সব্যসাচীর নামে বিশ্ববিদ্যালয় চাই
তার
সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে এমন কোনো জন্মদিন ছিল না, যেদিন কথা বা ক্ষুদে
বার্তা বিনিময় হয়নি। জন্মদিনে তার ফোন খুবই ব্যস্ত থাকত, সেটি বলার অপেক্ষা
রাখে না। তিন বছর আগে তার জন্মদিনে সকালবেলা ফোন ব্যস্ত পাওয়ায় কথা বলতে
না পেরে রাত ১০টার পর ফোন দিয়েছিলাম। তিনি সালাম গ্রহণের আগেই অনুযোগ করে
বললেন, ‘তোমার এখন সময় হল, আর কিছুক্ষণ পরেই তো ২৮ তারিখ।’ সেদিন বুঝেছি
কুড়িগ্রাম থেকে পাঠানো শুভেচ্ছা তার কাছে অন্যকিছু ছিল। জন্মদিনে মুঠোফোনে
যতবার ক্ষুদেবার্তা দিয়েছি, তিনি তার জবাব দিতেন। তিনি বলতেন, বিশেষ দিনে
যত শুভেচ্ছাই পাই, মন ভরে না; তোমরা যখন শুভেচ্ছা পাঠাও তখন মন ভরে যায়।
বলতেন, জন্মস্থান থেকে পাঠানো শুভেচ্ছা ‘মায়ের হাতের পায়েস-পিঠার মতন।’
তিনি নেই, তার জন্মদিনে আর কখনই তার হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে পারব
না। পথের দূরত্বের কারণে আমরা ভাগ্যহত ছিলাম। আজ সেই তিনি আমাদের ভাগ্যের
বরপুত্র হিসেবে কুড়িগ্রামেই অবস্থান নিয়েছেন চিরকালের জন্য। গত এক বছরে
হাজারও মানুষ তার কবরের কাছে এসে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছেন। যারা একবার
কুড়িগ্রাম আসেন তারা চেষ্টা করেন অন্তত তার সমাধি দেখার। এরই মধ্যে তার
কবরটি ঐতিহাসিক স্থাপনার মর্যাদা পাচ্ছে। কাঁচা কবরের কঞ্চির পাশেই
শ্রদ্ধার্ঘ্য রেখে যায় হাজারও পথিক। তার জন্মদিনে ফুল নিয়ে যাই। কবরে ফুল
দেই, কিন্তু একটা বড় অতৃপ্তি থেকে যায় মনে, যা কোনোদিনই আর পূরণ হবে না। সৈয়দ
শামসুল হকের ছিল জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম টান। তিনি লিখে ও বলেই শুধু
কুড়িগ্রামকে তুলে ধরেননি; উপরন্তু কুড়িগ্রামের মাটিতে অন্তিম শয্যা নিয়ে
কুড়িগ্রামকে আরও মূল্যবান ও মহিমান্বিত করে তুলেছেন। অনেকেই অনুযোগ করেন,
কুড়িগ্রামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। শৈশবে কুড়িগ্রাম ছেড়ে আসা সৈয়দ
শামসুল হকের সঙ্গে কুড়িগ্রামের শারীরিক যোগাযোগ অবশ্যই শিথিল ছিল। পেশাগত
কারণে তিনি কখনও ঢাকা শহরে কখনও দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন। শৈশবে বাড়ি
থেকে পালিয়ে যাওয়া কিশোর জীবনের গল্প শুনে আমরা অনেকেই তাকে বাউন্ডুলে বলে
মনে করি, আসলে তা তিনি ছিলেন না। তার বাবার অবর্তমানে পরিবারের প্রতি
দায়িত্ব পালন সে ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। মাত্র আঠারো বছর বয়সে পিতা
সিদ্দিক হোসেইনের মহাপ্রয়াণে পরিবারের সব দায় তার কাঁধেই চেপে বসে। নিজের
শিক্ষা এবং পরিবারে ছোট ছোট ভাই-বোনের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহে নিরন্তর
সংগ্রাম তাকেই করতে হয়েছে। ভাই-বোনদের শিক্ষা, বিয়েশাদি দেয়ার মতো কাজগুলো
তাকে কঠিন কর্তব্যমুখী করেছিল। তিনি পরিবারে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সফল
ভূমিকা রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্য তার স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকও একটা
পর্যায়ে অনন্য অবদান রাখেন। তিনি শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা ও পারিবারের প্রতি
কর্তব্যমুখী অবস্থানের কারণেই ইচ্ছে থাকার পরও কুড়িগ্রামের সঙ্গে নিয়মিত
শারীরিক যোগাযোগ রাখতে পারেননি। কুড়িগ্রাম-রংপুরে নিয়মিত আসতে না পারলেও
কুড়িগ্রাম-রংপুর তার চিন্তায় ও মননে শিখা অনির্বাণের মতোই জাগ্রত ছিল।
তিনি
পিতার অবর্তমানে ঘোর সংকটে সংসারের হাল ধরলেও সাহিত্যচর্চা থেকে বিরত
থাকেননি। সাহিত্য তার ধ্যান ও জ্ঞান ছিল। তিনি যা লিখেছেন তার
উচ্চমার্গীয়তা নিয়ে তার প্রবল সমালোচকরাও কোনো সন্দেহ করেন না। সৈয়দ শামসুল
হকের সৃষ্ট সাহিত্য শুধু তাকেই প্রতিষ্ঠা দেয়নি, বরং বলতে পারি এ জনপদের
ধূলিমাখা ‘মুই তুই’ শব্দগুলোকে সাহিত্যে প্রয়োগ করে আমাদের ভাষাকেও
