আত্মহত্যা প্রবণতায় প্রচারমাধ্যমের প্রভাব by ডা. মুনতাসীর মারুফ

আজকের দিনে সমাজজীবনে প্রচারমাধ্যম বা মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সামাজিক মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, বিশ্বাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে মিডিয়া। সেই সূত্রে আত্মহত্যা প্রবণতার ওপরও মিডিয়ার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।


আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের ধরন যেমন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর আত্মহত্যার হার বাড়াতে পারে, তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণতা রোধেও প্রচারমাধ্যম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
এটা ঠিক, সব আত্মহত্যার খবর মিডিয়া পর্যন্ত পেঁৗছায় না। যেসব খবর জানা যায়, হতে পারে এর বেশির ভাগই প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের যোগ্য অর্থাৎ সেই সংবাদের 'নিউজ ভ্যালু' আছে বলে তা প্রচারিত হয়। গবেষকরা বলেছেন, শুধু আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের তেমন কোনো মারাত্মক প্রভাব দেখা যায়নি, কিন্তু পরিবেশনের নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি বা ধরনই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে আত্মহত্যায় আরো উৎসাহিত করতে পারে। যখন আত্মহত্যার খবর বেশি বেশি পত্রিকার পাতায় বা টিভির পর্দায় আসতে থাকে, কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাকে ফলাও করে বা দীর্ঘাকারে প্রচার করা হয় বা অধিক গুরুত্ব দিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নাটকীয় শিরোনামে স্পর্শকাতর ছবিসহ কয়েক কলামজুড়ে প্রকাশিত হয় বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদের শুরুতেই এ ধরনের খবর থাকে, তখন পাঠক-দর্শকদের বিশেষ করে কম বয়সী কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে। মৃতের আত্মীয়স্বজনের আহাজারির মর্মস্পর্শী চিত্র অনেকের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়। তারা আত্মহত্যাকে মনোযোগ আকর্ষণের বা নিকটজনকে মানসিক আঘাত দিয়ে 'প্রতিশোধ' নেওয়ার উপযুক্ত উপায় বলে মনে করে বসে।
কোনো সেলিব্রিটি বা তারকার আত্মহত্যা স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশি এবং তা প্রচারমাধ্যমে গুরুত্বও পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো তারকার আত্মহত্যার পর ভক্ত বা সাধারণ জনগণের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকা অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যার পরের মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার বেড়ে গিয়েছিল ১২ শতাংশ। এদের বেশির ভাগই মৃত্যুর আগে চিরকুটে লিখে গিয়েছিল, তারা মেরিলিন মনরোকে অনুকরণ করেছে।
'আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন'-এর মেডিক্যাল ডিরেক্টর, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হার্বার্ট হেনডিন বলেন, কল্পনার রং মিশিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাকে 'গ্ল্যামার' দেওয়াটা পাঠের জন্য আকর্ষক হলেও তা আত্মহত্যা প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেখানে অষ্টম গ্রেড পড়ুয়া দুই কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনীর সঙ্গে তুলনা করে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে 'রোমান্টিক ফ্লেভার' দেওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের কাছে আত্মহত্যা মহৎ বা অনুকরণীয় কোনো দৃষ্টান্ত বলে ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে আত্মহত্যার মাধ্যমটি নিয়ে সংবাদে বিস্তারিত আলোচনা। এতে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি ওই উপায়টি অনুকরণে উৎসাহিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যার খবরের ফলাও প্রচারের পর এর হার যতটা বাড়ে, এর চেয়ে বেশি বাড়ে আত্মহত্যার মাধ্যমের অনুকরণের হার। অস্ট্রিয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে সাব-ওয়েতে ট্রেনের সামনে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার খবর নতুন পদ্ধতি হিসেবে ব্যাপক এবং নাটকীয় প্রচার পেতে থাকে। এতে করে এই পদ্ধতিতে আত্মহত্যার হার এমন উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে যে 'অস্ট্রিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন' এ ধরনের রিপোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। গবেষকরা প্রচারমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ধরনের রিপোর্টিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হন এবং আত্মহত্যার খবর প্রচারের ধরনে পরিবর্তন আসে। ফলও পাওয়া যায় দ্রুতই। এই প্রচারণা শুরুর ছয় মাসের মধ্যে সাব-ওয়েতে আত্মহত্যার হার ৮০ শতাংশ কমে আসে।
অনেক সময় আত্মহত্যার কারণটিকে অতি সহজীকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন, বলা হয়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বা চাকরি চলে যাওয়ায় ইত্যাদি। কিন্তু গবেষকরা বলেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার পেছনে শুধু একটি কারণ বা কেবল সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাকে দায়ী করা যায় না, এর পেছনে রয়েছে আরো অনেক কিছু। অনেক কারণ মিলে ব্যক্তিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পথে নিয়ে যায়। আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা বা প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিলে তা রোধ করাও সম্ভব।
আত্মহত্যা প্রবণতা রোধে মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশনের এসব দিকের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন আন্তর্জাতিক গবেষকরা। 'ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন স্টাডি ইন ইংল্যান্ড' জার্নালে যেমন এ ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে, তেমনি 'আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন' ও পেনসলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অ্যানেনবার্গ পাবলিক পলিসি সেন্টার', 'আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইডিওলজি' ও আমেরিকার 'ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ' যৌথভাবে মিডিয়ার প্রতি আত্মহত্যার রিপোর্টিংয়ের ব্যাপারে কিছু সুপারিশ করেছে। সেসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, আত্মহত্যার খবরকে প্রথম পাতায় ফলাও করে বা টিভি সংবাদের শুরুতে প্রচার না করা, চটকদার শিরোনাম না দেওয়া, শিরোনামে আত্মহত্যার কথাটা উল্লেখ না করা, খবরের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের আহাজারির বা ঘটনার স্থান বা আত্মহত্যার মাধ্যমের ছবি না দেওয়া ও এর বিস্তারিত বর্ণনা না দেওয়া, আত্মহত্যার পেছনের কারণকে অতি সহজীকরণ না করা ইত্যাদি।
তবে এ ধরনের পরামর্শ বা সুপারিশের ব্যাপারে বিতর্কও রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে, এটিকে অনেকে বাকস্বাধীনতার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বা সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ বলে মনে করতে পারেন। প্রচারমাধ্যম কী নীতিতে চলবে, না চলবে_এ ব্যাপারে বাইরে থেকে পরামর্শ অনেকেই ভালোভাবে না-ও নিতে পারেন। সে কারণেই গবেষণাসাপেক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে চিকিৎসক, নীতিনির্ধারক ও প্রচারমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এ ব্যাপারে কার্যকর নীতি প্রয়োগ করতে হবে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সুইজারল্যান্ডে গবেষক ও মিডিয়ার পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আত্মহত্যার খবরের নাটকীয় প্রচার কমেছে। আর অস্ট্রিয়ায় এ ধরনের উদ্যোগের ফলে যে আত্মহত্যার হার কমেছে, তা তো আগেই বলা হয়েছে।
লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.