বাঁশের ব্যাংক, মাটির ব্যাংক, সুইস ব্যাংক by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে জানা গেছে,
বিদেশে টাকা পাচারে বাংলাদেশ অদ্বিতীয় নয়, দুনিয়ায় দ্বিতীয়। আইভরিকোস্ট এক
নম্বর। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৮০ কোটি ডলার অর্থাৎ ৬,২৪০ কোটি টাকা
বিদেশে পাচার হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ৪২ বছরে তিন লাখ কোটি টাকা (টাকা
৩০০,০০০,০০০০০০০) পাচার হয়েছে। সেই টাকা সুদে-আসলে বেড়ে কত হয়েছে, তা
ব্যাংক–কর্মকর্তারা নন, একমাত্র বিধাতার পক্ষেই বলা সম্ভব। টাকাগুলো
প্রধানত সুইস ব্যাংকে রাখাই নিরাপদ। মালয়েশিয়াও মন্দ নয়।
টাকা পাচার নিয়ে বিশ্বব্যাপী কথা ওঠায় এবং সৎ ও সুদক্ষ বাংলাদেশ সরকার ‘সব টাকা ফেরত আনা হবে’ হুংকার দেওয়ায়, যাঁরা টাকা পাচার করেছেন, তাঁদের অনেকেই মৃদু হেসেছেন। দুর্বলচিত্ত কেউ কেউ ‘কখন কী হয়’ এই আশঙ্কায় সুইস ব্যাংকের নিচের দিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন। টাকাগুলো মারা যাবে কি না, তা নিয়ে সুইস ও বাঙালির মধ্যে কথাবার্তা হয়। সুইস কর্মকর্তা জানতে চান, আপনাদের নিজেদের দেশের ব্যাংকে টাকা রাখতে ভরসা পান না কেন?
বঙ্গসন্তান বলেন, কোন ব্যাংক কোন সময় লাটে ওঠে তার ঠিক নাই!
বাই দ্য বাই সুইস কর্মকর্তা জানতে চান, বাংলার মাটিতে আগে মানুষ টাকা সঞ্চয় করত কোথায়। যেমন ধরুন, আপনার বাবা বা দাদা-নানা কোথায় সঞ্চিত অর্থ রাখতেন?
বঙ্গীয় গ্রাহক বলেন, ৫০-৬০ বছর আগে বাঁশের খুঁটির ভেতর, তারপর মাটির ব্যাংকে, তারপর দেশি ব্যাংকে। অবশেষে দেশি ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে এনে আপনাদের ব্যাংকে।
সুইস কর্মকর্তা: বাঁশের খুঁটি ও মাটির ব্যাংক কথাটা বুঝতে পারলাম না।
বঙ্গসন্তান: যেমন ধরুন, আমার দাদা হেকমত আলীর কথা যদি জানতে চান তা হলে বলব, তিনি ও আমার দাদি টাকা রাখতেন বাঁশে।
সুইস ভদ্রলোক প্রথম বোঝেন না। একটু ঝুঁকে কলম দিয়ে থুতনি খোঁচাতে খোঁচাতে বলেন, বাঁশ মানে ব্যাম্বু অর্থাৎ ব্যাম্বুসা (Bambusae) ফ্যামিলির উদ্ভিদ?
: জি হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। বাঁশ। আপনার তো ধারণা থাকার কথা যে বাঁশের দুই গিঁটের মাঝে ফাঁপা। ব্রিটিশ আমলে আমার দাদা সিকি-আধুলি বা এক টাকার কাঁচা কয়েন শণের ঘরের বাঁশের খুঁটির খোল ফুটো করে তাতে জমাতেন। পাকিস্তান হওয়ার পর আমার বাবা এক হিন্দু পরিবার জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছিল, তাদের থেকে সস্তায় একটি টিনের ঘর কেনেন। সেখানে বাঁশের খুঁটি ছিল না, কাঠের খুঁটি। বাবার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। একটি ব্যাংক ছিল সদরে, আমাদের বাড়ি থেকে ২২ মাইল। আমার মা সঞ্চয়ী ছিলেন। টাকা রাখতেন মাটির ব্যাংকে। আমিই প্রথম আশির দশকে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে।
সুইস কর্মকর্তা বলেন, তাহলে বাঁশের খোলে টাকা রাখার দিন শেষ। তবে গৃহনির্মাণ ছাড়াও তো আপনাদের দেশে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার হয়।
বাঙালি: তা হয়। যেমন বাঙালি বাঙালিকে বাঁশ দেয়।
সুইস: বাঁশ দেয় মানে, উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি?