আন্তর্জাতিকতা দিয়েছেন তিনি। একদা যারা এ ভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করতেন,
তাদের কণ্ঠেও তিনি স্লোগান তুলে দিয়েছেন। পাহাড় থেকে সমতল সবখানে পিছিয়ে
পড়া মানুষের এগিয়ে আসার স্লোগানই হচ্ছে ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’। প্রত্যেক
মানুষ প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও একটা
রাজনৈতিক দর্শন কিন্তু তাকে অবশ্যই প্রভাবিত করে। সৈয়দ শামসুল হক কোনো
রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তিনি রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও একজন
রাজনীতিকের চেয়েও তার দর্শন-দায় অনেক বেশি ছিল। হাতে ব্রেসলেট পরা জিনসের
ভারি পোশাকে দেহাবৃত স্টাইলিশ সৈয়দ শামসুল হকের ভেতরে ছিল প্রবল বাঙালি মন।
কবি মানেই ধুতি কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি, একটু উসকোখুসকো চুল, উদাসী তাকানো-
এই সেকেলেপনাগুলোকেও তিনি ভেঙেছেন। তার জীবনাচার আধুনিকতায় ভরা,
পাশ্চাত্যের অনেক কিছুর সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও তিনি চিন্তা ও মননে প্রকৃতই
বাঙালি ছিলেন। যে কারণে তার বিশ্বাস ও দর্শনগত অবস্থানের প্রতিফলন তার
লেখায় প্রবলভাবে দেখতে পাই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি
বিপদবিনাশী হয়ে উঠেছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেয়ার প্রবল ষড়যন্ত্র
চলছিল, যখন অনেকেই রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবীর খাতায় নাম
লিখে সফেদ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, তখন ছাত্র-জনতার কণ্ঠে নানা পঙ্ক্তি
তুলে দিয়ে তিনি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পথকে প্রশস্ত করেছিলেন। তার
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কিংবা ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ স্বাধীনতাবিরোধী
সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সামরিক স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে তার অবস্থানকে পরিষ্কার
করেছে। এই অবস্থান ছিল তার দর্শনগত যাকে আমরা আদর্শও বলতে পারি। ‘পায়ের
আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর প্রথম মঞ্চায়ন হয়। তখন
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন আমাদের জাতির জীবনে অক্টোপাসের মতো চেপে
বসেছিল। সে সময় এ নাটক মঞ্চায়ন ছিল এক সাহসী ঘটনা। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও
নাটকটি জাতীয়ভাবে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু ও
বাংলাদেশকে নিয়ে তার লেখাগুলোকে বিবেচনায় নিলে সে সত্যের পরিচয় মেলে। তিনি
তার লেখায় একটা সাম্যের সমাজ প্রত্যাশা করতেন। যারা এর জন্য লড়তেন তাদের
প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার নানা লেখায় সাম্যের স্বপ্ন উঠে এসেছে।
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর লেখা ‘কমরেড ফরহাদ : একটি শোকগাথা’
কিংবা ‘শেষ শয্যায় শায়িত কমরেড মণি সিংহকে দেখে’, অথবা ‘আমার শহর- প্রথম
বসতি’ কবিতাগুলো পড়লে তার সাম্য সমাজ তথা মানবমুক্তির ব্যাপক আকাক্সক্ষার
প্রকাশ দেখা যায়। তিনি ক্ষান্ত দেয়া বিপ্লবীদের সমালোচনায় ছাড় দেননি। তাদের
তিনি বলেছেন, ‘মাঝরাতে বাঁশি দেবে গাড়ি, বিধ্বস্ত ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট
চেপে আবার কিশোর কোনো রাস্তায় দাঁড়াবে, প্রাক্তন বিপ্লবী নেতা চাকরি নেবেন’
(বৈশাখের পঙ্তিমালা)।
সৈয়দ শামসুল হক যে কোনো কবি-সাহিত্যিকের চেয়ে
মাঠে-ময়দানে বেশি দৌড়েছেন। ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে সমগ্র দেশ চষে বেড়িয়েছেন।
তারুণ্যকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করতে তার অশেষ অবদান রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গঠিত গণআদালতে তিনি একজন
