মধ্যপ্রাচ্যে নতুন খলিফা? by হাসান ফেরদৌস
মুসলিম বিশ্বে এক নতুন খলিফার আবির্ভাব
হয়েছে। নাম আবু বকর আল-বাগদাদি। আপাতত সিরিয়া ও ইরাক—এ দুই দেশ মিলে এক
নতুন ইসলামি খেলাফত নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন এই নতুন খলিফা, যদিও তাঁর
দৃষ্টি আরও বহুদূর বিস্তৃত। এ ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে ভ্রু-কুঞ্চন
ঘটেছে বটে, তবে ঠিক হৃৎকম্পন এখনো শুরু হয়নি। কেউ কেউ খলিফা আল-বাগদাদিকে
বড়জোর কাগুজে বাঘ বলে তাঁর গুরুত্ব খাটো করার চেষ্টা করেছেন। খোদ
প্রেসিডেন্ট ওবামা ঠাট্টা করে বলেছেন, (বাস্কেট বল দল) লেকার্সের জার্সি
গায়ে দিলেই তো আর কোবি ব্রায়ান্টের মতো চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় হওয়া যায় না।
বাগদাদি সাহেব অবশ্য এ সময়ের একমাত্র খলিফা নন। দেড় যুগ আগে আফগানিস্তানের এক চোখ কানা তালেবান নেতা মোল্লা ওমর নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেছিলেন। মার্কিন বোমাবাজির মুখে রাজত্ব হারালেও নিজের খলিফা ‘টাইটেল’ অবশ্য তিনি এখনো ত্যাগ করেননি। পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে পেলে-পুষে রেখেছে, যদি কখনো ফের তাঁর প্রয়োজন পড়ে, এই আশায়।
বাগদাদি সাহেব অবশ্য এ সময়ের একমাত্র খলিফা নন। দেড় যুগ আগে আফগানিস্তানের এক চোখ কানা তালেবান নেতা মোল্লা ওমর নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেছিলেন। মার্কিন বোমাবাজির মুখে রাজত্ব হারালেও নিজের খলিফা ‘টাইটেল’ অবশ্য তিনি এখনো ত্যাগ করেননি। পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে পেলে-পুষে রেখেছে, যদি কখনো ফের তাঁর প্রয়োজন পড়ে, এই আশায়।
এ দুজনের বাইরে আরও একজন খলিফা আছেন, তিনি হলেন নাইজেরিয়ার বোকো হারাম দলের নেতা আবু বকর শেকাউ। এই দল ও তার খলিফা এখনো ঠিক পুরো একটা দেশকে নিজের খেলাফত বলে ঘোষণা করার মহৎ সুযোগ পাননি। আপাতত তাঁরা ব্যস্ত অল্প বয়সী মেয়েদের অপহরণ করে নিজেদের আরাম-আয়েশে ব্যবহারে।
ব্যাপারগুলোকে যতই ঠাট্টা করি না কেন, এর কোনোটাই ঠিক ঠাট্টার নয়। মধ্যপ্রাচ্যে এক জটিল রাজনৈতিক সংকটের মুখে আইসিস নামের এই ‘খেলাফতের’ উত্থান গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দুই বছর গড়িয়েছে। সেখানে প্রতিদিন মরছে মানুষ। ১০ লাখেরও বেশি সিরিয়াবাসী—তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু—উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী তুরস্কে। অন্যদিকে, ইরাকে কাগজে-কলমে মার্কিন অবরোধ শেষ হলেও দেশটিতে শান্তি ফিরে আসেনি। মার্কিন নজরদারিতে যে শিয়া-নিয়ন্ত্রিত সরকার সেখানে ক্ষমতায়, তাদের একদেশদর্শী রাজনীতির ফলে দেশটি এখন নতুন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি।শিয়া-সুন্নি-কুর্দি—এই জাত-পাত-গোত্রের বিভেদ এখন এতটা তীব্র যে অচিরেই দেশটি সম্ভবত ধর্মীয় বা গোত্রীয় অন্তর্বিবাদে তিন টুকরা হয়ে পড়বে।
সিরিয়া ও ইরাকে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তারই পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ইসলামি চরমপন্থীরা। আল-কায়েদার অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু এই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক জিহাদি গোষ্ঠী গোড়ায় সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে মিলিত হয়। তাদের জন্য লাভজনক এই বিবেচনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই জিহাদিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ইরাক-সিরিয়ার সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ায় এই বাহিনীর সদস্যরা সহজেই ইরাকের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সাদ্দাম বাহিনীর সাবেক সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে হাত মেলানোয় আইসিসের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হয়। দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁদের নিয়ন্ত্রণে এনে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল-শামস বা আইসিস গঠনের ঘোষণা শোনা যায়। এই আইসিসেরই প্রধান হলেন খলিফা বাগদাদি।
আইসিসের উত্থান আকস্মিক, তবে একদম অপ্রত্যাশিত নয়। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাকের সুন্নি সংখ্যালঘুরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনো চিন্তাই বিবেচনায় আনেননি। সাদ্দামের সময়ে যে সুন্নিরা পুরো দেশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে, তারা নিজের দেশেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়ে। আইসিস যখন সীমান্তের ওপার থেকে, অর্থাৎ সিরিয়া থেকে অভিযান শুরু করে, তখন ইরাকের সুন্নিরা তাদের সমর্থন দেয়। সামরিক বিজয়ের ফলে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হবে, তাকে ব্যবহার করে নিজেদের জন্য সম্মানজনক রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করা সহজতর হবে, সেই বিবেচনা থেকেই সাদ্দামের সেনাবাহিনীর অনেক সাবেক কর্মকর্তা ও সৈনিক আইসিসের অভিযানে যুক্ত হন। ইরাকি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের অনেকেই নিজের সরকারের ওপর বিরক্ত, ফলে দোরগোড়ায় আইসিস আসতে না আসতেই তাঁরা বিনা যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে চলে যান। মসুলের মতো বড় শহরের নিয়ন্ত্রণ এভাবেই অর্জিত হয়।
