প্রকৃত পরিচয়। এত মায়ের, এত ভাই ও বোনের, এত বাবার অশ্রু বিসর্জনের পর, কত প্রাণের বিনিময়ে জাতি পাচ্ছে মুক্তির স্বাদ। সেই আনন্দের মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী কলকাতায় গভর্নর হাউস জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। ভোর থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত সেখানে ছিল সাধারণ মানুষের অবাধ যাতায়াত।
সদ্য গঠিত প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী—মহাত্মা গান্ধীর বেহাই মহাশয়। তবে স্যুটকেস গোছগাছ করতে দেরি হওয়ায় ব্রিটিশ গর্ভনর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ ও মাদাম বারোজ-ও তাঁদের শয়নকক্ষে কোনোরকমে ম্লানমুখে বসে ছিলেন।
একেবারে সকাল সকালই কংগ্রেস ও মহাসভার একদল কর্মী-সমর্থক বীরদর্পে ঢুকে গেল ওই প্রাসাদে। এ ঘর-ও ঘর তছনছ করে তারা গিয়ে ঢোকে গভর্নরের শয়নকক্ষে। জনাদশেক লাফ দিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে উঠে পড়ে খাটের ওপর। উঠেই আনন্দে লাফাতে থাকে। লাফানো পর্যন্ত ভালোই ছিল। একজন বেডকভার আরেকজন বিছানার মূল্যবান চাদরটি টান দিয়ে তুলে কাঁধে ফেলে হন্ হন্ করে চলে গেল। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে গভর্নরের পত্নী থর থর করে কাঁপছিলেন। দু-একটি কলকাত্তিয়া গালও তাঁর কানে গেছে, তবে তিনি ভাষার মর্মার্থ ও মাধুর্য বুঝতে পারেননি। বহু দিন পর সেই দিনের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন।
চাদর, বেডকভার, বালিশ নিয়ে গেলে ভালোই ছিল, নতুন গভর্নর রাজাগোপালাচারী অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলে বালিশ ছাড়াই না হয় প্রথম দিন ঘুমাতেন। কিন্তু রাতের খাবার খাবেন কিসে? তিনি তো গান্ধীজি নন যে একটি বাটিই যথেষ্ট। প্লেট, চামচ, পেয়ালা থেকে শুরু করে গভর্নরের বিবির লিপস্টিক, পাউডার কেন, বিউটি বক্স—সবই হাতে হাতে চলে যায়।
হোটেলে গিয়ে সন্ধ্যার পর গভর্নর যখন ভালো করে তাঁর পত্নীর দিকে তাকালেন, তাঁর চোখে পানি আসার জো! কান্না চেপে বলেছিলেন, ‘হানী, তোমার একি দশা! চুল উষ্কোখুষ্কো, ঠোঁট খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো পাংশু।’ মাদাম বলেন, ‘আমার চিরুনিও নিয়ে গেছে।’ গভর্নর হাফ ছেড়ে বললেন, ‘চিরুনি নিয়ে গেছে যাক, তোমাকে যে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়নি এই আমার সাতজনমের ভাগ্যি।’
১৫ আগস্ট গান্ধীজি ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর পরিত্যক্ত বাড়ি বেলেঘাটায় ‘হায়দারি মঞ্জিলে’। ১৯০ বছর পর স্বাধীনতাপ্রাপ্তরা গভর্নর হাউসের হেঁসেলের খুন্তি পর্যন্ত খুশিতে হাতে করে বাড়ি নিয়ে গেছে—এ কথা তাঁর কানে যায়। অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, নতুন মুখ্যমন্ত্রী ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, পুলিশের আইজিসহ পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ কর্মকর্তারা গান্ধীজিকে ঘটনার বিবরণ দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। গান্ধীজি গভর্নর হাউসের ঘটনা শুনে এতটাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন যা তিনি তাঁর ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আর কোনোদিন হননি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ হলে গান্ধীজি ভাবতেন তাঁর বেহাই রাজাজিকে নিয়ে—তিনিও নতুন রাজ্যপাল হিসেবে ওই প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন আর সেখানকার সবকিছু লুটপাট হয়ে গেল! সেদিন তিনি তাঁর অপরাহ্নিক প্রার্থনা করেছিলেন বাঙালির ভবিষ্যত্ নিয়ে।
