মমতাময়ী এক শিক্ষিকার গল্প by আশরাফুল ইসলাম
ঘটনাটি
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের
প্রত্যন্ত পাঁচধা গ্রামের রাস্তায় স্কুটির শব্দে চমকিত হন গ্রামবাসী।
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তারা দেখেন, স্কুটিটি চালাচ্ছেন সালোয়ার-কামিজ পরা
কমবয়সী এক নারী। যে গ্রামের রাস্তায় কোন নারীকে এর আগে কেউ বাইসাইকেল
চালাতে দেখেননি, সেখানে একজন নারীকে স্কুটি চালাতে দেখে কৌতূহলী গ্রামবাসীর
চমক যেন ভাঙে না। স্কুটিটি যখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সামনে গিয়ে
থামে, তখন চারপাশে বেশ বড়সড় একটি জটলা লেগে যায়। দেখেন স্কুটিটির চালক
বিদ্যালয়েরই এক শিক্ষিকা।
শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। একেবারেই এমন অচেনা দৃশ্য দেখে এক কান-দুই কান হয়ে মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। শুরু হয় চারদিকে ফিসফাস। কিন্তু সেই ফিসফাস, আলোচনা-সমালোচনা কিছুক্ষণ পরেই থেমে যায়। কেননা, মাত্র নয় মাস আগে বিদ্যালয়টিতে যোগ দেয়া এই তরুণী শিক্ষিকা যে খুব কম সময়েই এলাকার মানুষের হৃদয়ে নিজ কর্মগুণে জায়গা করে নিয়েছেন। অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত এই গ্রামের শিশুদের কাছে হয়ে ওঠেছেন মমতার মূর্ত প্রতীক। আদর, যত্ন আর ভালবাসায় তাদের ভরিয়ে দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রতি ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন শিশুদের। হাসি-আনন্দে মশগুল শিশুরা তার কাছে নিচ্ছে মানুষ হওয়ার দীক্ষা। শুধু কী তাই! পরিবারের একজনের মতো কেটে দিচ্ছেন শিশুদের হাতের নখ, সেলাই করে দিচ্ছেন জামার ছিঁড়ে যাওয়া বোতাম, ছেঁড়া জামা। পাঠভ্যাসের পাশাপাশি বদলে দিচ্ছেন শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও। শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব দিকেই যে মায়ের মতো মমতা আর স্নেহ বিলাচ্ছেন তিনি। পাঁচধার নিভৃত পল্লীজুড়ে কেবল তার মমতারই ছায়া। আর এই মমতার চাদরেই চাপা পড়ে যায় গ্রামের সেইসব আলোচনা-সমালোচনা। এরপর থেকে সকল প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে নিয়মিত স্কুটি চালিয়েই স্কুলে যাতায়াত করছেন তিনি। শিশু শিক্ষার্থীরাও প্রতীক্ষায় থাকে স্কুটির শব্দের। স্কুটির শব্দ শুনেই তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। জেনে যায়, তাদের প্রিয় দিদিমণি স্কুলে এসে গেছেন। স্কুটি চালিয়ে তার এই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসায় এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জাগরণ। আপনা মাঝে শক্তি ধরে নিজেকে জয় করা এই মানুষটির নাম শান্তা ইসলাম। তিনি পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাবাড়িয়া গ্রামে। বাবা মো. শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। মা জেবুন্নেচ্ছা বেবী একজন গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে বড় শান্তা। ছোট বোনের নাম শুকরানা ইসলাম। দুই বোনই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শান্তা ইসলাম জানান, ‘পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে আদর্শ মানতেন বাবা মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলতেন, ‘শিক্ষকতার চেয়ে সম্মানের চাকরি আর কোনটি নেই। আমি যদি আরেকটু পড়াশুনা করতে পারতাম, তাহলে শিক্ষক হতাম।’ বাবা তার জীবনে যা করতে পারেননি, যা পাননি সে জিনিসগুলো আমাদের দিয়ে পূরণ করার স্বপ্ন বুনেছিলেন। বাবার স্বপ্নের মাঝেই আমরা সব সময় নিজের স্বপ্নকে খুঁজেছি। বাবার উৎসাহেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে আবেদন করা, বাবার গাইডলাইনে প্রস্ততি গ্রহণ এবং কয়েকবার চেষ্টার পর সফল হওয়া। ২০১৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (প্রাক-প্রাথমিক) হিসেবে যোগদান করি। তাই শিক্ষকতা মতো একটি দায়িত্বশীল পেশায় থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’ ২০১৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর প্রত্যন্ত এলাকার এই কর্মস্থলটিতে দুর্গম যোগাযোগের কারণে বিড়ম্বনার শেষ ছিল না শান্তার। এই যোগাযোগ বিড়ম্বনাই মনের ভেতরের স্বপ্নটাকে উসকে দেয় তার। ছোট্টবেলার সাইকেল চালানোর অভ্যাসকে কাজে লাগিয়ে স্কুটি কেনার কথা ভাবেন শান্তা। