২০১৮ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কি আদৌ শুরু হবে? by নাজমুস সাদাত পারভেজ
নভেম্বরের
২৩ তারিখে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যকার স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসন চুক্তির ফলে কিছু ইতিবাচক প্রত্যাশা যেমন তৈরি হয়েছে, ঠিক
তেমনি তৈরি হয়েছে কিছু নেতিবাচক আশঙ্কাও। চুক্তিতে শিগগির রোহিঙ্গাদের
মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, অদূর ভবিষ্যতে
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। মিয়ানমার থেকে
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা যদি সেখানে ফিরে যেতে চায়, তবে
সবার আগে তাদের প্রয়োজন হবে একটি বাসযোগ্য পরিস্থিতির নিশ্চয়তা। নৃশংসতার
জেরে পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া এসব রোহিঙ্গার মাতৃভূমি মিয়ানমার। প্রজন্মের
পর প্রজন্ম তারা সেখানেই বসবাস করেছে।
নিতান্ত বাধ্য না হলে তারা কেন বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে দিনাতিপাত করতে চাইবে? একটি দেশের আশ্রিত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুব বেশি কিছু আশা করতে পারে না। অন্তত পূর্ণ নাগরিক সুবিধা তো না-ই। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং ইতিবাচক পরিবেশ পেলে মিয়ানমারেই ফিরে যেতে চাইবে। তবে এই ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করার জন্যে পরিবর্তন হওয়া লাগবে অনেক কিছুরই।
প্রথমত, সবার আগে তাদের শারীরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা এখন একটি চরম ভীত-সন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকেই যে পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অথবা তা প্রত্যক্ষ করেছেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তারা খুব সহজে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবেন না। আর এই নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের অবস্থান বড় একটি ফাঁক তৈরি করেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সীমাহীন বর্বরতা হয়েছে, তা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় স্বীকৃত। এই নৃশংসতাকে জাতি নিধনের সপষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কিংবা সাহায্যকারী সংস্থাগুলো রীতিমতো সমালোচনায় ধুয়ে ফেলছে মিয়ানমারকে। সে দেশের নেত্রী অং সান সুচির আন্তর্জাতিক কিছু পুরস্কারও প্রত্যাহার করা হয়েছে। মোট কথা, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে কি পরিমাণ অনাচার আর অন্যায় করা হয়েছে, তা সারা বিশ্বই জানে। তারপরও, মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। তারা দাবি করেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো ধরনের নৃশংসতা ঘটেনি! সেখানে নাকি সাধারণ রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে একটি গুলিও ছোড়া হয়নি! যেখানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এবং সংবাদ সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতাকে ‘মানবতার লঙ্ঘন’ বলে প্রতিনিয়ত নিন্দা জানিয়ে আসছে, সেখানে মিয়ানমারের সরকার, সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করছে- কোনো সহিংসতাই হয়নি! উল্লেখ্য, ওই সহিংসতায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরাও। তবে তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই! কারণ, তারা সেনাবাহিনীর মদতপুষ্ট। যেখানে মিয়ানমারের সরকার পুরো নৃশংসতার বিষয়টি অস্বীকার করছে, সেখানে রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের ওপর আবার অত্যাচার করা হবে না- এমন নিশ্চয়তার আশা তারা নিশ্চয়ই করতে পারে না! এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গারা কি আদৌ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে?