বাংলা বিভাগ ও গান্ধীজির ওপর কাজ করতে গিয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের সাক্ষাত্কার নিই, বিশেষ করে যারা ১৯৪৬-৪৭ সালে সক্রিয় ছিলেন। কয়েক মাস আগে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলেও স্বাধীনতা লাভের সপ্তাহখানেক আগে কলকাতার ও শহরতলির মিষ্টির দোকান এবং রেস্তোরাঁর মালিকেরা দাতা কর্ণ সেজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ১৫ আগস্ট তাঁরা ক্রেতাদের কাছ থেকে কোনো পয়সা নেবেন না। স্বাধীনতার সুখের চেয়ে বিনা পয়সায় খাওয়াটা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জন্য বেশি আনন্দের। বলতে গেলে ওটাই পরম সুখ। বিনা পয়সায় মিষ্টিমুখ করার মওকা হাতছাড়া করবে এমন বেকুব কোনো বাঙালি হতেই পারে না।
এখনকার মতো সেদিন দুধের লিটার ৫০ টাকা আর চিনি ৭০ টাকা কেজি ছিল না। দুধ ছিল পঁচিশ পয়সা সের (লিটার) আর চিনির মণ ৩৫ টাকা, অর্থাত্ এখনকার এক লিটার দুধের দামে ১৯৪৭ সালে ২০০ লিটার দুধ কেনা যেত এবং এক কেজি চিনির দামে পাওয়া যেত দুই মণ চিনি। ১৪ তারিখ সারা রাত জেগে প্রতিদিনের চাহিদার চেয়ে পাঁচ-দশ গুণ বেশি মিষ্টি তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন ময়রার দোকানে।
২০০০ সালে আমি কলকাতার চৌরঙ্গী, শ্যামবাজার, হ্যারিসন রোড প্রভৃতি এলাকার ১০-১২ জন বৃদ্ধ ঘোষের সঙ্গে কথা বলি। সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের কথা জিজ্ঞেস করায় ঘোষ মশায়দের কেউ কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে যান। তবে কারও কারও চোখ জ্বলে ওঠে ক্ষোভে। একটি দাঁতও না থাকায় দাঁত-কট্মট করতে পারলেন না—শুধু মুখের মাংসপেশিগুলো নড়তে লাগল। প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, বেলা ১০-১১টার মধ্যেই তাদের দোকানের মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। তা হতেই পারে। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্তরা দোকানের পিরিচ চা-কাপ ও চামচগুলো পর্যন্ত পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। ১৬ আগস্ট দোকানি ও রেস্তোরাঁর মালিকেরা নতুন কাপ- পিরিচ-চামচ কিনে দোকান খোলেন।
এ তো গেল বাঙালির পুরোনো স্বাধীনতার গল্প। আমার সেটা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে নতুন স্বাধীনতার দিনগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো রয়েছে। ২৬ ডিসেম্বরের কথাটি বেশ মনে আছে। সকালবেলা, বেইলি রোডের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ঘনিষ্ঠ একজন একটি গাড়িতে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় জেনারেলের মতো পোশাক পরা। নয় মাস তিনি সাধারণ পোশাকেই ছিলেন। বললেন, গাড়িতে উঠুন। সোজা মগবাজার পাঁচ রাস্তা দিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকা।
কোহিনূর কেমিক্যালে গিয়ে কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর নাবিস্কো। এভাবে ১০-১২টা পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানায় গেলেন। এবং শেষটায় এক পরিত্যক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, নাহ্, শ্লারা সব আগেই দখল কইরা ফ্যালাইছে।
স্টেডিয়ামের বিহারিদের দোকানগুলো বেদখল হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বরের তিন-চার দিনের মধ্যে। আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ তালা ভেঙে দোকানে ঢুকে বসে যায়। মোহাম্মদ-মিরপুর ও ঢাকার অন্যান্য এলাকার অবাঙালিদের বাড়িগুলোর ‘আগে গেলে আগে পাবেন’ নীতিতে রাতারাতি মালিকানা বদলে যায়।
বাঙালির জীবনে একেকবার স্বাধীনতা এসেছে আর একদল মানুষের দিন বদলে গেছে। সাতচল্লিশে এক গোত্রের ভাগ্য বদল ঘটে, একাত্তরে আরেক গোত্রের। একই সঙ্গে ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে কোটি কোটি মানুষের। কলকাতায় যখন দোকানের চামচ-পিরিচ হাওয়া হয় তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান তো বসে থাকতে পারে না। তারা পিরিচ-চামচে সন্তুষ্ট নয়। আম-জাম-জামরুল-নারকেল-সুপারির বাগান, উঠানের কোণে জবা ও কাঠটগর গাছ এবং পুকুরসমেত বিত্তবান হিন্দুদের ২০-৩০ বিঘার বাড়ি জমির দিকে চোখ পড়ে। মুসলিম লীগের লুঙ্গি পরা মোড়ল বাজারের মধ্যে সজোরে পানের পিক ফেলে বলে, কী দত্ত মশায়, ও-পারে যাইবেন কবে? বাড়ি বেচলে আমারে দিয়েন। যা পারি দিমুনে।