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে খুব সহজে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাও সম্ভব ছিল না। শান্তা জানান, ‘পুতুল নিয়ে খেলার বয়স থেকেই সাইকেলের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। আমার ছোট বোনটি যখন ঘরের কোণে পুতুল নিয়ে খেলত, তখন আমি সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে হাত-পায়ে ব্যথা নিয়ে ঘরে ফিরতাম। বাবার উৎসাহে পাঁচ বছর বয়সেই সাইকেল চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠি। আমাদের এলাকায় আমিই প্রথম মেয়ে যে সাইকেলে চড়ে প্রাইমারি স্কুলে যেতাম। এরপর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক উভয়টিতেই সাইকেলে চড়ে শহরের স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করি। তখনও শহরের কোন মেয়েকে দেখিনি সাইকেলে চড়ে স্কুলে বা কলেজে যেতে। বাবা বলতেন, ‘তোমাকে একদিন বাইক কিনে দিব।’ শুনে কি যে আনন্দ হতো! কিন্তু অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি বাবার পক্ষে। পরে সৃষ্টিকর্তায় অসীম কৃপায় আমি যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন পণ করি যে, এবার আমি নিজের টাকায়ই বাইক কিনব। প্রতি মাসে সাংসারিক খরচের পর যে টাকা থাকত, সেটা জমাতে শুরু করি। সাত মাসের ব্যবধানে স্বপ্নের স্কুটিটি কিনতে সমর্থ হই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে স্কুটিতে চড়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। যেটি দেখে বিস্মিত হয় সবাই! অনেকে বাহবা দেয়, অনেকে পিছে মন্দ বলে। আমাদের সমাজে মন্দ বলার লোকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু আমি পজেটিভলি নেই সবই। কারণ আমি চাই আমাকে দেখে উৎসাহিত হোক আরও মেয়েরা।’ প্রতিদিন স্কুটি চালিয়ে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে এখন নিয়মিত বিদ্যালয় করছেন শান্তা। পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের শিক্ষকতা জীবন তার। কিন্তু এই অল্প সময়েই শিক্ষকসমাজের আদর্শ হয়ে ওঠেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে শান্তা ইসলাম জানান, ‘শিক্ষকতায় যোগদানের পূর্বে আমার ভাল লাগা, ভাল থাকাগুলো স্বার্থপর ছিল। এই কচি কচি অসচ্ছল পরিবারের মুখগুলো আমাকে আমার ভাললাগা, ভাল থাকায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার দায়বদ্ধতায় আমি জড়িয়ে পড়েছি। আমার আনন্দগুলো ওদের আনন্দে মিশে গেছে। ওদের খুশি রাখতে পারলে আমার খুশি লাগে, ওদের ছোট একটা আবদার পূরণ করতে পারলে আমি ধন্য হই। এই শিশুদের খুশি রাখাটাই এখন আমার জীবনের ব্রত হয়ে গেছে। ওদের যেন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হয়, ওরা যেন কিছু ভাল অভ্যেস গড়ে তুলে যেমন সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পরিষ্কার পোশাক পরে স্কুলে আসা, জুতো পরে থাকার অভ্যেস, নিয়মিত নখ কাটা, হাত ধোয়া, চুল ছাটা, দাঁত মাজা, গোসল করা, চুলে তেল দেয়া, কারো পোশাক ছিঁড়ে গেলে, বোতাম ছিঁড়ে গেলে ওসব ঠিক করে দেয়া যেগুলো সাধারণত পরিবারে বাবা-মার দেখার কথা এই সব বিষয়গুলোর প্রতিই দৃষ্টি দিতে হয় আমাকে। কারণ এই স্কুল, এই শিশুদের, এই জীবনটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি বোধ হয়! শিশুদের নিয়ে বাগান করা, শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয়ের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজগুলো নিজ দায়িত্বেই করে থাকি। প্রতিটি কাজেই মনে হয়, এটা যদি আমি না করি তাহলে কে করবে? আমি কাজটা না করে রেখে দিলে পরে যদি অন্য কেউ না করে!’ কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামীল বলেন, শক্তি, সাহস আর উদ্যম নিয়ে নারীরা আজ ঠিকই সাফল্যের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের সাফল্যের গল্প রচনা করছেন। আমাদের শান্তা ইসলামও সেরকম একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। শান্তা ইসলামকে দেখে অন্যরাও অনুপ্রাণিত ও দায়িত্বশীল হবেন বলেই আমরা প্রত্যাশা করি।
শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। একেবারেই এমন অচেনা দৃশ্য দেখে এক কান-দুই কান হয়ে মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। শুরু হয় চারদিকে ফিসফাস। কিন্তু সেই ফিসফাস, আলোচনা-সমালোচনা কিছুক্ষণ পরেই থেমে যায়। কেননা, মাত্র নয় মাস আগে বিদ্যালয়টিতে যোগ দেয়া এই তরুণী শিক্ষিকা যে খুব কম সময়েই এলাকার মানুষের হৃদয়ে নিজ কর্মগুণে জায়গা করে নিয়েছেন। অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত এই গ্রামের শিশুদের কাছে হয়ে ওঠেছেন মমতার মূর্ত প্রতীক। আদর, যত্ন আর ভালবাসায় তাদের ভরিয়ে দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রতি ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন শিশুদের। হাসি-আনন্দে মশগুল শিশুরা তার কাছে নিচ্ছে মানুষ হওয়ার দীক্ষা। শুধু কী তাই! পরিবারের একজনের মতো কেটে দিচ্ছেন শিশুদের হাতের নখ, সেলাই করে দিচ্ছেন জামার ছিঁড়ে যাওয়া বোতাম, ছেঁড়া জামা। পাঠভ্যাসের পাশাপাশি বদলে দিচ্ছেন শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও। শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব দিকেই যে মায়ের মতো মমতা আর স্নেহ বিলাচ্ছেন তিনি। পাঁচধার নিভৃত পল্লীজুড়ে কেবল তার মমতারই ছায়া। আর এই মমতার চাদরেই চাপা পড়ে যায় গ্রামের সেইসব আলোচনা-সমালোচনা। এরপর থেকে সকল প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে নিয়মিত স্কুটি চালিয়েই স্কুলে যাতায়াত করছেন তিনি। শিশু শিক্ষার্থীরাও প্রতীক্ষায় থাকে স্কুটির শব্দের। স্কুটির শব্দ শুনেই তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। জেনে যায়, তাদের প্রিয় দিদিমণি স্কুলে এসে গেছেন। স্কুটি চালিয়ে তার এই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসায় এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জাগরণ। আপনা মাঝে শক্তি ধরে নিজেকে জয় করা এই মানুষটির নাম শান্তা ইসলাম। তিনি পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাবাড়িয়া গ্রামে। বাবা মো. শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। মা জেবুন্নেচ্ছা বেবী একজন গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে বড় শান্তা। ছোট বোনের নাম শুকরানা ইসলাম। দুই বোনই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শান্তা ইসলাম জানান, ‘পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে আদর্শ মানতেন বাবা মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলতেন, ‘শিক্ষকতার চেয়ে সম্মানের চাকরি আর কোনটি নেই। আমি যদি আরেকটু পড়াশুনা করতে পারতাম, তাহলে শিক্ষক হতাম।’ বাবা তার জীবনে যা করতে পারেননি, যা পাননি সে জিনিসগুলো আমাদের দিয়ে পূরণ করার স্বপ্ন বুনেছিলেন। বাবার স্বপ্নের মাঝেই আমরা সব সময় নিজের স্বপ্নকে খুঁজেছি। বাবার উৎসাহেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে আবেদন করা, বাবার গাইডলাইনে প্রস্ততি গ্রহণ এবং কয়েকবার চেষ্টার পর সফল হওয়া। ২০১৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (প্রাক-প্রাথমিক) হিসেবে যোগদান করি। তাই শিক্ষকতা মতো একটি দায়িত্বশীল পেশায় থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’ ২০১৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর প্রত্যন্ত এলাকার এই কর্মস্থলটিতে দুর্গম যোগাযোগের কারণে বিড়ম্বনার শেষ ছিল না শান্তার। এই যোগাযোগ বিড়ম্বনাই মনের ভেতরের স্বপ্নটাকে উসকে দেয় তার। ছোট্টবেলার সাইকেল চালানোর অভ্যাসকে কাজে লাগিয়ে স্কুটি কেনার কথা ভাবেন শান্তা। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে খুব সহজে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাও সম্ভব ছিল না। শান্তা জানান, ‘পুতুল নিয়ে খেলার বয়স থেকেই সাইকেলের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। আমার ছোট বোনটি যখন ঘরের কোণে পুতুল নিয়ে খেলত, তখন আমি সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে হাত-পায়ে ব্যথা নিয়ে ঘরে ফিরতাম। বাবার উৎসাহে পাঁচ বছর বয়সেই সাইকেল চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠি। আমাদের এলাকায় আমিই প্রথম মেয়ে যে সাইকেলে চড়ে প্রাইমারি স্কুলে যেতাম। এরপর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক উভয়টিতেই সাইকেলে চড়ে শহরের স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করি। তখনও শহরের কোন মেয়েকে দেখিনি সাইকেলে চড়ে স্কুলে বা কলেজে যেতে। বাবা বলতেন, ‘তোমাকে একদিন বাইক কিনে দিব।’ শুনে কি যে আনন্দ হতো! কিন্তু অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি বাবার পক্ষে। পরে সৃষ্টিকর্তায় অসীম কৃপায় আমি যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন পণ করি যে, এবার আমি নিজের টাকায়ই বাইক কিনব। প্রতি মাসে সাংসারিক খরচের পর যে টাকা থাকত, সেটা জমাতে শুরু করি। সাত মাসের ব্যবধানে স্বপ্নের স্কুটিটি কিনতে সমর্থ হই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে স্কুটিতে চড়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। যেটি দেখে বিস্মিত হয় সবাই! অনেকে বাহবা দেয়, অনেকে পিছে মন্দ বলে। আমাদের সমাজে মন্দ বলার লোকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু আমি পজেটিভলি নেই সবই। কারণ আমি চাই আমাকে দেখে উৎসাহিত হোক আরও মেয়েরা।’ প্রতিদিন স্কুটি চালিয়ে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে এখন নিয়মিত বিদ্যালয় করছেন শান্তা। পাঁচধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের শিক্ষকতা জীবন তার। কিন্তু এই অল্প সময়েই শিক্ষকসমাজের আদর্শ হয়ে ওঠেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে শান্তা ইসলাম জানান, ‘শিক্ষকতায় যোগদানের পূর্বে আমার ভাল লাগা, ভাল থাকাগুলো স্বার্থপর ছিল। এই কচি কচি অসচ্ছল পরিবারের মুখগুলো আমাকে আমার ভাললাগা, ভাল থাকায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার দায়বদ্ধতায় আমি জড়িয়ে পড়েছি। আমার আনন্দগুলো ওদের আনন্দে মিশে গেছে। ওদের খুশি রাখতে পারলে আমার খুশি লাগে, ওদের ছোট একটা আবদার পূরণ করতে পারলে আমি ধন্য হই। এই শিশুদের খুশি রাখাটাই এখন আমার জীবনের ব্রত হয়ে গেছে। ওদের যেন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হয়, ওরা যেন কিছু ভাল অভ্যেস গড়ে তুলে যেমন সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পরিষ্কার পোশাক পরে স্কুলে আসা, জুতো পরে থাকার অভ্যেস, নিয়মিত নখ কাটা, হাত ধোয়া, চুল ছাটা, দাঁত মাজা, গোসল করা, চুলে তেল দেয়া, কারো পোশাক ছিঁড়ে গেলে, বোতাম ছিঁড়ে গেলে ওসব ঠিক করে দেয়া যেগুলো সাধারণত পরিবারে বাবা-মার দেখার কথা এই সব বিষয়গুলোর প্রতিই দৃষ্টি দিতে হয় আমাকে। কারণ এই স্কুল, এই শিশুদের, এই জীবনটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি বোধ হয়! শিশুদের নিয়ে বাগান করা, শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয়ের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজগুলো নিজ দায়িত্বেই করে থাকি। প্রতিটি কাজেই মনে হয়, এটা যদি আমি না করি তাহলে কে করবে? আমি কাজটা না করে রেখে দিলে পরে যদি অন্য কেউ না করে!’ কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামীল বলেন, শক্তি, সাহস আর উদ্যম নিয়ে নারীরা আজ ঠিকই সাফল্যের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের সাফল্যের গল্প রচনা করছেন। আমাদের শান্তা ইসলামও সেরকম একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। শান্তা ইসলামকে দেখে অন্যরাও অনুপ্রাণিত ও দায়িত্বশীল হবেন বলেই আমরা প্রত্যাশা করি।
No comments