চামড়ার বাজারে অস্থিরতা-সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে

গণমাধ্যমে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে নানা রকম খবর পরিবেশিত হচ্ছে। চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাইরে থেকে ঢাকায় চামড়া খুব কম আসছে। তারা ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারের কাছে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।


এ বছর কোরবানির হাটগুলোতে অন্যান্য বছরের তুলনায় পশুর দাম ছিল যথেষ্ট কম। ফলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে অনেক পশুব্যবসায়ীকে আক্ষেপ করতে শোনা গেছে। কেউ কেউ ফেরি করেও গরু বেচেছেন। পাশাপাশি কোরবানির পর চামড়ার খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতাদেরও আক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে। তাঁরা না কি কেনা দামও পাচ্ছেন না। যাঁরা কোরবানি করেন, তাঁরা পশুর চামড়া বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তাঁদেরও মন্তব্য, এবার চামড়ার দর না পাওয়ায় গরিব-মিসকিনরা বঞ্চিত হয়েছে। আমরা এ ধরনের অভিযোগ, আক্ষেপ, হা-হুতাশ আর কত শুনব?
আগের বছরগুলোতে কোরবানির চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও গত দুই বছর তা করা হয়নি। ফলে গত বছরও কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচায় কিছুটা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। এ বছরও তার লক্ষণ বেশ স্পষ্ট। দুই বছর ধরে চামড়ার দর নির্ধারণ না করার পেছনে ব্যবসায়ীরা প্রধানত যে কারণটির কথা উল্লেখ করছেন তা হলো, বিশ্বমন্দার ফলে ইউরোপের বাজারে চামড়ার চাহিদা ও দাম কমে যাওয়া। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, সেই কম দামটাকে বিবেচনায় নিয়েই একটি সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা যেত না কি? সেটি না হওয়ায় খুচরা ক্রেতারা 'গরিবের হক' বলে পরিচিত কোরবানির পশুর চামড়া নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কারণ যাঁরা কোরবানি দেন, তাঁরা পচনশীল চামড়া ধরে রেখে দর কষাকষি করতে পারেন না।
তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষার দিকেই সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে পারলে এটি তৈরি পোশাক শিল্পকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই আমরা চাই, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই রপ্তানি খাতটি আরো উন্নতি করুক, বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আরো এগিয়ে যাক। আর তা করতে হবে বাজারের নিয়মকানুন মেনে এবং পণ্যের গতিশীলতার দিকটি বিবেচনায় রেখেই। বিশ্ববাজারে মন্দার বিষয়টি যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, প্রতিবছর আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। ইউরোপের বাইরেও নতুন নতুন চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই খাতে যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৬৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চামড়া। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখেই কোরবানির পশুর চামড়ার একটি নিম্নতম দাম নির্ধারণ করা যেত।
সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর দাবি কার্যকর করা বাস্তবে খুবই কঠিন। আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, কেন পাহারা দিয়ে চামড়া দেশে রাখতে হবে? আর এটাও আমাদের বোধগম্য নয় যে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে সীমান্ত এলাকা থেকে কেন বেশি দামে চামড়া কিনবেন? তাঁরা কি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যাচাই করবেন না? তাঁরা যদি বেশি দাম দিয়ে চামড়া কিনে তা থেকে মুনাফা করতে পারেন, তাহলে আমাদের ব্যবসায়ীরা ন্যায্যমূল্যে চামড়া কিনে সেটি পারেন না কেন?
আমাদের চামড়া শিল্পের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে। অন্যান্য প্রচারণাও কম নয়। অথচ প্রায় এক যুগেও সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা যায়নি। অন্য শিল্প মালিকরা নিজ খরচে ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করতে পারলেও আমাদের ট্যানারি মালিকরা কেন তা পারবেন না_তাও বোধগম্য নয়। এসব কারণে অনেক আমদানিকারক দেশই এখন বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য কেনার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের চামড়া শিল্পে পড়তে পারে। আর তাই এই সম্ভাবনাময় শিল্প রক্ষায় সরকারকে দ্রুত সঠিক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.