রাতভর ঘুষের দেনদরবার শেষে মামলা
রাজধানীর
বনানীতে র্যাবের কথিত এক সোর্সকে গ্রেফতার নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুল কাণ্ড
ঘটেছে। র্যাব-১ এর সোর্স হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী বিল্লাল
ওরফে মদ বিল্লালকে রোববার মধ্যরাতে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের
গোয়েন্দা টিম। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে এ খবর গোপন রেখে
রাতভর ঘুষের দেনদরবার চলে। তবে ঘটনা বেশিক্ষণ গোপন থাকেনি। শেষরাতের দিকে
বিল্লালকে গ্রেফতারের ঘটনা জানাজানি হলে বনানী থানায় মামলা করা হয়। এদিকে
ঘটনার আদ্যোপান্ত অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, র্যাবের সোর্স বলে পরিচিত
বিল্লাল নিজেও একজন প্রথম সারির চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তবে ব্যবসায়িক
দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ আরেক মাদক ব্যবসায়ী তাকে স্থায়ীভাবে জেলে আটকে রাখতে
ফন্দি আঁটে। আর ৫ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে সে ফাঁদে পা দেন মাদকদ্রব্য
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা টিমের পরিদর্শক মনিরুজ্জামান। যেই কথা সেই
কাজ। সাজানো অভিযানের দিনক্ষণ ছিল রোববার মধ্যরাত।
স্থান গুলশান ১০৮নং রোড।
কথা ছিল বিল্লালকে একটি প্রাইভেট কারসহ আটক করার সময় তার কাছ থেকে জব্দ
দেখানো হবে, ৭৬ বোতল বিদেশি মদ, ১০৫ ক্যান বিয়ার, ২ হাজার ৩০ পিস ইয়াবা ও
৩৬০ পুরিয়া হেরোইন। কিন্তু বাস্তবে সে সময় তার কাছে এসবের কিছুই ছিল না।
গুলশান থেকে আটকের পর বিল্লালকে বনানীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকেই
প্রাইভেট কারটিতে তোলা হয় উল্লেখিত মদ, বিয়ার, হেরোইন ও ইয়াবা। সেখান থেকে
তাকে নেয়া হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা কার্যালয়ে। নানা
নাটকীয়তা শুরু : রোববার সন্ধ্যার দিকে বিল্লালকে গ্রেফতার করা হলেও বিষয়টি
গোপন রাখা হয়। কিন্তু রাত ৮টার দিকে খবর পেয়ে যান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদফতরের সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা। তিনি জানতে পারেন বিল্লালের
বিরুদ্ধে হেরোইন ও ইয়াবার মামলা দেয়া হচ্ছে। এ কারণে তিনি ফোন করেন
পরিদর্শক মনিরুজ্জামানের কাছে। কৈফিয়ত তলব করে তিনি বিল্লালকে আটকের কারণ
জানতে চান। এরপর বলেন, ‘ও আমার এলাকার ছেলে জানো না? তাছাড়া আমারেও তো কয়টা
পয়সা দেয়। ওরে ধরা তোমার ঠিক হয়নি। এরপর বলেন, ‘ঠিক আছে, ধরছো যখন হেরোইন,
ইয়াবার মামলা দিও না।’ ফরেন লিকারের (বিদেশি মদ) মামলা দিয়া ছাইড়া দিও।’
মুঠোফোনে কথা শেষ না হতেই মাদকের আর এক কর্মকর্তার ফোন আসে। কিন্তু এবার ওই
কর্মকর্তার নির্দেশ ছিল পুরো উল্টো। তিনি বলেন, ‘যা যা পাইছ সব দিয়া শক্ত
মামলা দিবা। যেন ... ছাড়া না পায়। কমপক্ষে ১০ বছর ওরে ভিতরে রাখতে হবে।’
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এবার বড় ঘুষের অফারও আসে। বিল্লালের লোকজন
ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামানের কাছে একের পর এক ফোন করতে শুরু করেন। তারা বলতে
থাকেন- ‘স্যার কত লাগবে কন, দিমু। ছাইড়া দেন। খামোখা মামলা দিয়েন না। সবাই
মাসোয়ারা নেয়। আমনে কেন বিল্লালরে ধরতে গেলেন বুঝতাছি না।’ এসব ফোন পেয়ে
বিল্লালকে ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। খবর পেয়ে বিল্লালের প্রতিপক্ষেরও
ফোন আসা শুরু হয়। তারা বলেন, ‘স্যার বিল্লালকে ছাইড়েন না। ৫ লাখ দিসি, লাগে
আরও ১০ দিমু। বিল্লাল ছাড়া পাইলে র্যাব দিয়া আমগো ক্রসফায়ার দিব।’ এই যখন
পরিস্থিতি তখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক মনিরুজ্জমানের
শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। কার কথা রাখবেন। এর মধ্যে মাথায় আকাশ ভেঙে
পড়ার মতোই মধ্যরাতে ফোন আসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা
ইউনিটের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকদারের। তিনি অভিযানের পুরো ঘটনা
জানতে চান। জবাবে সবকিছু বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন মনিরুজ্জামান।