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারে ফিরে গেলে সেখানে জীবনধারণের যাবতীয় সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ দিতে হবে রোহিঙ্গাদের। স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তিমতে, রোহিঙ্গাদের তাদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে দেওয়া হবে। এখন, যদি সত্যিই তাদের জমিজমা ফিরিয়ে দেয়া হয়, তবে মৌলিকভাবেই তাদের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জীবনধারণের জন্যে তাদের চাষাবাস এবং ব্যবসা বাণিজ্যে অংশ নিতে হবে। এ জন্যে সবার আগে তাদের শারীরিক নিরাপত্তা পুনঃনিশ্চিত করতে হবে। ২০১৬-১৭ সালে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার পরে জারি করা কারফিউ তুলে নিতে হবে। খেয়াল রাখা উচিত, রাখাইনে বসবাসকারী সমপ্রদায়সমূহ পরসপরের ওপর নির্ভরশীল। সেখানের বৌদ্ধ ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গা কৃষক এবং জেলেদের কাছ থেকে ফসলাদি কেনে। তাই স্থানীয় অর্থনীতি অনেকটাই রোহিঙ্গা মুসলিমদের শ্রমনির্ভর। সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাতিবিদ্বেষের মতো যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, তার ফলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্য সমপ্রদায়ের তৈরি হওয়া দূরত্ব, অবিশ্বাস এবং সন্দেহ খুব সহজে দূর হবে না। এর অর্থনৈতিক প্রভাবও থাকবে। সুতরাং, ফিরে গেলেই কিন্তু পূর্বেকার জীবন ফিরে পাবে না রোহিঙ্গারা। তাদের একটি নতুন এবং ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
তৃতীয়ত, মিয়ানমারে ফিরে গেলে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা প্রয়োজন হবে রোহিঙ্গাদের। খেয়াল রাখতে হবে, সেখানে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) মতো একটি উগ্রপন্থী সংগঠন কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর চলতে থাকা নির্যাতন ও প্রান্তিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে যে হতাশা এবং ক্ষোভ তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, আরসা তারই ফসল। হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে খুব সহজেই কিছু রোহিঙ্গা আরসার মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে, যদি মিয়ানমারে সার্বিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হয়, তবে রোহিঙ্গারা পূর্বের মতো হতাশাগ্রস্ত পরিবেশে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে না।
প্রয়োজন অর্থবহ অগ্রগতি
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে হলে প্রয়োজন অর্থবহ অগ্রগতি। এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় করণীয় উল্লেখ করে একটি নির্দেশনাও দিয়েছে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা কমিশন। যদিও মিয়ানমারের সরকার ওই নির্দেশনাসমূহ গ্রহণ করেছে, তবে তা দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আনান কমিশনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি বাস্তবায়ন কমিটি যদিও গঠন করা হয়েছে; ঐ কমিটি নির্দেশনা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায়োগিক দিকে নজর না দিয়ে কূটনৈতিক কৌশলের দিকেই বেশি মনোযোগী বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা প্রয়োজন। পাশাপাশি, মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিশ্বাসযোগ্য ও সুসপষ্ট নিশ্চয়তা দিতে হবে। থামাতে হবে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকারী উগ্র বৌদ্ধ সমপ্রদায়গুলোকে। এছাড়াও, শুধুমাত্র উত্তর রাখাইনে নিযুক্ত প্যারামিলিটারি সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অপসারণ করে এর জায়গায় একটি নতুন বাহিনী নিযুক্ত করাও উচিত হবে। কারণ, পূর্বেকার বাহিনী রাখাইনে সংঘটিত সহিংসতায় খুব ভালোভাবেই জড়িত ছিল। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী থেকে নতুন সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনী এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন সহজ হবে। সেইসঙ্গে মিয়ানমারে বর্তমানে বসবাসরত ও ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত-যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে হলে সরকারের বর্তমান দুই ধাপের নাগরিকত্ব প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। উল্লেখ্য, ওই প্রক্রিয়ার আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রথমে জাতীয় প্রমাণপত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। অধিকাংশ রোহিঙ্গা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব পাওয়ার শঙ্কায় ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়াতেই অনিহা বোধ করে। কিছু রোহিঙ্গা অবশ্য ওই প্রক্রিয়ায় আবেদন করে দ্বিতীয় সারির নাগরিকত্ব পেয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের প্রণীত এবং বর্তমানে বহাল নাগরিক আইন অনুযায়ীও, অধিকাংশ রোহিঙ্গা পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবার যোগ্য। দ্বিতীয় সারির নাগরিকত্ব পাওয়া রোহিঙ্গারাও যে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের চেয়ে খুব একটা ভালো আছে, তাও কিন্তু বলা যাবে না। তাদেরকে নিরাপত্তার নামে স্থাপন করা ক্যামপগুলোতে কার্যত বন্দিই করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের শহরের ভেতরে বা বাইরে যেতে দেয়া হয় না। এ ধরনের প্রবল বৈষম্যকর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে। দিতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার সুবিধা। নিশ্চিত করতে হবে চাকরি খাতে তাদের বিনা বৈষম্যে অংশগ্রহণের সুযোগ।