ডিসি সম্মেলন- পথের বাধা অপসারণ করুন by আলী ইমাম মজুমদার
সবেমাত্র জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শেষ
হলো। এ ধরনের সম্মেলন সাধারণত বছরে একবার হয়। সরকারপ্রধান ছাড়াও সব
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবেরা বিভিন্ন অধিবেশনে বিভক্ত এ
সম্মেলনে যোগ দেন। তাঁরা জেলা প্রশাসকদের কাছে জানতে পারেন মাঠপর্যায়ে
উদ্ভূত সমস্যাদি। আলোচনার নিরিখে তাৎক্ষণিক সরকারি নির্দেশনাও দেওয়া হয়
কিছু ক্ষেত্রে। কিছু বিষয় হয়তো-বা সময়ান্তরে বিবেচনার জন্য নেওয়া হয়।
সামগ্রিক দিক থেকে সম্মেলনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় সরকারি
মহলে।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় জেলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর। আর সে জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলন একটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে, এমনটাই স্বাভাবিক। হতে পারে ডিসিরা অনেক বেশি দাবিদাওয়া নিয়ে আসেন সম্মেলনে। এমনকি বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় তাঁরা রাখঢাক ছাড়াই আলোচনা করেন। তবে সবদিক বিবেচনায় অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় তাঁরাও বাস্তবমুখী হতে বাধ্য হন। সর্বোপরি, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জানতে পারেন মন্ত্রীদের কাছ থেকে। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে এ সম্মেলন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে।
আলোচিত সম্মেলনে ডিসিরা বেশ কিছু দাবি ও সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। এগুলো পেশ করা হয়েছে সরকারের কাছে। অনেকগুলো তাৎক্ষণিক আলোচনাতেও স্থান পেয়েছে। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য নেওয়া হয়নি—এমন কথা গণমাধ্যমে জানা যায়। প্রথাগতভাবে সম্মেলনটির সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁদের বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শুনেছেন তাঁদের কিছু কথা। তাঁর নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি হলো: তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা বিধান, খাদ্যে ভেজাল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং নারী-শিশু নির্যাতন ও পাচার, ইভ টিজিং, যৌতুক ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ। নির্দেশনায় আরও রয়েছে জননিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান, কলকারখানায় শান্তিশৃঙ্খলা রাখা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি প্রতিরোধ ইত্যাদি। তা ছাড়া তিনি ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা আর সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে জোর দিয়েছেন। জেলায় চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য দৃষ্টি রাখতেও তিনি নির্দেশ দেন। এসব বিষয় ডিসিদের স্বাভাবিক কাজ। প্রধানমন্ত্রী এ সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়ায় এগুলো তাঁদের অগ্রাধিকারে আসার কথা। ডিসিদের যেকোনো ধরনের ভীতি বা অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
অপর দিকে, ডিসিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তাঁদের দায়িত্ব সম্পাদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাঁরা সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষমতা পাওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে পাহাড় কাটাসংক্রান্ত অপরাধসহ আরও কিছু অপরাধ সংযোজনের প্রস্তাবও করেছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাঁদের বৈঠক হয়েছে। তারাও দিয়েছিল বিভিন্ন নির্দেশনা। ভ্রাম্যমাণ আদালতসংক্রান্ত ডিসিদের প্রস্তাব সুবিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী। তবে তাঁদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার দাবি সমর্থন করেননি তিনি। ডিসিদের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি সম্মেলনে ছিটেফোঁটা আলোচনায় এলেও তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি বলে জানা গেছে।
এখানে যেসব সমস্যা আলোচিত হলো, তার মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডিসিদের কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতা আর স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতার জন্য কোনো আইন সংশোধনের দরকার নেই। বিষয়টি শুধু আইন প্রতিপালনের। মূলত, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬১, পুলিশ আইন ১৮৬১ ও পুলিশ প্রবিধানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক নির্ধারিত আছে। উভয় পক্ষের পদ-পদবি আর ক্ষমতার উৎস প্রধানত উল্লিখিত আইন আর প্রবিধান।