ঘাড়ের ওপর আইসিস আসার পরও মালিকি সরকার যে ব্যাপারটায় খুব উদ্বিগ্ন, তা মনে হয় না। বস্তুত, মুখে না না বললেও মালিকি চাইছিলেন এই যুদ্ধে আমেরিকা ফের জড়িয়ে পড়ুক। লক্ষ্য, আমেরিকার ঘাড়ে বন্দুক রেখে শত্রু ঘায়েল। আইসিসের আগমন সে পথ সুগম করল। নিজের টাঁকশাল উজাড় করে আমেরিকা ইরাকের জন্য ব্যয় করেছে। সেই ইরাক যদি এত সহজে আল-কায়েদা (বা তার সহযোগীদের) হাতে চলে যায়, আমেরিকার অপমানের শেষ থাকবে না।বারাক ওবামাও ব্যাপারটা বোঝেন। ফলে, খানিকটা গাঁইগুঁই করার পর তিনি সেখানে বিমানবহর ও সেনা উপদেষ্টা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারিভাবে স্বীকার করা না হলেও তথাভিজ্ঞ মহল জানাচ্ছে, মার্কিন বিমানবহরগুলো ইতিমধ্যে আইসিস লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালিয়েছে।
আইসিসের এই আকস্মিক উদ্ভব দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, ইরান ও আমেরিকা উভয়েই আল-কায়েদাজাতীয় জেহাদি বাহিনীর উত্থান ঠেকাতে চায়, ফলে আশু কৌশল হিসেবে তারা একে অন্যের নিকটতর হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। আবার, আইসিসকে ঠেকানোর নামে সিরিয়ার আসাদও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টায় রয়েছেন। অন্যদিকে, ইরাকের উত্তরে কুর্দিরা, যারা এত দিন ওত পেতে বসে ছিল কখন আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাক থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তারা একটি মোক্ষম সুযোগ মিলেছে ভেবে এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে।
আঞ্চলিক সম্পর্কের সমীকরণে এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলেছে সৌদি আরবকে। আল-কায়েদা মুখ্যত সৌদি ও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থে পুষ্ট একটি জেহাদি আন্দোলন।ইরানের প্রভাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে এই আন্দোলনের কম-কট্টর সালাফিপন্থীদের সৌদিরা দীর্ঘদিন থেকেই নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।নিজের দেশের ভেতর তারা আল-কায়েদাকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যদি তাকে ব্যবহার করা যায়, পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশে তার মাথায় ছাতা ধরে রাখতে আপত্তি নেই। সৌদি আরব ইসলামকে তার ভূরাজনৈতিক রণকৌশলের একটি উপাদান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। একই উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় তার নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ইসলামিক ফ্রন্ট নির্মাণে বিস্তর কাঠখড় পোড়ায় সৌদিরা, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে এনে তাঁদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সেই ফ্রন্টের সদস্যরা টাকাপয়সা পকেটস্থ করতে যত আগ্রহী, লড়াই করতে ততটা নন। আল-কায়েদার (বা আইসিসের) অবশ্য সে সমস্যা নেই। জিহাদের নামে লড়তে অসংখ্য মানুষ ইরাক ও সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। আল-কায়েদার এই উত্থানে সৌদি আরব খুশি হতে পারত, যদি এর ফলে ইরাক ও ইরানে শিয়াদের দাপট কমত। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আল-কায়েদা ঠেকাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই ইরান ও আমেরিকাকে নিকটতর হতে হচ্ছে। একই কারণে ইরানের সামরিক ও কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠিক যে ভয়টা এড়াতে চাইছিল সৌদি আরব, তা আরও জেঁকে বসছে।
আইসিসের উত্থান আমাদের মতো দেশের জন্যও ভয়ের কারণ। খলিফা আল-বাগদাদি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, শুধু সিরিয়া ও ইরাকে নয়, বিশ্বজুড়ে একটি ইসলামি খেলাফত গঠন তাঁর লক্ষ্য। দক্ষিণ এশিয়ার জিহাদি সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে ইন্টারনেটে নতুন এই খলিফাকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশের জিহাদিরাও তাদের মধ্যে রয়েছে। গত ছয় বছরের পরিকল্পিত উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে জিহাদি গ্রুপগুলো এখন কোণঠাসা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের শক্তি নিঃশেষিত। খেলাফতের প্রত্যাবর্তন উগ্রবাদীদের পুনর্গঠিত হওয়ার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। ইন্টারনেটে এসব গ্রুপ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক তৎপর। এদের প্রভাবে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে জিহাদি মনোভাব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজনীতির নানা প্রশ্নে আমরা বিভক্ত, চলতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমাদের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু জিহাদিদের ঠেকানোর ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments