নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের সঙ্গে বিএনপির আঁতাত! by কাজী সুমন
নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যেই ওসমান পরিবারের
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন জেলা বিএনপির নেতারা। দলের কর্মীদের মতো
পাহারা দিয়েছেন ভোটকেন্দ্র। জাপা প্রার্থী সেলিম ওসমানের সঙ্গে চালিয়েছেন
প্রচারণা। এমন কি রাখঢাক না করে জনসভা মঞ্চেও উপস্থিত ছিলেন তারা। বিএনপি
নেতাদের বাগে আনতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও ঢেলেছে ওসমান পরিবার। উপনির্বাচনে
সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে কয়েকজনকে বহিষ্কার ও শোকজও করেছেন
জেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। অভিযোগ উঠেছে, বন্দর
উপজেলা নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে ওসমান পরিবারের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন
দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। একই সঙ্গে বহিষ্কার করা হয়েছে তৃণমূলের
প্রার্থীকে। এসব অভিযোগ ও উপনির্বাচনে সেলিম ওসমানের জনসভায় বিএনপি নেতাদের
উপস্থিতির ছবি সংবলিত একটি চিঠি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিয়েছেন
তৃণমূল বিএনপির এক নেতা। এছাড়া উপনির্বাচনের আগের দিন একটি প্রস্তুতি সভায়
সেলিম ওসমানের ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এমপি শামীম ওসমান কর্মীদের
উদ্দেশে বলেছিলেন, বিএনপির বিষয়টি আমি দেখবো, আপনারা আপনাদের কাজগুলো
ঠিকমতো করবেন। পরে ঠিকই দেখা গেছে, নির্বাচনের দিন বিএনপি নেতাদের অবস্থান
ছিল রহস্যজনক। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যক্তিগত কাজে লন্ডন চলে যান তৈমূর
আলম খন্দকার। দলের এই বিপর্যয়ে সময় গুরুত্বপূর্ণ এ জেলার নেতাদের আত্মঘাতী
আচরণে আসন্ন আন্দোলনে সফলতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জের
আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় নিহতের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানানোর জন্য
সমাবেশের আয়োজন করতে পারেনি জেলা বিএনপি। প্রশাসনের বাধায় বাধ্য হয়ে খালেদা
জিয়া তাদের বাসায় যান। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেনি
জেলা বিএনপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ই জুন বন্দর উপজেলা নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন আতাউর রহমান মুকুল ও নুরুদ্দিন। প্রার্থিতা ঘোষণার শুরু থেকেই স্থানীয় বিএনপি নূরুদ্দিনকে সমর্থন দেন। এদিকে নিজের নির্বাচনী ভোটব্যাংক বন্দরের বিএনপির ভোটারদের পক্ষে টানতে চতুর কৌশল নেন সেলিম ওসমান। তিনি রফাদফা করেন গৌণ প্রার্থী আতাউর রহমান মুকুলের সঙ্গে। মুকুলকে জেতাতে বন্দরে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় গৌণ প্রার্থীকে। কেন্দ্র থেকে মুকুলকে সমর্থন দেয়ার জন্য নেপথ্যে কাজ করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনির ও মোহাম্মদ আলী। উপজেলা নির্বাচনের দু’দিন আগে কেন্দ্র থেকে সমর্থন দেয়া হয় মুকুলকে। বহিষ্কার করা হয় নুরুদ্দিনকে। ওসমান পরিবারের আশীর্বাদে বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মুকুল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন তৃতীয়। এরপর এক জনসভায় উপজেলা চেয়ারম্যান মুকুল ভোট চান সেলিম ওসমানের পক্ষে। তার এ বক্তব্যের রেকর্ডিং প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারকে শোনানো হয়। জেলা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী উপনির্বাচনে সরাসরি সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করেন। অংশ নেন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। উপস্থিত হন সেলিম ওসমানের জনসভায়। পৌর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমও কাজ করেন সেলিম ওসমানের হয়ে। নির্বাচনী প্রচারণাসহ নির্বাচনী জনসভায় অংশ নেন তিনি। যদিও পরে তিনি দাবি করেন, বিএনপি নেতা হিসেবে নয়, ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ওই জনসভায় অংশ নেন। বন্দরের ১৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন দেওয়ান প্রকাশ্যে প্রচারণা চালান সেলিম ওসমানের পক্ষে। দ্বারে দ্বারে গিয়ে তার মার্কায় ভোট চান তিনি। অংশ নেন জনসভায়। এ অভিযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার হোসেনকে বহিষ্কার করেন জেলা বিএনপির সভাপতি এড. তৈমূর আলম খন্দকার। এছাড়া একই অভিযোগে আরও কয়েকজনকে শোকজ করেন তিনি। নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজিব নিজেও সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করেন। ছাত্রদলের কর্মীদের নিয়ে নিজেই খানপুরের বার একাডেমি স্কুলের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেন। সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত তিনি ওই ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। সেলিম ওসমান নির্বাচনে পাস করার পর ফুল নিয়ে আবুল কালামের বাসায় যান এবং তার দোয়া নিয়ে আসেন। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ করা হয়। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনির কৌশলে সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করার জন্য শিল্পপতি বন্ধুদের নির্দেশ দেন।
