‘প্রস্তুত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ’ by আল আমিন
ঢাকার সদর ঘাটের ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চরখেজুরবাগ থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত ডক ইয়ার্ডগুলোর আশপাশে বিকট শব্দের জন্য কানপাতা দায়। চলছে পুরনো লঞ্চ মেরামতের কাজ। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে প্রায় ৩৫টি ডকে ৫০টি লঞ্চের মেরামতের কাজ চলছে। মেরামত শেষে ওই লঞ্চগুলো যাত্রী পরিবহনের জন্য নদীতে নামানো হবে। ওই এলাকা ঘুরে জানা গেছে মেরামতের জন্য নেয়া লঞ্চগুলোর বেশির ভাগই ছিল ত্রুটিপূর্ণ বা অকেজো। ঈদকে সামনে রেখে এগুলো মেরামতের তোড়জোড় শুরু করেছেন মালিকরা। যাত্রীদের চাপের সময় এসব লঞ্চ দিয়ে স্বল্প ও দূরযাত্রার যাত্রী বহন করা হবে এসব লঞ্চে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং সার্ভের ঢাকা জোনের পরিচালক মির্জা সাইফুর রহমান বলেন, ‘ঈদ এলে যেমন আমরা সবাই নতুন জামা কাপড় কিনি তেমন করে জরাজীর্ণ লঞ্চগুলো রং করা হয়। মেরামত করা হয় না। ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন যাত্রীবহন না করতে পারে এজন্য কর্তৃপক্ষ সতর্ক রয়েছে। যদিও এ পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় পড়া লঞ্চের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
রাজধানীর সদর ঘাটের ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর খেজুরবাগ থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত নদীর ধারে প্রায় ২ কিলোমিটার ব্যাপী গড়ে উঠেছে ডক ইয়ার্ড। এখানে প্রায় ৩৫টি ডক ইয়ার্ড আছে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ডক ইয়ার্ড এর শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চগুলো মেরামতে ব্যস্ত রয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ওভার টাইম কাজ করাচ্ছেন। বিনিময়ে অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন। ডকইয়ার্ডে দেখা গেছে, অনেক লঞ্চের নিচের অংশ মেরামত করা হচ্ছে যেখান দিয়ে পানি প্রবেশ করে।
সূত্র জানায়, লঞ্চের ফিটনেস পরীক্ষা করে থাকে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং সার্ভে ঢাকা জোন। কোন লঞ্চ নদীতে যাত্রী নিয়ে চলাচল করার আগে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হয়। নইলে তারা যাত্রী পরিবহন করতে পারে না। অভিযোগ পাওয়া গেছে, যেসব ফিটনেসবিহীন লঞ্চ নদীতে চলাচলে অনুপযোগী ওই লঞ্চের মালিকদের কাছে ঘুষ নিয়ে সার্ভে কর্মকর্তারা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চরখেজুর বাগান এলাকায় রহমান ডকে গিয়ে দেখা গেছে, প্রিন্স আওলাদ-১ নামে তিনতলা একটি লঞ্চকে সম্পূর্ণ উল্টোভাবে রাখা হয়েছে। তিন তলায় কেবিনের কাঠগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, এটি প্রায় এক মাস আগে থেকে মেরামত শুরু হয়েছে। লঞ্চটির মূল কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এটি মেরামত করতে আর কিছু দিন সময় লাগবে। রমজানের পরেই ঈদে ওই লঞ্চ যাত্রী পরিবহনের জন্য নামানো হবে বলে তারা জানান।
রহমান ডক ইয়ার্ডের লঞ্চ মেরামতকারী বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রমিক আবদুল ওদুদ বিশ্বাস জানান, যেসব লঞ্চ মেরামত করা হয় তা সেগুলোর বেশির ভাগই লক্কড় ঝক্কর। পুরনো অথবা জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। একটি লঞ্চ সাধারণত প্রায় ৭-৮ বছর ভালভাবে সার্ভিস দিয়ে থাকে। তারপর এটির বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, লঞ্চের নিচ ফেটে যাওয়া, ইঞ্জিন ও যান্ত্রিক সমস্যা, আশপাশে ফাটল, রঙ উঠে যাওয়া, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, ঝাঁকি দেয়া, বেইজমেন্টে পানি ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি।
