বিনা বিচারে ৮ বছর কারাবাসের পর মুক্তি- ভাস্কর রশীদের জন্য দিল্লির সাংবাদিকের ‘ঈদ উপহার’

‘একবার মনে হচ্ছিল, আমরা হেরে যাব। কারণ, কাজটি ছিল জটিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা হারিনি। বরং তাঁকে ‘‘ঈদের উপহার’’ দিতে পেরেছি।’ ঢাকা থেকে যোগাযোগের পর টেলিফোনে কথাগুলো বলছিলেন টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক ইন্দ্রাণী বসু।


ভারতের জেলে আট বছর বিনা বিচারে কারাভোগ করা বাংলাদেশি ভাস্কর রশীদ আহমেদ ও তাঁর পুত্রবধূ নূরুন নাহারের মুক্তি এবং তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করেছেন ওই সাংবাদিকসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাঁদের সহায়তায় ঈদের দিন সকালে ঢাকায় ফিরে এসেছেন রশীদ আহমেদ ও তাঁর পুত্রবধূ।
তবে দেশে ফিরলেও রশীদ আহমেদের পরিবার এখন নিঃস্ব। গতকাল খিলগাঁওয়ে মেয়ের বাসায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঢাকার মাতুয়াইলে আমার যে বাড়িটি ছিল তা বিক্রি করতে হয়েছে। মাথার ওপর এখন ঋণের বোঝা। জীবনসায়াহ্নে এই ঋণ আমি কীভাবে মেটাব।’
৭৮ বছর বয়সী এ ভাস্করের দাবি, ‘বাংলাদেশ সরকার যেন ভারত সরকারের কাছে আমার জীবন থেকে মুছে যাওয়া আটটি বছরের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায় করে।’
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র সেতুর কাছের ভাস্কর্যসহ মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশ কিছু ভাস্কর্যের নকশা তৈরি ও নির্মাণ করেছিলেন রশীদ আহমেদ। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে আজমীর শরিফ যাওয়ার জন্য পুত্রবধূ নূরুন নাহারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান তিনি। দিল্লি রেলস্টেশনের কাছে পাহাড়গঞ্জ এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে রশীদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হোটেলের লবিতে বসে থাকা কয়েকজন লোক আমার কাছে জানতে চান, আমরা কোথা থেকে এসেছি, মুসলিম কি না ইত্যাদি। আমরা তাঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এর কয়েক মিনিট পরই সাদা পোশাকের লোকজন এসে ওই সব লোকদের সঙ্গে আমাদেরও আটক করে। পরদিন আদালতে তোলা হয়।’
রশীদ জানান, ‘আমাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে জাল টাকা বহন করে ওই সব লোককে সরবরাহ করার অভিযোগ আনা হয়। আমরা নিরপরাধ বলা সত্ত্বেও তাঁরা কথায় কান দেননি। তবে প্রথম শুনানির দিন বিচারক অভিযোগপত্র ছুড়ে ফেলে আবার নতুন করে তা জমা দিতে বলেন। এর মধ্যে আরেক দল কর্মকর্তা এসে কিছু কাগজে সই করতে বলেন। না হলে আমাদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা এবং মারধরের হুমকি দেন।’
রশীদ আহমেদ বলেন, ‘২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর তিন মাস পর বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার পদমর্যাদার আসাফুদ্দৌলা দেখা করেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে জানান এবং মুক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু এরপর তাঁকে ও বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি।’
রশীদ আহমেদের পাশেই বসেছিলেন তাঁর পুত্রবধূ নূরুন নাহার। তিনি বললেন, তাঁর বন্দী জীবনের পরের বছর ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট একমাত্র মেয়ে ১৩ বছরের চাঁদনি মারা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এর বিচার কে করবে?
রশীদ আহমেদ বলেন, বউমা বন্দী হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি এখন কোথায় থাকেন তা-ও কেউ জানেন না। খিলগাঁওয়ে মেয়ের বাসাটি এখন তাঁর ঠিকানা।
আট বছর বিনা বিচারে জেল খাটার পর ১০ অক্টোবর রায়ে ওই স্থপতির সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দেড় বছরের কারাদণ্ড হয়। রায়ের টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। কারাগারের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক ইন্দ্রাণী বসুকে ঘটনাটি জানান তিনি। ওই পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সাড়া পড়ে। আশিস নামে দিল্লির এক ব্যবসায়ীসহ কয়েকজন হূদয়বান মানুষ এগিয়ে আসেন। তাঁরা জরিমানার টাকা দিয়ে দেন। এর পরই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.