সাক্ষী ছিলেন। লেখা ও কর্মের কারণেই তিনি মৌলবাদের টার্গেট ছিলেন। সৈয়দ হক
আজ শারীরিকভাবে নেই; কিন্তু তাকে ঘিরে শত্রুতার অবমুক্তি হয়নি। কর্ম যখন
আদর্শনির্ভর হয় তখন মৃত্যুই শত্রুতার অবসান ঘটায় না। কর্ম যতদিন প্রাসঙ্গিক
থাকবে ততদিন প্রতিপক্ষের শত্রুতাও বিদ্যমান থাকবে। সৈয়দ শামসুল হক
নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন ছিলেন না। নিরপেক্ষতার ভানও করেননি। তিনি একটি পক্ষকে
লালন করেছেন, প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ফলে তার শত্রু ছিল এবং তারা এখনও
ক্রিয়াশীল। এই ক্রীয়াশীল প্রতিপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে গিলে খেতে
সচেষ্ট। এদের পরাজিত করতে না পারলে আমাদের রাষ্ট্রের বিপর্যয় হতে বাধ্য।
নিশ্চয়ই যারা রাষ্ট্র বিনির্মাণের কাজ করেন, বিশ্বাস করি তাদের ভাবনায়
এগুলো আছে। ১৯৫৩ সালে লিখেছিলেন তিনি ‘বুনো বৃষ্টির গান’, যেখানে বলেছেন-
‘বৃষ্টি এসে ভেজায় যখন নাগেশ্বরীর মাঠ’। কুড়িগ্রামের প্রতি তার টান ছিল
অবিশ্বাস্য রকমের, যা বারবার তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ‘বাড়ি ফেরা’
নামক কবিতায় লিখেছেন- ‘বাড়ি তো সকলেরই আছে, সকলেই বুকের মধ্যে বাড়ি রাখে
... বাড়ি তো তাকেই বলে যাত্রার শুরু যেখানে ... আর প্রতিবার অস্ত্র
ব্যবহারের পর যেখানে ফিরে যাওয়া সেটাই তো আমার বাড়ি’। ২০১৬ সালের ২৭
সেপ্টেম্বর সৈয়দ শামসুল হক তার বাড়ি কুড়িগ্রামে ফিরেছেন। সৈয়দ শামসুল হক
রবীন্দ্রনাথে আস্থাশীল ছিলেন। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতো জন্মভূমির আঁচলেই
বিশ্বকে দেখতেন। আর দেখতেন বলেই সমগ্র দেশকে ভালোবাসলেও নিজ বাড়ি
(কুড়িগ্রাম) ফিরেছেন। যেখান থেকে দেশ ও বিশ্বকে দেখতে পাবেন বলেই শেষ শয্যা
নিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক যেখানে শায়িত হয়েছেন সেটি তার প্রত্যাশিত স্থান
ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়েছেন। কোনো কবির
মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের শোকবাণী থাকলেও মৃত লেখককে
নিয়ে পৃথক রচনা দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৈয়দ শামসুল হককে
নিয়ে ‘স্মৃতি অমলিন’ শীর্ষক একটি লেখা ‘ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবো’-
স্মরণগ্রন্থে লিখেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণ ঘটলেও
চিরজীবিতের মতো তার অনুপম সাহিত্যকর্ম জাতিকে সবসময় সঠিক দিকনির্দেশনা
দিয়ে যাবে- এটা আমার স্থির বিশ্বাস।’ তাকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধুর
জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের স্বপ্নের কথাও তিনি
জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে
সেজন্য কৃতজ্ঞ। সংস্কৃতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রাষ্ট্র
সমাধিসৌধসহ তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন সেগুলোর দ্রুত
বাস্তবায়ন আশা করি। আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আওয়ামী লীগের
সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তরবঙ্গের কৃতী সন্তান বিশিষ্ট সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ
চৌধুরী কবির মৃত্যুর পর প্রথম ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, কুড়িগ্রামের
জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ যেন ‘সৈয়দ
শামসুল হক বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে হয়। সেটি দেশবাসীরও আশা। বিশ্বাস করি মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই প্রত্যাশার বিশ্ববিদ্যালয়টি তার নামেই দ্রুত ঘোষণা
দেবেন।
এসএম আব্রাহাম লিংকন : আইনজীবী, লেখক ও সাবেক রাকসু নেতা
এসএম আব্রাহাম লিংকন : আইনজীবী, লেখক ও সাবেক রাকসু নেতা
No comments