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেয়া অনেকটাই অসম্ভব। কারণ এ ধরনের উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর; বিশেষ করে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের। এছাড়াও, সরকারি সংস্থাগুলোতেও এ ব্যাপারে খুব ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না। তাই, পরিশেষে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সুচি এবং তার সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েও থাকেন, রোহিঙ্গাদের সফল প্রত্যবাসন কর্মসূচি সফল করতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কিন্তু দৃশ্যমান হয়নি।
(নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ অবলম্বনে)
নিতান্ত বাধ্য না হলে তারা কেন বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে দিনাতিপাত করতে চাইবে? একটি দেশের আশ্রিত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুব বেশি কিছু আশা করতে পারে না। অন্তত পূর্ণ নাগরিক সুবিধা তো না-ই। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং ইতিবাচক পরিবেশ পেলে মিয়ানমারেই ফিরে যেতে চাইবে। তবে এই ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করার জন্যে পরিবর্তন হওয়া লাগবে অনেক কিছুরই।
প্রথমত, সবার আগে তাদের শারীরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা এখন একটি চরম ভীত-সন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকেই যে পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অথবা তা প্রত্যক্ষ করেছেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তারা খুব সহজে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবেন না। আর এই নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের অবস্থান বড় একটি ফাঁক তৈরি করেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সীমাহীন বর্বরতা হয়েছে, তা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় স্বীকৃত। এই নৃশংসতাকে জাতি নিধনের সপষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কিংবা সাহায্যকারী সংস্থাগুলো রীতিমতো সমালোচনায় ধুয়ে ফেলছে মিয়ানমারকে। সে দেশের নেত্রী অং সান সুচির আন্তর্জাতিক কিছু পুরস্কারও প্রত্যাহার করা হয়েছে। মোট কথা, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে কি পরিমাণ অনাচার আর অন্যায় করা হয়েছে, তা সারা বিশ্বই জানে। তারপরও, মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। তারা দাবি করেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো ধরনের নৃশংসতা ঘটেনি! সেখানে নাকি সাধারণ রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে একটি গুলিও ছোড়া হয়নি! যেখানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এবং সংবাদ সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতাকে ‘মানবতার লঙ্ঘন’ বলে প্রতিনিয়ত নিন্দা জানিয়ে আসছে, সেখানে মিয়ানমারের সরকার, সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করছে- কোনো সহিংসতাই হয়নি! উল্লেখ্য, ওই সহিংসতায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরাও। তবে তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই! কারণ, তারা সেনাবাহিনীর মদতপুষ্ট। যেখানে মিয়ানমারের সরকার পুরো নৃশংসতার বিষয়টি অস্বীকার করছে, সেখানে রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের ওপর আবার অত্যাচার করা হবে না- এমন নিশ্চয়তার আশা তারা নিশ্চয়ই করতে পারে না! এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গারা কি আদৌ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে?
দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারে ফিরে গেলে সেখানে জীবনধারণের যাবতীয় সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ দিতে হবে রোহিঙ্গাদের। স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তিমতে, রোহিঙ্গাদের তাদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে দেওয়া হবে। এখন, যদি সত্যিই তাদের জমিজমা ফিরিয়ে দেয়া হয়, তবে মৌলিকভাবেই তাদের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জীবনধারণের জন্যে তাদের চাষাবাস এবং ব্যবসা বাণিজ্যে অংশ নিতে হবে। এ জন্যে সবার আগে তাদের শারীরিক নিরাপত্তা পুনঃনিশ্চিত করতে হবে। ২০১৬-১৭ সালে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার পরে জারি করা কারফিউ তুলে নিতে হবে। খেয়াল রাখা উচিত, রাখাইনে বসবাসকারী সমপ্রদায়সমূহ পরসপরের ওপর নির্ভরশীল। সেখানের বৌদ্ধ ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গা কৃষক এবং জেলেদের কাছ থেকে ফসলাদি কেনে। তাই স্থানীয় অর্থনীতি অনেকটাই রোহিঙ্গা মুসলিমদের শ্রমনির্ভর। সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাতিবিদ্বেষের মতো যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, তার ফলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্য সমপ্রদায়ের তৈরি হওয়া দূরত্ব, অবিশ্বাস এবং সন্দেহ খুব সহজে দূর হবে না। এর অর্থনৈতিক প্রভাবও থাকবে। সুতরাং, ফিরে গেলেই কিন্তু পূর্বেকার জীবন ফিরে পাবে না রোহিঙ্গারা। তাদের একটি নতুন এবং ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