তিনি বলেন, যেসব লঞ্চ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ওসব লঞ্চ মেরামত করতে প্রায় ২ মাস লেগে যায়। রহমান ডকে দু’টো লঞ্চ ঈদ উপলক্ষে মেরামত করা হচ্ছে।
অগ্রগতি ডক ইয়ার্ডের শ্রমিক আবদুর রহিম জানান, তাদের এই ডকে দু’টো লঞ্চ মেরামত করা হচ্ছে। একটি এজাজুল-১ এবং অপরটি এমভি বোগদাদিয়া। এই দু’টি লঞ্চে প্রায় তিন মাস আগে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, অনেক লঞ্চ নষ্ট হয়ে ডকে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ঈদ এলেই তারা মেরামত করার উদ্যোগ নেয়। ঈদ এলেই লঞ্চ কেন মেরামতের করা হয় প্রশ্ন করা হলে, ঈদ এলেই রাজধানীবাসী গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান। তাছাড়া উপকূল এলাকায় যাতায়াতের অন্যতম সহজলভ্য পথ হচ্ছে লঞ্চ। তাই অনেক যাত্রী লঞ্চে করে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যান। আর এতে অধিক মুনাফা লাভ করেন লঞ্চ মালিকরা।
বেবি সাহেবের ডকের শ্রমিক সামসুল আরেফিন সুমন জানান, ঈদ এলেই আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চগুলো দিনরাত পরিশ্রম করে মেরামত করছি। যে সব লঞ্চ এখন ভাল করা হচ্ছে ওই সব লঞ্চ কয়েকদিন আগে পড়ে ছিল।
মেসার্স শিপ বিল্ডার্সর অন্যতম সুপারভাইজার হাসানুল মবিন দাবি করে বলেন, যেসব লঞ্চে কিছু ত্রুটি থাকে সেগুলো যাত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে মেরামত করা হয়ে থাকে। চাকচিক্য ও সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য কোন কোন লঞ্চ এমনিতেই রঙ করা হয়ে থাকে। অধিক ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চগুলো মেরামত করে শুধু কেন ঈদে নামানো হয় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্ন মালিক পক্ষকে করেন।’ মাদারীপুর ডকের প্রধান কর্মকর্তা হারুন জামিল স্বীকার করেন, একটি লঞ্চ যখন চলাচলে অনুপযোগী হয় তখন মালিক পক্ষকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। ঈদের আগা মুহূর্তে অনেক লঞ্চ মালিক তাদের লঞ্চ মেরামত করে। পরে ঈদে অধিক যাত্রী বহন করে মেরামতের খরচ তুলে নেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের অগ্রগতি ডকের পাশের স্থানীয় বাসিন্দা ও রাইহান মিলের মালিক রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ জানান, ‘লঞ্চের কেবিন তৈরির জন্য বিভিন্ন ডকের মালিক আমার কাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করে থাকে। ঈদ এলে এই ডক পাড়ায় শ্রমিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্য সময় তেমনটা তাদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। নদীর পাশে লঞ্চ মেরামতের কারখানা গড়ে ওঠায় এ এলাকার পরিবেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি এসব ডক অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং সার্ভের ঢাকা জোনের পরিচালক মির্জা সাইফুর রহমান বলেন, পুরনো লঞ্চগুলো রং করার পাশাপাশি কেবিনে নতুন কাঠ লাগানো হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে ওই এলাকা পরিদর্শন করে এসেছি। আমার জানা মতে লঞ্চের নিচের অংশ কেউ মেরামত করছেন না। তবে যদি কোন প্রতিষ্ঠান এ কাজ করে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাকার বিনিময়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয় কিনা এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সার্ভে প্রতিষ্ঠানের নামে কোন দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা নদী বন্দর সদর ঘাটের যুগ্ম পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, প্রায় লঞ্চগুলো সদর ঘাটের টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। এছাড়াও ঈদে প্রচ- চাপ থাকায় সদর ঘাটের আশপাশের এলাকা থেকে ছেড়ে যায়। এ টার্মিনাল থেকে যেন ঝুঁকিপূর্ণ কোন লঞ্চ ছেড়ে না যায় এজন্য এবার ঈদে কঠোর নজরদারি করা হবে।
No comments