এদিকে গত ৯ই জুলাই নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বরাবর একটি চিঠি দেন মো. শাহীন মিয়া নামের নারায়ণগঞ্জ তৃণমূল বিএনপির এক কর্মী। ওই চিঠিটি গ্রহণ করেন বিএনপি কার্যালয়ের কর্মকর্তা আবদুল গাফফার। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, নারায়ণগঞ্জ-৫ উপনির্বাচনে জাপা প্রার্থী সেলিম ওসমানের জয়ের নেপথ্যে কাজ করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনির, ওই আসনের সাবেক এমপি আবুল কালাম ও বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল। প্রথমে তারা সেলিম ওসমানকে বিজিত করতে বিএনপির ভোটারদের উৎসাহিত করেন। নিজের পরাজয় বুঝতে পেরে ওইসব নেতার সঙ্গে আঁতাত করেন সেলিম ওসমান। উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল, সাবেক এমপি আবুল কালাম ও জাহাঙ্গীর আলম সরাসরি নামেন সেলিম ওসমানের পক্ষে। আর কাজী মনির ও শিল্পপতি মো. আলী কাজ করেন নেপথ্যে। ১৫ই জুন বন্দরের কদমরসুল মাঠে এক জনসভায় সেলিম ওসমানের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান মুকুল অতিথি হয়ে একসঙ্গে মঞ্চে বসেন। মুকুলের সঙ্গে সেলিম ওসমানের সেই ছবি স্থানীয় মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে জাপা প্রার্থী বর্তমান এমপি সেলিম ওসমান চেয়েছিলেন মুকুল ও কালামের মাধ্যমে বিএনপির ভোটগুলো যেন তার বাগে আনতে পারেন। কিন্তু ২২শে জুনের পর পরে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। নির্বাচনে সব স্থান থেকে ম্যাসেজ আসতে থাকে বিএনপি ভোটাররা কেন্দ্রে গেলে সেলিম ওসমানের পরাজয় নিশ্চিত। সঙ্গে সঙ্গে সাবেক এমপি কালাম, বিএনপি নেতা কাজী মনির, শিল্পপতী মো. আলী তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনেন। ওসমান পরিবারে আস্থাভাজন এসব নেতা সেলিম ওসমানকে জানিয়ে দেন, বিএনপির ভোটাররা সরকারি তথা ওসমান পরিবারকে ভোট দেবে না। তারা কেন্দ্রে গেলে সর্বনাশ হবে সেলিম ওসমানের।
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম আকরাম জোর দিয়ে প্রচারণায় বলে যাচ্ছিলেন বিএনপি ভোটাররা তাকেই ভোট দেবে। এরপরেই সেলিম ওসমানপন্থিরা মাঠে নামে বিএনপি ভোটার ঠেকাও। নতুন কৌশলে এগোতে থাকে তারা। দু’দফা মুকুল ও কালামের সঙ্গে বৈঠক করেন সেলিম ওসমান। তাদের এ বৈঠকে নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়েন রূপগঞ্জের বিএনপি শীর্ষ নেতা কাজী মনির ও ফতুল্লার শিল্পপতি মো. আলী। বৈঠকে মূল এজেন্ডা ছিল কালাম, মুকুল ও কাজী মনিরকে বিএনপির কেন্দ্র থেকে বিএনপির ভোট বর্জনের ঘোষণা এনে দিতে হবে। তাহলেই নিরাশ হয়ে বিএনপি ভোটাররা কেন্দ্রে যাবে না। কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত আনতে যত টাকা লাগবে দেবে বলে জানান সেলিম ওসমান। কথামতো কাজ, নির্বাচনের ২ দিন আগে ২৪শে জুন বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান মুকুল ঘোষণা দেন এ নির্বাচন বর্জনের। যা বিভিন্ন মিডিয়ার প্রকাশ পায়। কালাম, মুকুল ও কাজী মনির অত্যন্ত কৌশলে এ কেন্দ্র থেকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন যাতে সেলিম ওসমানের বিজয়ে বাধা না থাকে। শুধু তাই নয়, বন্দর এলাকায় বিএনপির ভোটারদের ব্রেন ওয়াশ করে এ নির্বাচনে সেলিম ওসমানের বিজয় হবে। তাই কেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই। কৌশলে বিএনপি ভোটারদের হুমকিও দেয়া হয়, কেউ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে ওসমান পরিবার নজরে পড়লে কিছু করার নেই। আমাদের এখন দুঃসময়। দল ক্ষমতায় নেই। আমরা নিজেরাই বিপদে আছি। এসব অভিযোগের ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরের মোবাইলে অনেকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি। ম্যাসেজ দিলেও কোন উত্তর দেননি।
তবে জেলা বিএনপির সভাপতি এড. তৈমূর আলম খন্দকার মানবজমিনকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ বিএনপির একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরেই আঁতাত করে চলছে। গত আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও ওই চক্রটির বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়নি। ওই চক্রের ওসমান পরিবারের তোষামোদীর বক্তব্যের রেকর্ড বিএনপির নীতিনির্ধারকদের শুনিয়েছি। তারপরও অদৃশ্য কারণে কেন্দ্র থেকে তারা সমর্থন পেয়ে যায়। এই উপনির্বাচনেও বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন নেতা সেলিম ওসমানের পক্ষে প্রকাশ্যেই কাজ করেছে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি বদরুজ্জামান খান খসরু বলেন, ৫ই জানুয়ারির পরে গণতন্ত্র হত্যাকারী অবৈধ সরকারের এই উপনির্বাচনেও কারচুপি হয়েছে। এই নির্বাচনে বিএনপির কোন অংশগ্রহণ ছিল না। বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা ওসমান পরিবারের সঙ্গে আঁতাত করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এদিকে চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কার্যালয়ে পাঠালেও আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।
No comments