দত্ত মশায় ভাত খাওয়া ছেড়ে দেন। গিন্নি বলেন, দানাপানি ছাইড়া দিলা নাকি? দত্ত বাবু বলেন, ঘর বাড়ি সুদ্ধা ৩২ বিঘা আঠার হাজারে দিয়া দিলাম। বড় ট্রাংকটা বাইর করো। কাপড়চোপ গুছাও। গোয়ালন্দ থিকা ট্রেন। সোজা শিয়ালদাহ।
আমরা—বাঙালিরা—অবলীলায় অপরের সম্পদ অপহরণে অভ্যস্ত। আমরা হিন্দুদের সম্পদ লুট করেছি, আমরা বিহারিদের বাড়িঘর-কলকারখানা জবরদখল করেছি। তিল তিল করে সঞ্চয় করা টাকায় তৈরি কারও শখের বাড়িটিতে গিয়ে ঢুকে পড়েছি। ও-বাড়ির গৃহকর্ত্রীর ছল্ ছল্ চোখ একবারও আমাদের চোখে ভাসেনি।
জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার দুই-তিন দিন পর দৈনিক বাংলা বিচিত্রার সাংবাদিকসহ আমরা কয়েকজন মিরপুর যাই। আমাদের আশা ছিল, দু-চার দিনের মধ্যে তাঁকে দুর্বৃত্তরা মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। মিরপুর গোলচক্করের কাছে আমার এক পূর্বপরিচিতের সঙ্গে দেখা। বললাম, এখানে কী করেন। তিনি বললে, মিরপুরেই থাকি। বললাম, এত দূরে বাসা নিলেন? তিনি বললেন, বাসা না, নিজের বাড়ি। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগেও তিনি ছিলেন লালবাগের দিকে এক মেসে। স্বাধীনতার চল্লিশ দিন না যেতেই তিনি হলেন এক তৈরি বাড়ির মালিক। সাহস করে বীরোচিতভাবে দখল নিলেই হলো।
কিন্তু বিহারিদের বাড়ি-দোকানপাট দখল করেছে কয়জন? লাখ লাখ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা পায়নি কিছুই—সামান্য কয়েক টাকার ভাতা পর্যন্ত নয়। প্রতিদিন আমি দেখি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের আজিজুর রহমানকে। ধানমন্ডি আজিজ অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড। সাড়ে তিন বা চার হাজার টাকা মাইনে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডিউটি। তিনি ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে। সিদ্দিকী সাহেব ও তাঁর অগ্রজ বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তাঁকে খুব ভালো চেনেন। আজিজুর রহমান ট্রেনিং নেন ভারতের তুরায়। আমাদের বন্ধু খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ট্রেনিং নেন তুরার ৬ নম্বর উয়িংয়ে, আজিজ মিয়া ট্রেনিং নেন ৭ নম্বর উয়িংয়ে। জুন-জুলাই মাসে ড. রাজ্জাক ও তিনি একই নৌকায় গোপালপুর ফেরেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আজিজ মিয়ার ভাড়াটি টাঙ্গাইলের ডিসির দয়ায় আজও পাননি। আজিজ মিয়ার মতো মানুষও বাংলাদেশে অগণিত।
একটি সুশাসিত, সুশৃঙ্খল ও সার্থক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে জনগণ ও সরকারের যৌথ চেষ্টায়। একটি রাষ্ট্রে জনগণই ৯০ ভাগ, সরকার মাত্র ১০ শতাংশ। সরকারের ভুলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় ১০ ভাগ, জনগণের অকর্মণ্যতা ও অপকর্মের ক্ষতি অপরিমেয়। একেকটি নৃতাত্ত্বিক বা শঙ্কর জনগোষ্ঠীর একেকটি মৌল চরিত্র থাকে। বাঙালির মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি গুণ্ডামিপ্রবণতা প্রবল; তার অপহরণস্পৃহা অপ্রতিরোধ্য। অন্যের জিনিস দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিছু ভাঙার কথা শুনলে তার—‘মুখ হাসে তার চোখ হাসে তার টগবগিয়ে খুন হাসে।’ ধ্বংস-সুখের উল্লাসে সে মেতে ওঠে।
গত পাঁচ হাজার বছরে কৃষকেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নাই, তাঁতিরা করে নাই, জেলেরা করে নাই, কামার ও কুমারেরা করে নাই। প্রতিদিন মারামারি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে। কৃষক ও তাঁতি কোনো দিন মন্ত্রী-উপদেষ্টা হবে না। এখন যারা পরস্পরের মাথা ফাটাচ্ছে তাদেরই কেউ ১৫-২০ বছর পর সাংসদ, সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রদূত হবে।