একটি কার্যকর রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ অবস্থা জেনেও না জানার মতো করে দীর্ঘদিন থাকার পরিণতি আইনের শাসনের জন্য সুখকর হচ্ছে না। তার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে র্যাব জেলা পর্যায়ে এসপির সমান্তরাল কর্তৃত্ব নিয়ে চলছে। এসব বিষয় আইনের আলোকে সমন্বয় বিধানের আবশ্যকতা রয়েছে। অ্যাডহক-ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাই জোর দেওয়া দরকার আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থায় দ্রুত ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আর সমন্বয় বিধান। সমন্বয় বিধানের ব্যবস্থাদি পর্যাপ্তই ছিল। তবে ১৯৫৮ আর ১৯৭৫ সালের সরকার পরিবর্তনের পর ডিসির ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস করা হয়। ফলে, এতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ বিষয়ে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থে আন্তবিভাগীয় সম্পর্ক আগের অবস্থান বিষয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের মতে, ‘এই ক্ষমতা ডিসির অন্যায্য কিছু ছিল না, কারণ জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ডিসির এবং আইনশৃঙ্খলা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ অতীত অতীতেই থাকুক। এখন পর্যন্ত আইনে যে বিধান আছে, তা প্রতিপালনে সরকারের কঠোর নির্দেশনা আবশ্যক।
তারপর আসছে ডিসিদের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়। এটা আজ সুবিদিত। আর সব বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। উন্নয়নমূলক কাজে ডিসি/ইউএনওদের দেওয়া ক্ষমতা অনেকাংশেই পরিচালিত হয় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। এমনকি তা হয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়েও। অন্যান্য বিভাগের অবস্থা আরও শোচনীয়। থানায় মামলা নেওয়া আর তদন্তেও একই ধরনের প্রভাববলয় সক্রিয়। এসব বিষয়ে এখন আর রাখঢাক নেই। ক্রমবর্ধমান হারে দৃশ্যমান হচ্ছে এ প্রবণতা। সব ক্ষেত্রে হয়তো নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে এ অবস্থা। কর্মকর্তাদের কেউ একটু স্বতন্ত্রভাবে চলতে চাইলেই অকস্মাৎ ভূতলে পতিত হন। সেই ক্ষেত্রে ভীতি ও অনুরাগের ঊর্ধ্বে থেকে ডিসিদের কাজ করার আহ্বান জানানো কতটা বাস্তবসম্মত, তা বোধগম্য নয়। এ আহ্বানকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে হলে ওপর থেকে নিচে কথায় ও কাজে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। তা না হলে পথের বাধা রয়েই যাবে।
এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বেশ কয়েকজন ডিসি জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের যত সমালোচনাই হোক, বাল্যবিবাহ, খাদ্যে ভেজাল, যৌতুক নিরোধ, ইভ টিজিংসহ কিছু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন। প্রশংসিত হচ্ছে এসব কার্যক্রম। এ অবস্থান ধরে রাখার জন্য তাঁদের সতর্ক থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তাঁরা যাতে ব্যবহৃত না হন, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ডিসিদের স্থানীয় সুশীল সমাজের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তারা অনেক ক্ষেত্রেই ডিসিদের দায়িত্ব সম্পাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কতিপয় অভিযোগে সংবাদপত্রের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা চেয়ে অকারণ বিতর্ক সৃষ্টি করলেন একজন জেলা প্রশাসক। অথচ এর দায় নিতে হচ্ছে সবাইকে।
বেসামরিক প্রশাসন ছাড়া কোনো সরকার চলতে পারে না; গণতান্ত্রিক সরকার তো নয়ই। দক্ষিণ এশিয়ায় এ প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর করেন পারভেজ মোশাররফ তাঁর দেশ পাকিস্তানে। সেটা ২০০১ সাল। তিনি সংকীর্ণ স্বার্থে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করে ফেলেন। ২০০২ সালে চালু হয় নুতন পুলিশ আইন। এসবের ফলে সে দেশে বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা শুধু অকার্যকর নয়, অনেকটা অদৃশ্যও হয়ে পড়েছে। এর পরিণতি সবারই জানা। দেরিতে হলেও তারা ভুল বুঝে পেছনে ফিরতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য, এই অঞ্চলে দেশটি পিছিয়ে পড়েছে প্রায় সব ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, ভারত চটকদারি কথায় মজে এ ধরনের পথে পা বাড়ায়নি। ১৭৭২ সালে হেস্টিংস প্রবর্তিত প্রশাসনিক ব্যবস্থারই কিছু রদবদল করে আজও চালু রাখা হয়েছে। চালু রয়েছে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন। তারা ধরে নিয়েছে, উন্নয়নের পথে পরিচালিত করার জন্য দেশটির প্রয়োজন শক্তিশালী ও কার্যকর প্রশাসনব্যবস্থা। এর সুফলও ভোগ করছে তারা।
আমাদের এখানে এ ধরনের অপরিণামদর্শী সংস্কার কিছু কিছু হয়েছে; তবে ব্যাপকভিত্তিক নয়। আর সৌভাগ্যের বিষয় যে ‘জেলা প্রশাসক’ নামক প্রতিষ্ঠানটি আজও তার কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি। যুগবাহিত রেওয়াজ অনুসারে পদটি মাঠ প্রশাসনের মধ্যমণি রূপে চিহ্নিত। তাই এ ধরনের সম্মেলনে ভাবের লেনদেন সমৃদ্ধ করবে প্রতিষ্ঠানটিকে; ত্বরান্বিত করবে সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন। তবে নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করা আবশ্যক, সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠানকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন এর পথের বাধা অপসারণ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments