সরকার গঠনই শেষ কথা by মাহবুব হাসান ও হাবিবুর রহমান খান
বিএনপি
এবং জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং সরকারের উন্নয়ন পদক্ষেপে
ভর করে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও সহিংস আন্দোলনের দুঃসহ স্মৃতি
সামনে এনে জনগণের মন জয় করতে চায় দলটি। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন থেকে
শুরু করে দেশ ও জাতি গঠনে দলটির ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বার্তাই দিতে
চাইবে যে, এসব বিবেচনায় উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পুনরায় সরকার গঠনে আওয়ামী
লীগ দাবি রাখে। এ উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় মাঠে নামছে দলটি।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে বিএনপির দুর্নীতির
আমলনামা ও সরকারের উন্নয়ন প্রচারণাকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে নির্ধারণ করা
হয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন,
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার এ পলিসি গ্রহণের
সিদ্ধান্ত সঠিক। যে কোনো দল এটিই করবে। তারা জনগণের কাছে নিজেদের সাফল্য
তুলে ধরার পাশাপাশি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে চাইবে।
তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিও
একই পথে হাঁটবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দুই মেয়াদের শাসনকালের ইমেজ যদি ক্লিন
হয়ে থাকে তাহলে বিএনপি বেশিদূর এগোতে পারবে না। কিন্তু ভোটের আগে জনগণের
সামনে যদি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি কিংবা
ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির হাজির করতে পারে, তাহলে সরকারি দলকে কিছুটা বেগ
পেতে হবে। এ ছাড়া সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল- সরকার যেভাবে
সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে চায়, শেষমেশ যদি সেভাবে না পারে
সে ক্ষেত্রে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসবে। বিশেষ করে তফসিল ঘোষণার
পর মাঠে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে বা করতে হবে। তাই সে সময়গুলোয়
ভোটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারবে।
তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি সে রকম হলে দুই প্রধান দল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু
নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারে। সূত্র জানায়,
ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ড থেকে ইতিমধ্যে নেতাকর্মীদের জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে এ
সরকারের আমলে কি কি কাজ হয়েছে তা তুলে ধরতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমানের বিদেশে সম্পদ
থাকার তথ্য, খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলা, কালো টাকা সাদা করা, তারেক
রহমানের মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় সাজা পাওয়াসহ এ ধরনের অন্য বিষয়গুলো
জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা মনে করছে,
জনগণকে এ দুটি বিষয় সঠিকভাবে বোঝাতে পারলে তারা আগামী নির্বাচনে বিপুল ভোটে
আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারে এসে শান্তি প্রতিষ্ঠা
করেছে। দেশকে নিন্মমধ্যম আয়ের দেশে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। দেশব্যাপী
ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের আয় বেড়েছে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান
বেড়েছে। তাই তাদের বিশ্বাস মানুষ আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে। আওয়ামী লীগের
প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘নির্বাচনের
জন্য সবার কিছু কৌশল এবং প্রস্তুতি থাকে। আওয়ামী লীগ যেসব ওয়াদা দিয়ে
জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করেছিল তার অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে,
বাকিগুলোও পূরণের পথে। এই কয়েক বছরে দেশ উন্নয়নের পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের বিদ্যুতের
সমস্যার সমাধান এ সরকারই করেছে। নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো মেগা
প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পথে।’ তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে বিএনপির আমলে হাওয়া ভবন
তৈরি করে কমিশন খাওয়া হতো, লুটপাট চলত। নিজেরা দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা
বানিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। আমরা মানুষের সামনে এই বিষয়গুলো তুলে ধরব। আমার
বিশ্বাস, বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ এই অপশক্তিকে আর ভোট দেবে না, বরং
আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে আবারও সরকার গঠনের সুযোগ দেবে।’ আওয়ামী
লীগ সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে প্রচারণার কৌশল নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা শুরু
করেছেন সংশ্লিষ্টরা। দলের গত শনিবারের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও এ বিষয়টি নিয়ে
কথা হয়েছে। দলের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের
বিভাগওয়ারি দায়িত্ব নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়নের
প্রচার ঘরে ঘরে পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া জিয়া পরিবারের সব অপকর্ম
জনগণের সামনে তুলে ধরতে বলেছেন। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ১৫টি টিম গঠন করা
হয়েছে। জানুয়ারিতে একেকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের নেতৃত্বে এ টিমগুলো
দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর করবে। এসব সফরে সমাবেশ, বর্ধিত সভা, উঠান বৈঠক,
পথসভায় দেশের জন্য আওয়ামী লীগের অবদান বিপরীতে বিএনপির ক্ষতিকর দিকগুলো
তুলে ধরা হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাংগঠনিক সফর
দিয়ে শুরু করে নির্বাচনের এ বছরে পুরোটা সময় মাঠে থাকবেন তারা। বছরের প্রথম
তিন মাস থাকবে মূলত দিবসভিত্তিক কর্মসূচি। ৫ জানুয়ারি সরকারের চার বছর
পূর্তি, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, ফেব্রুয়ারিতে
শহীদ দিবস, মার্চে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ দিবস, তার জন্মদিন,
স্বাধীনতা দিবসসহ নানা কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশের
রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে উপস্থিত থাকবে দলটি। চলতে থাকবে
জনসংযোগ। উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির লুটপাট, দুর্নীতি,
জিয়া পরিবারের সম্পদের তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। এভাবে চলবে আগামী
আগস্ট পর্যন্ত। আর এরপর তো আনুষ্ঠানিকভাবেই শুরু হবে নির্বাচনী প্রচারণা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন,
জাতীয় নির্বাচন একটি রাজনৈতিক দলের পরীক্ষা। এর জন্য নানা গ্রাউন্ডওয়ার্ক
করতে হয়। আমরা সেগুলো শুরু করেছি। জানুয়ারি থেকেই সাংগঠনিক সফর শুরু হচ্ছে।
সাংগঠনিক কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা প্রচারণা জোরদার করব, যা চলবে আগামী
নির্বাচন পর্যন্ত। মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে
বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন করে, মর্যাদা বাড়ায়;
বিপরীতে বিএনপি নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যস্ত থাকে, দেশকে ভিক্ষুদের জাতি
হিসেবে উপস্থাপন করে। আমরা জনগণের সামনে তুলনামূলক সেই চিত্রগুলোই তুলে
ধরব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এ দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন
হয়েছে। দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এ সরকারের আমলে জনগণের আয় এবং
জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। বিপরীতে বিএনপির সময় ছিল হাহাকার। বিদ্যুৎ আর সার
চাইতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের গুলি খেয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। জঙ্গিবাদ
আর সন্ত্রাসে জনজীবন ছিল অস্থির, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল দেশ।
তাছাড়া খালেদা জিয়া নিজে দুর্নীতি করেছেন। তার বড় ছেলে মানি লন্ডারিংয়ে
সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোও একই দোষে দুষ্ট
ছিলেন। আর এ সরকারের আমলে তারা আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা ও আগুন নিয়ে
নাগরিকদের পুড়িয়ে মেরেছেন। সহিংসতা, অরাজকতা ও নাশকতা করে জনগণের জীবন করে
তুলেছিলেন অস্থির। তাই আমি মনে করি, এ দেশের মানুষ আর কখনও বিএনপিকে ভোট
দেবে না। আওয়ামী লীগেরও ভুলত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু দেশের উন্নয়নে আমরা
কাজ করি সেটা প্রমাণিত। আর এ কারণেই আগামী নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে
বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।
No comments