একটি ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই, তা হলো যদি কোনো ‘নেতা’ আজ যমুনা সেতু গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেন—এক কোটি লোক একদিনের মধ্যে ওখানে জড়ো হবে। কোমর পড়ে যাওয়া বুড়োও ওখানে গিয়ে হাজির হবে। কেউ যাবে শুধু ইট ও লোহাগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে। পুরো সেতু ভাঙতে সাতদিনের বেশি লাগবে না।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেই ৩৭ বছর বয়স্ক অনেক বক্তাকে আজকাল মঞ্চে পদাঘাত করতে দেখি। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা শুধু আমরা পাইনি। ভিয়েতনামিরা ৩০ বছর যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্যবাদী জাপান, ফ্রান্স ও আমেরিকার বিরুদ্ধে। ৩০ লাখ তিন হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে ১৯৭৫-এ যেদিন ভিয়েতনাম স্বাধীন হয় সেদিন রয়টারের পাঠানো একটি খবর আমি যত্নে রেখে দিই। সায়গন বা হোচি মিন নগরের রাস্তায় আমেরিকানদের ব্যবহূত বিলাস সামগ্রী স্তূপীকৃত করে রাখা হয়। কোনো ভিয়েতনামি তা ছুঁয়েও দেখেনি। অবশ্য পরে আমেরিকানদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে ভিয়েতনাম। তারা বাস্তববাদী। এবং দেশপ্রেম তাদের আমাদের চেয়ে একচুল হলেও বেশি। তবে কথা ও বক্তৃতায় তারা আমাদের সঙ্গে পারবে না।
স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কত প্রাণ গেল। কিন্তু বাঙালির ভেতর থেকে অপহরণস্পৃহা ও গুণ্ডামির প্রবণতা গেল না। দখল মানে বুক ফুলিয়ে অপহরণ করা। ৩০টি বেলি বা গাঁদাফুলের গাছ নয়, সমুদ্রসৈকতের ৩০ হাজার ঝাউগাছ অলৌকিভাবে উধাও হয়ে গেছে। গাছ তো নিয়ে গেছেই গেছে, এখন গাছের মুথা তুলতে কামলা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম আলোর গাছ নিধন ছবির শিরোনামে বলা হয়েছে: একসময়ের ঘন বন এখন বিরানভূমি।
একদিন বাংলাদেশই বিরান হয়ে যাবে। যারা বিরান করবে তাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে আমেরিকায়। ওখানে রাস্তার গাড়ি মুছলেও ডলার কামাই করা যায়। ঝাউগাছ নয়, খাস জমিগুলোও দখল হয়ে গেছে। অর্পিত সম্পত্তি নামে এক সোনার খনি আছে, তা দখল হচ্ছে। সরকারি রাস্তার ইটগুলো চলে যাচ্ছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীর বাড়িতে। নদীর তীরগুলোর পানি নামারও অবসর পাচ্ছে না, সেখানে উঠছে দালালকোঠা। নদীর বালু চুরি হচ্ছে দিনদুপুরে। কার সাধ্য বাধা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমিতে যার খুশি তুলছে ঘর। টেন্ডারের বাক্সগুলো জাদুর বাক্সের মতো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। নিজে টেন্ডার পাবে না তাই টেন্ডার বাক্সে দরপত্রে পানি ঢেলে দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সড়কের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে হাজারও মানুষের সামনে। বনভূমি তো বনবিভাগের কর্তাদের পৈর্তৃক সম্পত্তি। আদিবাসীদের জমি দখলে কোনো ঝুঁকি নেই। পার্বত্য এলাকার বিস্তীর্ণ বনবাদাড় দেখে বাঙালি মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা ও বড়-মাঝারি-ছোট নেতার মাথা ঠিক থাকতেই পারে না।
দখল-বাণিজ্য ও দিনবদল নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। অল্প জায়গায় আট মাসের অত কথা বলার সুযোগ আমাকে সম্পাদক দেবেন না। তাই পুরোনো দিনের কিছু ঐতিহাসিক দখল-অপহরণের গল্প বলে দুধের কাজ মাঠায় মিটিয়ে দিলাম।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পত্রপত্রিকায় যাঁরা প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় বা সম্পাদকীয়ের ডানদিকের পাতায় রচনা লেখেন তাঁরা সরকারের কড়া সমালোচনা করতে পারলে বিশেষ আনন্দ পান। সরকারকে ধোলাই দিতে না পারলে মন ভরে না। কিন্তু রাষ্ট্রের আসল যে জনগণ, যারা সংখ্যায় অনেক, তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ সরকারপ্রধানকে হাতের নাগালে পাওয়া যায়, বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে হাত বাড়ালেই ধরা যায়, কিন্তু জনগণের প্রধানকে? সব জনগণকে এক সঙ্গে ধরে কীভাবে? সুতরাং জনগণের ভালো-মন্দ, দোষ-ত্রুটি আড়ালে থেকে যায়—তা আড়ালে থাকে অল্পকাল নয়—শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারপর কোনো মহান সংস্কারক এসে তা সংশোধনের চেষ্টা করেন। তবে বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী সহজে সংশোধনযোগ্য নয়।
