কাজ না করেই টাকা পকেটে
ঝিনাইদহ
সদর উপজেলার পদ্মকর ইউনিয়নের গোপীনাথপুরের একটি সড়ক সংস্কার প্রকল্পের
শ্রমিক ছিলেন তাকের আলী। কত দিনে, কী কাজ করলেন—জানতে চাইলে গোবিন্দপুর
গ্রামের এই বাসিন্দা বললেন, রাস্তাটিতে মোট ১৭-১৮ দিন মাটি ভরাটের কাজ
হয়েছে। পাশের জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তায় ফেলা হয়। তিনিসহ ১৫-১৬ জন এ কাজ
করেছেন। একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৩০০-৪০০ টাকা। তাকের আলীর হিসাব ধরলেও এই
প্রকল্পে সোয়া লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়নি। অথচ কাবিটার (কাজের বিনিময়ে টাকা)
এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৪১ টাকা। ঝিনাইদহের পাঁচটি ইউনিয়নে
এ রকম ৬৪টি প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। প্রায় সব
প্রকল্পেই বরাদ্দের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। এর একটি ইউনিয়নে ১৬টি
প্রকল্পের একটিতেও কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হয়। বাকিগুলোতে নামমাত্র
কাজ করে প্রকল্প সম্পন্ন দেখানো হয়েছে। এলাকাবাসী বলেছেন, জনগণের স্বার্থে
এসব প্রকল্পে বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
কিন্তু সেই বরাদ্দ জনগণের কাজে আসেনি।
মূলত প্রকল্পগুলো ছিল সরকারি টাকা আত্মসাতের হাতিয়ার। বেশির ভাগ প্রকল্পের
সভাপতি ছিলেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। কয়েকটি প্রকল্পে
সভাপতি করা হয় তাঁদের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের। প্রকল্প সভাপতিরা
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে
এলাকাবাসী কিছু বলার সাহস পান না। জানতে চাইলে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা প্রকল্প
বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শুভাগত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখানে
নতুন যোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তাঁর জানা নেই। সদর উপজেলা
পিআইওর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসে ঝিনাইদহ সদরের পাঁচটি
ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) প্রকল্পের নামে বিশেষ বরাদ্দ
দেওয়া হয়। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পাঁচটি
চিঠিতে এই বরাদ্দের কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে জেলার কালীগঞ্জ, শৈলকুপা ও
হরিণাকুণ্ডু উপজেলারও কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। সবই ছিল মাটির কাজ। সদর
উপজেলার হরিশংকরপুর, পদ্মকর, ঘোড়শাল, ফুরসন্ধী ও নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৬৪টি
প্রকল্পের মধ্যে ১২টি ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় মাটির কাজ। বাকি
৫২টিই রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ। ৬৪ প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৬৯ লাখ
৪১ হাজার ৬৮৫ টাকা। কাজ শেষ করার সময়সীমা ছিল চলতি বছরের ৩০ জুন।
নিয়মানুযায়ী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দপত্র পাওয়ার পর
স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করবে। এরপর
একটি প্রকল্প কমিটি জমা হবে। তারপর কিছু টাকা সেই কমিটিকে দেওয়া হবে। এই
টাকা হাতে পাওয়ার পর কমিটি কাজ শুরু করবে। কিছুটা কাজ করার পর দ্বিতীয়
কিস্তির টাকা পাবে। কাজ শেষে দেওয়া হবে বাকি টাকা।
কাজই হয়নি হরিশংকরপুরে
হরিশংকরপুর ইউনিয়নে ১৬টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৬১ হাজার ৪৫২ টাকা। এই ইউনিয়নের ছয়টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তাগুলোতে কোনো মাটির কাজই হয়নি। পানামী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনজুর আহম্মদ বলেন, তাঁর বাড়ি আর্য্য-নারায়ণপুরে। ওই গ্রামে রয়েছে দুটি প্রকল্প। প্রকল্প দুটি হলো ‘আর্য্য-নারায়ণপুর বটগাছ হইতে কাঁচার শেষ মাথা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও আর্য্য-নারায়ণপুর বটগাছ হইতে নারায়ণপুর ঈদগাহ হয়ে নদী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’। এ দুটি রাস্তায় বরাদ্দ রয়েছে ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৬ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু এ দুটি রাস্তায় সম্প্রতি কোনো মাটির কাজ হয়নি। আনুমানিক দুই বছর আগে সামান্য কিছু মাটির কাজ হয়েছিল। এখন এই রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী। হুদা-বাকড়ি ভাগাড় থেকে খালের ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তায় মাটির কাজের জন্য দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ হয় ২২ লাখ ২৫ হাজার ৮২৪ দশমিক ৮০ টাকা। ওই এলাকার বাসিন্দা বাবলুর রহমান বলেন, গত এক বছরে এই রাস্তায় এক ঝুড়ি মাটিও পড়েনি। রাস্তার পাশেই রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নবের আলী শেখদের পারিবারিক কবরস্থান। নবের আলীও বলেন, এই রাস্তার কোনো কাজই হয়নি। তবে পাঁচ-ছয় বছর আগে একবার সামান্য কিছু কাজ হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, একটি টাকার কাজও হয়নি এই রাস্তাটিতে। এলাকার মানুষ কষ্ট করে ফসল ঘরে তুলছেন। এই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য খন্দকার ইমামুল হোসেন বলেন, ওই দুই রাস্তায় ২২ লাখ টাকার বরাদ্দ হলেও ২২ টাকারও কাজ হয়নি। পরানপুর বিল্লালের বাড়ি থেকে পূর্ব বিলের মালেকের জমির কাছাকাছি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও পরানপুর শওকতের বাড়ির ব্রিজ থেকে মাঠের রফির জমি পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ২২ লাখ ২৫ হাজার ৮২৪ টাকা ৮০ পয়সা। এই গ্রামের বাসিন্দা ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ মোল্লা জানান, দুটি রাস্তার একটিতেও কোনো মাটি পড়েনি। চার-পাঁচ বছর আগে কিছু মাটির কাজ হয়েছিল। তাঁর অভিযোগ, কোনো কাজ না করেই টাকা পকেটস্থ করা হয়েছে।
ঘোড়শাল ইউনিয়ন
সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় ঘোড়শাল ইউনিয়নে। এখানে ২৪টি প্রকল্পে ২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার ৬১১ টাকা বরাদ্দ হয়। ইউনিয়নের পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের প্রকল্পে বরাদ্দ ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টির একটি নতুন ভবন ও ঈদগাহের সামনে সামান্য কিছু মাটি ফেলা হয়েছে। মুনুড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাটি ভরাটের প্রকল্পেও ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা বরাদ্দ ছিল। বিদ্যালয়টির মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে সামান্য মাটি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুনুড়িয়া গ্রামের সনৎ বিশ্বাস বলেন, এই স্কুলমাঠে মাটি দেওয়া হয়েছে ১২০-১৩০ ট্রাক। প্রতি ট্রাক মাটি আনতে খরচ হয় ৮০০-৯০০ টাকা। আবার মাটি ছিটিয়ে সেটা সমানও করা হয়নি। ফলে মাঠে কেউ খেলাধুলা করতে পারছে না। নারিকেলবাড়িয়া জেড এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাটি ভরাটে বরাদ্দ ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৮ টাকা। সেখানেও কোনো রকমে মাটি ছিটানো হয়েছে। নারিকেলবাড়িয়া বটতলা থেকে কালীতলা পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ হয় ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৮ টাকা। ওই রাস্তায়ও সামান্য মাটি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব প্রকল্পেই এমন লোক দেখানো কাজ হয়েছে। মূলত বরাদ্দের টাকা পকেটে ভরতেই এমন প্রকল্প। তবে ঘোড়শাল ইউপির চেয়ারম্যান পারভেজ মাসুদ বলেন, তিনি পরিমাণমতো কাজ করেছেন। তা ছাড়া প্রকল্প অফিস থেকে কাজ বুঝে নেওয়া হয়েছে। টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই প্রকল্প, কথাটি সঠিক নয়।
পদ্মাকর ইউনিয়নে নামমাত্র কাজ
পদ্মাকর ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৪৮ লাখ ২২ হাজার ৬২০ টাকা বরাদ্দ আসে। তিওরদাহ ত্রিমোহনী থেকে পূর্ব গোপীনাথপুর খাইরুলের বাড়ি পর্যন্ত পাকা রাস্তার দুই পাশে মাটি ভরাটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৪১ টাকা। এলাকার কয়েকজন বলেন, রাস্তার পাশে জঙ্গল পরিষ্কারের পর মাটি কেটে সমান করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ইউনিয়নের খুলুম বেড়বাড়ি বটতলা বেড়বাড়ি শেষ সীমানা পর্যন্ত রাস্তার সংস্কারকাজে বরাদ্দ হয় ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা। এই রাস্তাতেও মাটি কেটে সমান করা হয়েছে মাত্র। কয়েক স্থানে রাস্তার পাশ থেকে মাটি কেটে ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের রায়চরণ-তারিনীচরণ ডিগ্রি কলেজের আঙিনার কাছে গর্তে মাটি ভরাটের প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৩ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা মশিয়ার রহমান বলেন, ভেকু দিয়ে কিছু মাটি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ করা টাকার হিসাব করলে এটা কোনো কাজই নয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পদ্মাকর ইউপির চেয়ারম্যান নিজামুল গনির মুঠোফোন নম্বরে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
নলডাঙ্গা ও ফুরসন্ধীতেও একই চিত্র
নলডাঙ্গা ইউনিয়নের বাগুটিয়া গ্রামের দুটি প্রকল্পে ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। বাগুটিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, সেখানে একটি ভেকু দিয়ে ১০-১২ দিন মাটি কাটার কাজ হয়েছে। রাস্তার পাশের মাটি কেটে রাস্তার ওপর ফেলা হয়েছে। এতে স্থানীয় মানুষের তেমন কোনো উপকার হয়নি। উল্টো ভেকু দিয়ে মাটি কাটায় রাস্তার পাশে থাকা বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে। একইভাবে এই ইউনিয়নের আড়মুখ গ্রামের দুটি প্রকল্পেও নামমাত্র কাজ হয়েছে।ফুরসন্ধী ইউনিয়নের জিথোড় মন্টুর বাড়ির পাশের রাস্তায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই রাস্তায় কিছুটা কাজ হয়েছে। তবে তা বরাদ্দের তুলনায় অনেক কম। একইভাবে মুক্তারামপুর ব্রিজ থেকে টিকারী বাজারের রাস্তায় বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকার। এখানেও সামান্যই কাজ হয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন বরাদ্দের পরিমাণ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, আগে থেকে বরাদ্দের পরিমাণ জানলে তাঁরা কাজ বুঝে নিতে পারতেন। জানতে চাইলে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাম্মী ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখানে কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছেন। কাজগুলো কীভাবে হয়েছে তা তাঁর জানা নেই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। জেলা প্রশাসক মো. জাকির হোসেন বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। ইউএনওকে প্রকল্পগুলো যাচাইয়ের জন্য বলবেন।
কাজই হয়নি হরিশংকরপুরে
হরিশংকরপুর ইউনিয়নে ১৬টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৬১ হাজার ৪৫২ টাকা। এই ইউনিয়নের ছয়টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তাগুলোতে কোনো মাটির কাজই হয়নি। পানামী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনজুর আহম্মদ বলেন, তাঁর বাড়ি আর্য্য-নারায়ণপুরে। ওই গ্রামে রয়েছে দুটি প্রকল্প। প্রকল্প দুটি হলো ‘আর্য্য-নারায়ণপুর বটগাছ হইতে কাঁচার শেষ মাথা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও আর্য্য-নারায়ণপুর বটগাছ হইতে নারায়ণপুর ঈদগাহ হয়ে নদী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’। এ দুটি রাস্তায় বরাদ্দ রয়েছে ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৬ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু এ দুটি রাস্তায় সম্প্রতি কোনো মাটির কাজ হয়নি। আনুমানিক দুই বছর আগে সামান্য কিছু মাটির কাজ হয়েছিল। এখন এই রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী। হুদা-বাকড়ি ভাগাড় থেকে খালের ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তায় মাটির কাজের জন্য দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ হয় ২২ লাখ ২৫ হাজার ৮২৪ দশমিক ৮০ টাকা। ওই এলাকার বাসিন্দা বাবলুর রহমান বলেন, গত এক বছরে এই রাস্তায় এক ঝুড়ি মাটিও পড়েনি। রাস্তার পাশেই রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নবের আলী শেখদের পারিবারিক কবরস্থান। নবের আলীও বলেন, এই রাস্তার কোনো কাজই হয়নি। তবে পাঁচ-ছয় বছর আগে একবার সামান্য কিছু কাজ হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, একটি টাকার কাজও হয়নি এই রাস্তাটিতে। এলাকার মানুষ কষ্ট করে ফসল ঘরে তুলছেন। এই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য খন্দকার ইমামুল হোসেন বলেন, ওই দুই রাস্তায় ২২ লাখ টাকার বরাদ্দ হলেও ২২ টাকারও কাজ হয়নি। পরানপুর বিল্লালের বাড়ি থেকে পূর্ব বিলের মালেকের জমির কাছাকাছি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও পরানপুর শওকতের বাড়ির ব্রিজ থেকে মাঠের রফির জমি পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ২২ লাখ ২৫ হাজার ৮২৪ টাকা ৮০ পয়সা। এই গ্রামের বাসিন্দা ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ মোল্লা জানান, দুটি রাস্তার একটিতেও কোনো মাটি পড়েনি। চার-পাঁচ বছর আগে কিছু মাটির কাজ হয়েছিল। তাঁর অভিযোগ, কোনো কাজ না করেই টাকা পকেটস্থ করা হয়েছে।
ঘোড়শাল ইউনিয়ন
সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় ঘোড়শাল ইউনিয়নে। এখানে ২৪টি প্রকল্পে ২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার ৬১১ টাকা বরাদ্দ হয়। ইউনিয়নের পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মাটি ভরাটের প্রকল্পে বরাদ্দ ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টির একটি নতুন ভবন ও ঈদগাহের সামনে সামান্য কিছু মাটি ফেলা হয়েছে। মুনুড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাটি ভরাটের প্রকল্পেও ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা বরাদ্দ ছিল। বিদ্যালয়টির মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে সামান্য মাটি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুনুড়িয়া গ্রামের সনৎ বিশ্বাস বলেন, এই স্কুলমাঠে মাটি দেওয়া হয়েছে ১২০-১৩০ ট্রাক। প্রতি ট্রাক মাটি আনতে খরচ হয় ৮০০-৯০০ টাকা। আবার মাটি ছিটিয়ে সেটা সমানও করা হয়নি। ফলে মাঠে কেউ খেলাধুলা করতে পারছে না। নারিকেলবাড়িয়া জেড এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাটি ভরাটে বরাদ্দ ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৮ টাকা। সেখানেও কোনো রকমে মাটি ছিটানো হয়েছে। নারিকেলবাড়িয়া বটতলা থেকে কালীতলা পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ হয় ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৮ টাকা। ওই রাস্তায়ও সামান্য মাটি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব প্রকল্পেই এমন লোক দেখানো কাজ হয়েছে। মূলত বরাদ্দের টাকা পকেটে ভরতেই এমন প্রকল্প। তবে ঘোড়শাল ইউপির চেয়ারম্যান পারভেজ মাসুদ বলেন, তিনি পরিমাণমতো কাজ করেছেন। তা ছাড়া প্রকল্প অফিস থেকে কাজ বুঝে নেওয়া হয়েছে। টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই প্রকল্প, কথাটি সঠিক নয়।
পদ্মাকর ইউনিয়নে নামমাত্র কাজ
পদ্মাকর ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৪৮ লাখ ২২ হাজার ৬২০ টাকা বরাদ্দ আসে। তিওরদাহ ত্রিমোহনী থেকে পূর্ব গোপীনাথপুর খাইরুলের বাড়ি পর্যন্ত পাকা রাস্তার দুই পাশে মাটি ভরাটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৪১ টাকা। এলাকার কয়েকজন বলেন, রাস্তার পাশে জঙ্গল পরিষ্কারের পর মাটি কেটে সমান করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ইউনিয়নের খুলুম বেড়বাড়ি বটতলা বেড়বাড়ি শেষ সীমানা পর্যন্ত রাস্তার সংস্কারকাজে বরাদ্দ হয় ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১২ টাকা। এই রাস্তাতেও মাটি কেটে সমান করা হয়েছে মাত্র। কয়েক স্থানে রাস্তার পাশ থেকে মাটি কেটে ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের রায়চরণ-তারিনীচরণ ডিগ্রি কলেজের আঙিনার কাছে গর্তে মাটি ভরাটের প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৩ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা মশিয়ার রহমান বলেন, ভেকু দিয়ে কিছু মাটি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ করা টাকার হিসাব করলে এটা কোনো কাজই নয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পদ্মাকর ইউপির চেয়ারম্যান নিজামুল গনির মুঠোফোন নম্বরে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
নলডাঙ্গা ও ফুরসন্ধীতেও একই চিত্র
নলডাঙ্গা ইউনিয়নের বাগুটিয়া গ্রামের দুটি প্রকল্পে ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। বাগুটিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, সেখানে একটি ভেকু দিয়ে ১০-১২ দিন মাটি কাটার কাজ হয়েছে। রাস্তার পাশের মাটি কেটে রাস্তার ওপর ফেলা হয়েছে। এতে স্থানীয় মানুষের তেমন কোনো উপকার হয়নি। উল্টো ভেকু দিয়ে মাটি কাটায় রাস্তার পাশে থাকা বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে। একইভাবে এই ইউনিয়নের আড়মুখ গ্রামের দুটি প্রকল্পেও নামমাত্র কাজ হয়েছে।ফুরসন্ধী ইউনিয়নের জিথোড় মন্টুর বাড়ির পাশের রাস্তায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই রাস্তায় কিছুটা কাজ হয়েছে। তবে তা বরাদ্দের তুলনায় অনেক কম। একইভাবে মুক্তারামপুর ব্রিজ থেকে টিকারী বাজারের রাস্তায় বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকার। এখানেও সামান্যই কাজ হয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন বরাদ্দের পরিমাণ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, আগে থেকে বরাদ্দের পরিমাণ জানলে তাঁরা কাজ বুঝে নিতে পারতেন। জানতে চাইলে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাম্মী ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখানে কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছেন। কাজগুলো কীভাবে হয়েছে তা তাঁর জানা নেই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। জেলা প্রশাসক মো. জাকির হোসেন বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। ইউএনওকে প্রকল্পগুলো যাচাইয়ের জন্য বলবেন।
No comments