কিন্তু নজরুল ইসলাম আদ্যোপান্ত অবহিত হয়েই দ্বিতীয় দফা ফোন দিলে জেরার মুখে
কিছুটা মুখ খোলেন অভিযান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এজাহারে তথ্য গোপন :
বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা দেনদরবার শেষে রোববার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে
বনানী থানায় মামলা করা হয়। মামলা নং-২৮। কিন্তু এজাহারে ইয়াবা, হেরোইনের
কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে মাত্র ৫০ বোতল
মদ ও ৭২ ক্যান বিয়ার। তবে বিতর্কিত এ অভিযানের অনেকটাই উচ্চ পর্যায়ের
কর্মকর্তারা জেনে যাওয়ায় মামলা করার পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে পরিত্যক্ত
অবস্থায় ১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে মর্মে জিডি এন্ট্রি করা হয়। বনানী
থানায় মামলা হলেও ইয়াবা উদ্ধারের জিডি হয় গুলশান থানায়। আলোচিত এ মামলার
বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদকে
জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এই অভিযানের বিষয়ে আমি অবহিত নই। তবে যদি কেউ
সাজানো মামলা দায়ের করে বা অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার আগেই নিজেই অপরাধ
সংঘটিত করে তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অবশ্যই তদন্তের আওতায় আসবেন।’ এক
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিব।
এরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সূত্র জানায়, রাজধানীর বনানীতে দীর্ঘ
২০ বছরের বেশি সময় ধরে আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি মদ-বিয়ারের রমরমা ব্যবসা
চলছে।
অবৈধ এ ব্যবসা করে ফুটপাতের কয়েকজন হকার এখন রীতিমতো কোটিপতি।
বনানীকেন্দ্রিক অবৈধ মদ-বিয়ারের ব্যবসা বন্ধ করতে গত দু’বছর ধরে তৎপরতা
চালাচ্ছে র্যাব। বিশেষ করে র্যাব-১ ও র্যাব-২ এর কয়েকটি দল অবৈধ এ মদের
ব্যবসার মূলোৎপাটনে তৎপর। ফলে র্যাব আতঙ্কে রয়েছেন বনানীর মাদক
ব্যবসায়ীরা। অনেকটা শর্ষের মধ্যে ভূত থাকার মতোই এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে
র্যাবের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। অভিযান হলে ‘র্যাবের হাত থেকে বাঁচানোর’
প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা আদায় করতে শুরু করেন তারা।
এক্ষেত্রে বিল্লালের সঙ্গে র্যাব-১ এর এসআই রেজার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশান এলাকার একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, এসআই রেজার
সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে বিল্লাল সম্প্রতি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেই
বনানী এলাকার বিভিন্ন লোকজনকে ফোন করে র্যাবের নামে চাঁদা তোলেন। সূত্র
বলছে, এতদিন র্যাবের কথিত পেমেন্ট বিল্লালের মাধ্যমেই রেজার হাতে পৌঁছে
যেত। কিন্তু সম্প্রতি একটি ঘটনার পর বিল্লালের ‘বাড়-বাড়ন্ত’ শুরু হয়। গত
মাসে বনানীর মদ ব্যবসায়ী কবির গাজীকে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ৫ লাখ টাকা
আদায় করেন এসআই রেজা। উত্তরা আজমপুর এলাকার একটি মার্কেটে এ টাকা লেনদেন
হয়। এরপর সম্প্রতি আরেক মদ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার না করে তার কাছেও ১ কোটি
টাকা চাঁদা চাওয়া হয়। ওই টাকা লেনদেনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিল্লাল
নারকোটিক্সের হাতে গ্রেফতার হন। কথিত সোর্সের মাধ্যমে অসাধু র্যাব
কর্মকর্তার টাকা আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও
গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সোমবার যুগান্তরকে বলেন,
র্যাবের পেশাদারিত্বের সুনাম রয়েছে। এই সুনামের ওপর যদি কেউ কলঙ্ক লেপনের
চেষ্টা করে তবে তিনি সোর্স বা অন্য কোনো বাহিনীর কর্মকর্তা হলেও তাকে ছাড়া
হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তবে অনেক সময় সোর্স পরিচয়ে পেশাদার
অপরাধীরাও নানাভাবে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করে। এ ধরনের
অনেক অপরাধীকে এর আগে গ্রেফতারও করেছে র্যাব।’
No comments