বাঙালি: না। বাঁশ প্রবেশ করানো হয় শত্রু বা প্রতিপক্ষের দেহের অভ্যন্তরে। আর মানুষ হিসেবে আপনার জানা আছে যে মানবদেহের প্রবেশপথ দুটো: একটি ওপরের দিকে, আর একটি নিচের দিকে। বাঙালি তার শত্রুর বা যাকে দেখতে পারে না, তার দেহে আস্ত বাঁশ প্রবেশ করায় দ্বিতীয় প্রবেশপথ বা গুহ্যদ্বার দিয়ে। কখনো সে বাঁশ মসৃণ ও তেল দিয়ে মালিশ করা; তবে অধিকাংশ সময়ই আইখ্যাঅলা বা গিঁটসহ। আমাদের দেশে বড় বড় দলের নেতারা বাঁশ হাতে নিয়েই ঘোরেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র প্রতিপক্ষকে বাঁশ দেন।
সুইস কর্মকর্তা শুনে অবাক হন। বলেন, আমার এক বন্ধু কী এক ত্রাণকাজে বাংলাদেশে গিয়ে মাস তিনেক ছিলেন। তাঁর কাছে শুনেছি আপনাদের দেশে রাজনৈতিক কোন্দল খুব বেশি। এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে ইতরামো করে। অনারেবল মিনিস্টাররা পর্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ইতরজনের ভাষায় কথা বলেন। সেটাই নাকি তাঁদের কথা বলার স্টাইল।
বাঙালি গ্রাহক: যা শুনেছেন তা খুব কমই শুনেছেন। হপ্তাখানেক সেখানে গিয়ে থাকলে নিজের কানে শুনতে পাবেন। যেমন ধরুন সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার কথা উঠতেই মহাজোটের কয়েকজন নেতা দেশবাসীকে জানালেন, সব টাকা একটি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের, যিনি বিলেতপ্রবাসী এবং আর্নল্ড টয়েনবির মতো ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ। তাঁরা ঘোষণা দিলেন তাঁর ওই টাকা ফেরত আনা হবে। তাঁরা দেশের তাবৎ টিভি-শ্রোতাকে মনে করেন বেআক্কেল বা ছাগল। নেতারা যা বলবেন তারা তা মনোযোগ দিয়ে শোনে বটে; যেন বিশ্বাস করতেও বাধ্য। মনে হচ্ছে, গত সাড়ে সাত বছর যাবৎ সব টাকা পাচার একজনই করছেন। সাড়ে সাত বছর যাবৎ যাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, সুইস ব্যাংকে রাখার মতো যথেষ্ট টাকা তাঁদের নেই।
সুইস ব্যাংক কর্মকর্তা: ইতিহাসবিদ সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দলের নেতারা কি নীরব এ ব্যাপারে?
বাঙালি: বাংলার মাটিতে নীরবতা বলে কিছু নেই। এক কুড়ি (অথবা সম্ভাব্য ততোধিক) দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের নেতারাও জনহিতৈষী। তাঁরা চান না কোনো বাঙালির (গারো, চাকমা, সাঁওতাল, মারমা, বোম, খাসিরা সুইস ব্যাংকে পর্যন্ত যায় না। তারা টাকাকড়ি তাদের ঘরের মধ্যেই স্যুটকেসে রাখা নিরাপদ মনে করে।) টাকা বিদেশবিভুঁইয়ের কোনো ব্যাংকে পড়ে থাকুক। বিশেষ করে কার কার টাকা বিদেশি ব্যাংকে আছে, তা তারা জানতে চান। তাঁদের এই দাবি যে কতটা ঝুঁকির ব্যাপার, তা জেনেও তাঁরা তা করছেন। তাঁরা বোঝাতে চাইবেন—সুইস ব্যাংকে আমাদের টাকা থাকলে তো আনবে? তাঁরা খুব ভালোই জানেন, পাচারের টাকা নিয়ে সরকার বেশি দূর যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে আপনাদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো পর্যন্তই। চিঠিখানা পেয়েছেন তো?