সীমাহীন ত্যাগ ও কঠোর সাধনার পর কোনো জাতির জীবনে স্বাধীনতা আসে। যেমন উপমহাদেশের মানুষের জীবনে এসেছিল ১৪-১৫ আগস্ট ১৯৪৭। তার আগে এ দেশের মানুষের নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না ১৯০ বছর—তারা ছিল নিজ বাসভূমে পরবাসী। তখন দেশটির মালিকানা ছিল মহামহিম ব্রিটিশ সম্রাটের। এ দেশের মানুষ ছিল তাঁর সাবজেক্ট—অর্থাত্ প্রজা বা দাস। বাঙালিসহ উপমহাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের অধিকারী হলো বা মালিকানা পেল ১৫ আগস্ট থেকে। অমন আনন্দের দিন, অমন স্মরণীয় দিবস, কোনো জাতির জীবনে শত শত নয়, হাজার বছরেও আসে না।
বাঙালি সেই দিনটি কীভাবে উদ্যাপন করেছিল। সেই ১৫ আগস্ট। ১৯৪৭ সাল। আজ খুব কম মানুষই জানে সেদিন বাঙালি কী করেছিল। বাঙালি সেদিন দিয়েছিল তার প্রকৃত পরিচয়। এত মায়ের, এত ভাই ও বোনের, এত বাবার অশ্রু বিসর্জনের পর, কত প্রাণের বিনিময়ে জাতি পাচ্ছে মুক্তির স্বাদ। সেই আনন্দের মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী কলকাতায় গভর্নর হাউস জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। ভোর থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত সেখানে ছিল সাধারণ মানুষের অবাধ যাতায়াত।
সদ্য গঠিত প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী—মহাত্মা গান্ধীর বেহাই মহাশয়। তবে স্যুটকেস গোছগাছ করতে দেরি হওয়ায় ব্রিটিশ গর্ভনর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ ও মাদাম বারোজ-ও তাঁদের শয়নকক্ষে কোনোরকমে ম্লানমুখে বসে ছিলেন।
একেবারে সকাল সকালই কংগ্রেস ও মহাসভার একদল কর্মী-সমর্থক বীরদর্পে ঢুকে গেল ওই প্রাসাদে। এ ঘর-ও ঘর তছনছ করে তারা গিয়ে ঢোকে গভর্নরের শয়নকক্ষে। জনাদশেক লাফ দিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে উঠে পড়ে খাটের ওপর। উঠেই আনন্দে লাফাতে থাকে। লাফানো পর্যন্ত ভালোই ছিল। একজন বেডকভার আরেকজন বিছানার মূল্যবান চাদরটি টান দিয়ে তুলে কাঁধে ফেলে হন্ হন্ করে চলে গেল। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে গভর্নরের পত্নী থর থর করে কাঁপছিলেন। দু-একটি কলকাত্তিয়া গালও তাঁর কানে গেছে, তবে তিনি ভাষার মর্মার্থ ও মাধুর্য বুঝতে পারেননি। বহু দিন পর সেই দিনের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন।
চাদর, বেডকভার, বালিশ নিয়ে গেলে ভালোই ছিল, নতুন গভর্নর রাজাগোপালাচারী অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলে বালিশ ছাড়াই না হয় প্রথম দিন ঘুমাতেন। কিন্তু রাতের খাবার খাবেন কিসে? তিনি তো গান্ধীজি নন যে একটি বাটিই যথেষ্ট। প্লেট, চামচ, পেয়ালা থেকে শুরু করে গভর্নরের বিবির লিপস্টিক, পাউডার কেন, বিউটি বক্স—সবই হাতে হাতে চলে যায়।
হোটেলে গিয়ে সন্ধ্যার পর গভর্নর যখন ভালো করে তাঁর পত্নীর দিকে তাকালেন, তাঁর চোখে পানি আসার জো! কান্না চেপে বলেছিলেন, ‘হানী, তোমার একি দশা! চুল উষ্কোখুষ্কো, ঠোঁট খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো পাংশু।’ মাদাম বলেন, ‘আমার চিরুনিও নিয়ে গেছে।’ গভর্নর হাফ ছেড়ে বললেন, ‘চিরুনি নিয়ে গেছে যাক, তোমাকে যে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়নি এই আমার সাতজনমের ভাগ্যি।’
১৫ আগস্ট গান্ধীজি ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর পরিত্যক্ত বাড়ি বেলেঘাটায় ‘হায়দারি মঞ্জিলে’। ১৯০ বছর পর স্বাধীনতাপ্রাপ্তরা গভর্নর হাউসের হেঁসেলের খুন্তি পর্যন্ত খুশিতে হাতে করে বাড়ি নিয়ে গেছে—এ কথা তাঁর কানে যায়। অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, নতুন মুখ্যমন্ত্রী ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, পুলিশের আইজিসহ পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ কর্মকর্তারা গান্ধীজিকে ঘটনার বিবরণ দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। গান্ধীজি গভর্নর হাউসের ঘটনা শুনে এতটাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন যা তিনি তাঁর ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আর কোনোদিন হননি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ হলে গান্ধীজি ভাবতেন তাঁর বেহাই রাজাজিকে নিয়ে—তিনিও নতুন রাজ্যপাল হিসেবে ওই প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন আর সেখানকার সবকিছু লুটপাট হয়ে গেল! সেদিন তিনি তাঁর অপরাহ্নিক প্রার্থনা করেছিলেন বাঙালির ভবিষ্যত্ নিয়ে।
বাংলা বিভাগ ও গান্ধীজির ওপর কাজ করতে গিয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের সাক্ষাত্কার নিই, বিশেষ করে যারা ১৯৪৬-৪৭ সালে সক্রিয় ছিলেন। কয়েক মাস আগে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলেও স্বাধীনতা লাভের সপ্তাহখানেক আগে কলকাতার ও শহরতলির মিষ্টির দোকান এবং রেস্তোরাঁর মালিকেরা দাতা কর্ণ সেজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ১৫ আগস্ট তাঁরা ক্রেতাদের কাছ থেকে কোনো পয়সা নেবেন না। স্বাধীনতার সুখের চেয়ে বিনা পয়সায় খাওয়াটা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জন্য বেশি আনন্দের। বলতে গেলে ওটাই পরম সুখ। বিনা পয়সায় মিষ্টিমুখ করার মওকা হাতছাড়া করবে এমন বেকুব কোনো বাঙালি হতেই পারে না।
এখনকার মতো সেদিন দুধের লিটার ৫০ টাকা আর চিনি ৭০ টাকা কেজি ছিল না। দুধ ছিল পঁচিশ পয়সা সের (লিটার) আর চিনির মণ ৩৫ টাকা, অর্থাত্ এখনকার এক লিটার দুধের দামে ১৯৪৭ সালে ২০০ লিটার দুধ কেনা যেত এবং এক কেজি চিনির দামে পাওয়া যেত দুই মণ চিনি। ১৪ তারিখ সারা রাত জেগে প্রতিদিনের চাহিদার চেয়ে পাঁচ-দশ গুণ বেশি মিষ্টি তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন ময়রার দোকানে।
২০০০ সালে আমি কলকাতার চৌরঙ্গী, শ্যামবাজার, হ্যারিসন রোড প্রভৃতি এলাকার ১০-১২ জন বৃদ্ধ ঘোষের সঙ্গে কথা বলি। সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের কথা জিজ্ঞেস করায় ঘোষ মশায়দের কেউ কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে যান। তবে কারও কারও চোখ জ্বলে ওঠে ক্ষোভে। একটি দাঁতও না থাকায় দাঁত-কট্মট করতে পারলেন না—শুধু মুখের মাংসপেশিগুলো নড়তে লাগল। প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, বেলা ১০-১১টার মধ্যেই তাদের দোকানের মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। তা হতেই পারে। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্তরা দোকানের পিরিচ চা-কাপ ও চামচগুলো পর্যন্ত পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়। ১৬ আগস্ট দোকানি ও রেস্তোরাঁর মালিকেরা নতুন কাপ- পিরিচ-চামচ কিনে দোকান খোলেন।
এ তো গেল বাঙালির পুরোনো স্বাধীনতার গল্প। আমার সেটা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে নতুন স্বাধীনতার দিনগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো রয়েছে। ২৬ ডিসেম্বরের কথাটি বেশ মনে আছে। সকালবেলা, বেইলি রোডের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ঘনিষ্ঠ একজন একটি গাড়িতে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় জেনারেলের মতো পোশাক পরা। নয় মাস তিনি সাধারণ পোশাকেই ছিলেন। বললেন, গাড়িতে উঠুন। সোজা মগবাজার পাঁচ রাস্তা দিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকা।
কোহিনূর কেমিক্যালে গিয়ে কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর নাবিস্কো। এভাবে ১০-১২টা পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানায় গেলেন। এবং শেষটায় এক পরিত্যক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, নাহ্, শ্লারা সব আগেই দখল কইরা ফ্যালাইছে।
স্টেডিয়ামের বিহারিদের দোকানগুলো বেদখল হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বরের তিন-চার দিনের মধ্যে। আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ তালা ভেঙে দোকানে ঢুকে বসে যায়। মোহাম্মদ-মিরপুর ও ঢাকার অন্যান্য এলাকার অবাঙালিদের বাড়িগুলোর ‘আগে গেলে আগে পাবেন’ নীতিতে রাতারাতি মালিকানা বদলে যায়।
বাঙালির জীবনে একেকবার স্বাধীনতা এসেছে আর একদল মানুষের দিন বদলে গেছে। সাতচল্লিশে এক গোত্রের ভাগ্য বদল ঘটে, একাত্তরে আরেক গোত্রের। একই সঙ্গে ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে কোটি কোটি মানুষের। কলকাতায় যখন দোকানের চামচ-পিরিচ হাওয়া হয় তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান তো বসে থাকতে পারে না। তারা পিরিচ-চামচে সন্তুষ্ট নয়। আম-জাম-জামরুল-নারকেল-সুপারির বাগান, উঠানের কোণে জবা ও কাঠটগর গাছ এবং পুকুরসমেত বিত্তবান হিন্দুদের ২০-৩০ বিঘার বাড়ি জমির দিকে চোখ পড়ে। মুসলিম লীগের লুঙ্গি পরা মোড়ল বাজারের মধ্যে সজোরে পানের পিক ফেলে বলে, কী দত্ত মশায়, ও-পারে যাইবেন কবে? বাড়ি বেচলে আমারে দিয়েন। যা পারি দিমুনে।
দত্ত মশায় ভাত খাওয়া ছেড়ে দেন। গিন্নি বলেন, দানাপানি ছাইড়া দিলা নাকি? দত্ত বাবু বলেন, ঘর বাড়ি সুদ্ধা ৩২ বিঘা আঠার হাজারে দিয়া দিলাম। বড় ট্রাংকটা বাইর করো। কাপড়চোপ গুছাও। গোয়ালন্দ থিকা ট্রেন। সোজা শিয়ালদাহ।
আমরা—বাঙালিরা—অবলীলায় অপরের সম্পদ অপহরণে অভ্যস্ত। আমরা হিন্দুদের সম্পদ লুট করেছি, আমরা বিহারিদের বাড়িঘর-কলকারখানা জবরদখল করেছি। তিল তিল করে সঞ্চয় করা টাকায় তৈরি কারও শখের বাড়িটিতে গিয়ে ঢুকে পড়েছি। ও-বাড়ির গৃহকর্ত্রীর ছল্ ছল্ চোখ একবারও আমাদের চোখে ভাসেনি।
জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার দুই-তিন দিন পর দৈনিক বাংলা বিচিত্রার সাংবাদিকসহ আমরা কয়েকজন মিরপুর যাই। আমাদের আশা ছিল, দু-চার দিনের মধ্যে তাঁকে দুর্বৃত্তরা মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। মিরপুর গোলচক্করের কাছে আমার এক পূর্বপরিচিতের সঙ্গে দেখা। বললাম, এখানে কী করেন। তিনি বললে, মিরপুরেই থাকি। বললাম, এত দূরে বাসা নিলেন? তিনি বললেন, বাসা না, নিজের বাড়ি। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগেও তিনি ছিলেন লালবাগের দিকে এক মেসে। স্বাধীনতার চল্লিশ দিন না যেতেই তিনি হলেন এক তৈরি বাড়ির মালিক। সাহস করে বীরোচিতভাবে দখল নিলেই হলো।
কিন্তু বিহারিদের বাড়ি-দোকানপাট দখল করেছে কয়জন? লাখ লাখ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা পায়নি কিছুই—সামান্য কয়েক টাকার ভাতা পর্যন্ত নয়। প্রতিদিন আমি দেখি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের আজিজুর রহমানকে। ধানমন্ডি আজিজ অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড। সাড়ে তিন বা চার হাজার টাকা মাইনে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডিউটি। তিনি ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে। সিদ্দিকী সাহেব ও তাঁর অগ্রজ বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তাঁকে খুব ভালো চেনেন। আজিজুর রহমান ট্রেনিং নেন ভারতের তুরায়। আমাদের বন্ধু খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ট্রেনিং নেন তুরার ৬ নম্বর উয়িংয়ে, আজিজ মিয়া ট্রেনিং নেন ৭ নম্বর উয়িংয়ে। জুন-জুলাই মাসে ড. রাজ্জাক ও তিনি একই নৌকায় গোপালপুর ফেরেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আজিজ মিয়ার ভাড়াটি টাঙ্গাইলের ডিসির দয়ায় আজও পাননি। আজিজ মিয়ার মতো মানুষও বাংলাদেশে অগণিত।
একটি সুশাসিত, সুশৃঙ্খল ও সার্থক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে জনগণ ও সরকারের যৌথ চেষ্টায়। একটি রাষ্ট্রে জনগণই ৯০ ভাগ, সরকার মাত্র ১০ শতাংশ। সরকারের ভুলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় ১০ ভাগ, জনগণের অকর্মণ্যতা ও অপকর্মের ক্ষতি অপরিমেয়। একেকটি নৃতাত্ত্বিক বা শঙ্কর জনগোষ্ঠীর একেকটি মৌল চরিত্র থাকে। বাঙালির মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি গুণ্ডামিপ্রবণতা প্রবল; তার অপহরণস্পৃহা অপ্রতিরোধ্য। অন্যের জিনিস দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিছু ভাঙার কথা শুনলে তার—‘মুখ হাসে তার চোখ হাসে তার টগবগিয়ে খুন হাসে।’ ধ্বংস-সুখের উল্লাসে সে মেতে ওঠে।