তৃতীয়ত, মিয়ানমারে ফিরে গেলে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা প্রয়োজন হবে রোহিঙ্গাদের। খেয়াল রাখতে হবে, সেখানে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) মতো একটি উগ্রপন্থী সংগঠন কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর চলতে থাকা নির্যাতন ও প্রান্তিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে যে হতাশা এবং ক্ষোভ তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, আরসা তারই ফসল। হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে খুব সহজেই কিছু রোহিঙ্গা আরসার মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে, যদি মিয়ানমারে সার্বিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হয়, তবে রোহিঙ্গারা পূর্বের মতো হতাশাগ্রস্ত পরিবেশে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে না।
প্রয়োজন অর্থবহ অগ্রগতি
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে হলে প্রয়োজন অর্থবহ অগ্রগতি। এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় করণীয় উল্লেখ করে একটি নির্দেশনাও দিয়েছে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা কমিশন। যদিও মিয়ানমারের সরকার ওই নির্দেশনাসমূহ গ্রহণ করেছে, তবে তা দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আনান কমিশনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি বাস্তবায়ন কমিটি যদিও গঠন করা হয়েছে; ঐ কমিটি নির্দেশনা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায়োগিক দিকে নজর না দিয়ে কূটনৈতিক কৌশলের দিকেই বেশি মনোযোগী বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা প্রয়োজন। পাশাপাশি, মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিশ্বাসযোগ্য ও সুসপষ্ট নিশ্চয়তা দিতে হবে। থামাতে হবে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকারী উগ্র বৌদ্ধ সমপ্রদায়গুলোকে। এছাড়াও, শুধুমাত্র উত্তর রাখাইনে নিযুক্ত প্যারামিলিটারি সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অপসারণ করে এর জায়গায় একটি নতুন বাহিনী নিযুক্ত করাও উচিত হবে। কারণ, পূর্বেকার বাহিনী রাখাইনে সংঘটিত সহিংসতায় খুব ভালোভাবেই জড়িত ছিল। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী থেকে নতুন সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনী এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন সহজ হবে। সেইসঙ্গে মিয়ানমারে বর্তমানে বসবাসরত ও ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত-যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে হলে সরকারের বর্তমান দুই ধাপের নাগরিকত্ব প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। উল্লেখ্য, ওই প্রক্রিয়ার আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রথমে জাতীয় প্রমাণপত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। অধিকাংশ রোহিঙ্গা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব পাওয়ার শঙ্কায় ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়াতেই অনিহা বোধ করে। কিছু রোহিঙ্গা অবশ্য ওই প্রক্রিয়ায় আবেদন করে দ্বিতীয় সারির নাগরিকত্ব পেয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের প্রণীত এবং বর্তমানে বহাল নাগরিক আইন অনুযায়ীও, অধিকাংশ রোহিঙ্গা পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবার যোগ্য। দ্বিতীয় সারির নাগরিকত্ব পাওয়া রোহিঙ্গারাও যে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের চেয়ে খুব একটা ভালো আছে, তাও কিন্তু বলা যাবে না। তাদেরকে নিরাপত্তার নামে স্থাপন করা ক্যামপগুলোতে কার্যত বন্দিই করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের শহরের ভেতরে বা বাইরে যেতে দেয়া হয় না। এ ধরনের প্রবল বৈষম্যকর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে। দিতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার সুবিধা। নিশ্চিত করতে হবে চাকরি খাতে তাদের বিনা বৈষম্যে অংশগ্রহণের সুযোগ।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেয়া অনেকটাই অসম্ভব। কারণ এ ধরনের উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর; বিশেষ করে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের। এছাড়াও, সরকারি সংস্থাগুলোতেও এ ব্যাপারে খুব ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না। তাই, পরিশেষে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সুচি এবং তার সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েও থাকেন, রোহিঙ্গাদের সফল প্রত্যবাসন কর্মসূচি সফল করতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কিন্তু দৃশ্যমান হয়নি।
(নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ অবলম্বনে)
No comments