সুইস কর্মকর্তা: আমরা প্রতিদিন বহু চিঠি পাই। কিছু চিঠি ফাইলে রাখি, কিছু ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে স্থান পায়। যাঁরা আস্থা নিয়ে আমাদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখেন, তাঁরা আমাদের ভ্যালুড কাস্টমার। আমরা তাঁদের কাছে দায়বদ্ধ। কোনো দেশের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার কাছে আমাদের কোনো দায় নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঠিকঠাক রাখুক। সুড়ঙ্গ কেটে টাকা চুরি বন্ধ করুক। পরিচালক ও কর্মকর্তাদের টাকা চুরি বন্ধ করুক। সুইস ব্যাংক নিয়ে তাদের মাথা ঘামানো স্রেফ পণ্ডশ্রম।
বাঙালি গ্রাহক: যা হোক, ভাই, আপনে আমার বাপের মতো। আমার নামটা যাতে ফাঁস না হয় খেয়াল রাখবেন। এত টাকা জইমা গেছে। ৪৪ বছর আগের ২২ পরিবারের সবার মিলে যত টাকা ছিল, আমার টাকা তার চেয়ে বেশি। দেশের ব্যাংকের ব্যবস্থাও বেহাল। টাকাকড়ি আর কিছু কম হলে আমাদের বন বিভাগের কর্মকর্তার মতো বালিশ ও তোশক-ম্যাট্রেসের ভেতরে রাখতাম।
সুইস কর্মকর্তা: আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে বাড়িতে গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। এই পাচারকৃত টাকা ছোঁয়ার ক্ষমতা ও ইচ্ছা আপনাদের সরকারের নেই। আপনার শরীরের কোনো জায়গার একটি লোমও কেউ টেনে ছিঁড়তে পারবে না।
বাঙালি গ্রাহক: সেই দোয়াই কইরেন। আমার ব্যালান্সটা একটু জানতে পারলে ভালো হইত।
সুইস কর্মকর্তা কম্পিউটারের কি-বোর্ডে টোকা দেন। মনিটরে তাকিয়ে বলেন: ৩০ লাখ ইউএস ডলার।
অঙ্কটা শুনে আঁতকে ওঠেন বাঙালি গ্রাহক। ৩০ লাখ তাঁর অতিপরিচিত ফিগার। ৩০ লাখের অন্তত দুজন তাঁর চেনা। একজন গ্রামের বাজারের ঝোলা গুড়ের ব্যবসায়ী গণেশ পোদ্দার, আর একজন নওশের মিয়ার ছেলে সাব্বির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত ও ছাত্র ইউনিয়ন করত। দুজনকে যারা ধরিয়ে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে তার বাপ-চাচারাও ছিলেন। তখন ক্লাস সিক্সে পড়লেও তাঁর সব মনে আছে। মনে হলো, তাঁর সামনে গণেশ পোদ্দার দাঁড়িয়ে, তাঁর পেছনে সাব্বির। পোদ্দার হেসে বলছেন, কী রে সেন্টু, শরীরডা ভালো তো? তোর ওই টাকা থিকা আমাগো দুই জনের পাওনা দুই ডলার দিবি না?
‘থ্যাংকস’ বলে বাঙালি উঠে দাঁড়ান। পাচারকৃত টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। জুরিখ থেকে যাবেন লন্ডন। সেখানে একাত্তরের ওপর একটি সেমিনারে যোগ দিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments