এরশাদের ১৫১!-এককভাবেই ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন এরশাদ by সোহরাব হাসান
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদ ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নয়, এককভাবেই ক্ষমতায় যাওয়ার
খোয়াব দেখছেন। গত সোমবার রংপুর টাউন হলে জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির ইফতার
পার্টিতে তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে
আমাদের সুযোগ নিতে হবে। আমি প্রতিটি জেলায় সফর করব। সামনের জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে আমাদের ১৫১টি আসন নিতে হবে। আমাদের সরকার গঠন করতে হবে।’ (প্রথম
আলো, ১৫ জুলাই, ২০১৪)
>>‘অসাধু রাজনৈতিক’ প্রক্রিয়ার ‘সাধু পুরুষ’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার বা বিরোধী দলের শরিক ছিলেন এবং আছেন। এখন তিনি কারও সাহায্য ছাড়া এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন।
এর আগেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এরশাদ এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলে দলীয় নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। একসময় তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের বিরুদ্ধেই বিষোদগার করতেন। এখন বিএনপিকেই একমাত্র টার্গেট করছেন। নিজেদের সাচ্চা ও বিএনপিকে ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করছেন। তাঁর এই দাবির সত্যাসত্য প্রমাণের উপায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে আরেকটি নির্বাচন। কিন্তু এরশাদ কিংবা তিনি একই সঙ্গে যে সরকারের শরিক ও বিরোধী দল, তারাও সে রকম একটি নির্বাচন করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো নয়, এটি সবাই জানে। একশ্রেণির নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি দলটির জনপ্রিয়তা যে তলানিতে নামিয়ে এনেছে, সেটিও সত্য। কিন্তু তাই বলে এরশাদের হাতে কী অলৌকিক জাদু আছে, যার বলে একতরফা নির্বাচনে ৩২টি আসন পাওয়া দলটি এক লাফে ১৫১টি আসন পেয়ে যাবে?
বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে জাতীয় পার্টির অবস্থান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তো বটেই, মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীরও অনেক নিচে। ওই নির্বাচনে দু-একটি ছাড়া কোনো উপজেলা পরিষদেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী জেতেননি। বরং একদা দলটির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা গো-হারা হেরেছেন।
সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের দাবি অনুযায়ী, তাঁর জাতীয় পার্টিই সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী শক্তি। আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি হলো ভেজাল জাতীয়তাবাদী দল। আসলে আসল ও নকল পরিমাপের মালিকও জনগণ। যে ব্যক্তি নির্বাচন না করেই নির্বাচিত হন, আবার নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব জমা দেন না, সেই ব্যক্তির কথারই বা কী গুরুত্ব আছে?
জনগণের ভোট নিয়ে এরশাদ বা তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমান কখনো ক্ষমতায় যাননি। তাঁরা নিজে সামরিক অভ্যুত্থান করে বা অন্যের অভ্যুত্থানের জোরে ক্ষমতায় গিয়ে নানা অসাধু উপায়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, দল করেছেন সেই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে। অন্যান্য সামরিক শাসকের মতো এরশাদও প্রথমে তাঁর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই বলে জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলেন এবং যথারীতি সেই ওয়াদা ভুলে গিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে লোক ভাগিয়ে একটি দল করেছেন। প্রথমে এর নাম ছিল জনদল, পরে জাতীয় পার্টি। কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, কাউকে মন্ত্রিত্বের টোপ দিয়ে দলে ভিড়িয়েছেন। জিয়া ও এরশাদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া হুবহু এক। জিয়া প্রথমে বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সামনে রেখে জাগোদল করেন, পরে নিজে বিএনপির চেয়ারম্যান হন। এরশাদ প্রথমে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দিয়ে জনদল করেন, পরে নিজে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন। আবার সেনাবাহিনীর পোশাক পরে দুজনই ‘হ্যাঁ-না’ ভোট নিয়েছিলেন।
এই অসাধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাধু পুরুষ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার বা বিরোধী দলের শরিক ছিলেন এবং আছেন। এখন তিনি কারও সাহায্য ছাড়া এককভাবে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন। খোঁড়ারও মাঝেমধ্যে গিরি লঙ্ঘনের ইচ্ছে জাগে।
১৯৯১ সাল থেকে চারটি নির্বাচনে পালাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, যদিও এককভাবে নয়। বিএনপি জামায়াতের সহায়তায় আর আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থনে। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে হলে কী ফল হতো, সেই তর্ক এখন অনর্থক। কারও মতে, বিএনপি নির্বাচন না করে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দিয়েছে। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের পাতা ফাঁদে বিএনপি পা না দিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে।
কিন্তু জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ এখন এককভাবে ১৫১টি আসন পাওয়ার খোয়াব দেখছেন কীভাবে? আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমলে তাতে বিএনপি জোটেরই লাভবান হওয়ার কথা। সরকারের অংশীদার ও ভাই দাবিদার এরশাদ কোনোভাবেই সুবিধা পেতে পারেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে সুবিধা নেবেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আদায় করবেন, সরকারে নিজ দলের মন্ত্রী রাখবেন, অথচ সরকারের ব্যর্থতার দায় নেবেন না, সেটি হতে পারে না।
তাই, এরশাদের পক্ষে আগামী নির্বাচনে ১৫১টি আসন পাওয়া তখনই সম্ভব যখন যুগপৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলকেই নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারবেন। সব সম্ভবের দেশে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বাইরে রেখেই তিনি ক্ষমতা প্রলম্বিত করেছিলেন। তাহলে কি বাংলাদেশ অচিরেই আরেকটি ভোটারবিহীন ও দলবিহীন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
আওয়ামী লীগের বাগপটু নেতারা, মন্ত্রীরা বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে প্রায়ই দেশবাসীকে সতর্ক করেন। বাঘ এল রে। কিন্তু এখন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ সম্পর্কেই সজাগ হওয়ার সময় হয়েছে।
No comments