গত পাঁচ হাজার বছরে কৃষকেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নাই, তাঁতিরা করে নাই, জেলেরা করে নাই, কামার ও কুমারেরা করে নাই। প্রতিদিন মারামারি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে। কৃষক ও তাঁতি কোনো দিন মন্ত্রী-উপদেষ্টা হবে না। এখন যারা পরস্পরের মাথা ফাটাচ্ছে তাদেরই কেউ ১৫-২০ বছর পর সাংসদ, সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রদূত হবে।
একটি ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই, তা হলো যদি কোনো ‘নেতা’ আজ যমুনা সেতু গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেন—এক কোটি লোক একদিনের মধ্যে ওখানে জড়ো হবে। কোমর পড়ে যাওয়া বুড়োও ওখানে গিয়ে হাজির হবে। কেউ যাবে শুধু ইট ও লোহাগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে। পুরো সেতু ভাঙতে সাতদিনের বেশি লাগবে না।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেই ৩৭ বছর বয়স্ক অনেক বক্তাকে আজকাল মঞ্চে পদাঘাত করতে দেখি। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা শুধু আমরা পাইনি। ভিয়েতনামিরা ৩০ বছর যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্যবাদী জাপান, ফ্রান্স ও আমেরিকার বিরুদ্ধে। ৩০ লাখ তিন হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে ১৯৭৫-এ যেদিন ভিয়েতনাম স্বাধীন হয় সেদিন রয়টারের পাঠানো একটি খবর আমি যত্নে রেখে দিই। সায়গন বা হোচি মিন নগরের রাস্তায় আমেরিকানদের ব্যবহূত বিলাস সামগ্রী স্তূপীকৃত করে রাখা হয়। কোনো ভিয়েতনামি তা ছুঁয়েও দেখেনি। অবশ্য পরে আমেরিকানদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে ভিয়েতনাম। তারা বাস্তববাদী। এবং দেশপ্রেম তাদের আমাদের চেয়ে একচুল হলেও বেশি। তবে কথা ও বক্তৃতায় তারা আমাদের সঙ্গে পারবে না।
স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কত প্রাণ গেল। কিন্তু বাঙালির ভেতর থেকে অপহরণস্পৃহা ও গুণ্ডামির প্রবণতা গেল না। দখল মানে বুক ফুলিয়ে অপহরণ করা। ৩০টি বেলি বা গাঁদাফুলের গাছ নয়, সমুদ্রসৈকতের ৩০ হাজার ঝাউগাছ অলৌকিভাবে উধাও হয়ে গেছে। গাছ তো নিয়ে গেছেই গেছে, এখন গাছের মুথা তুলতে কামলা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম আলোর গাছ নিধন ছবির শিরোনামে বলা হয়েছে: একসময়ের ঘন বন এখন বিরানভূমি।
একদিন বাংলাদেশই বিরান হয়ে যাবে। যারা বিরান করবে তাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে আমেরিকায়। ওখানে রাস্তার গাড়ি মুছলেও ডলার কামাই করা যায়। ঝাউগাছ নয়, খাস জমিগুলোও দখল হয়ে গেছে। অর্পিত সম্পত্তি নামে এক সোনার খনি আছে, তা দখল হচ্ছে। সরকারি রাস্তার ইটগুলো চলে যাচ্ছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীর বাড়িতে। নদীর তীরগুলোর পানি নামারও অবসর পাচ্ছে না, সেখানে উঠছে দালালকোঠা। নদীর বালু চুরি হচ্ছে দিনদুপুরে। কার সাধ্য বাধা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমিতে যার খুশি তুলছে ঘর। টেন্ডারের বাক্সগুলো জাদুর বাক্সের মতো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। নিজে টেন্ডার পাবে না তাই টেন্ডার বাক্সে দরপত্রে পানি ঢেলে দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সড়কের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে হাজারও মানুষের সামনে। বনভূমি তো বনবিভাগের কর্তাদের পৈর্তৃক সম্পত্তি। আদিবাসীদের জমি দখলে কোনো ঝুঁকি নেই। পার্বত্য এলাকার বিস্তীর্ণ বনবাদাড় দেখে বাঙালি মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা ও বড়-মাঝারি-ছোট নেতার মাথা ঠিক থাকতেই পারে না।
দখল-বাণিজ্য ও দিনবদল নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। অল্প জায়গায় আট মাসের অত কথা বলার সুযোগ আমাকে সম্পাদক দেবেন না। তাই পুরোনো দিনের কিছু ঐতিহাসিক দখল-অপহরণের গল্প বলে দুধের কাজ মাঠায় মিটিয়ে দিলাম।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments