আবার অশনিসংকেত by হায়দার আকবর খান রনো
বাতাসে যে গুজবটি ভেসে বেড়াচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সেই গুজবের সত্যতা ঘোষণা করলেন। বেশ কিছুদিন থেকেই যে কথাটি প্রচারিত হচ্ছিল, তা হলো, আবারও নাকি এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
কেউ কেউ বলেন, এবার নাকি ওয়ান-ইলেভেন নয়, এবার আসছে টু-টোয়েন্টি টু অর্থাৎ এবার গণতন্ত্রকে ভণ্ডুল করে যে অনির্বাচিত সরকারের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা গতবারের অর্থাৎ ২০০৭-২০০৮ সালের সেই জরুরি আইনের ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকারের চেয়েও ভয়াবহ, অনেক বেশি হিংস্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। এ সবই অনুমান মাত্র। বাংলাদেশে যেখানে গণতন্ত্র কখনোই কার্যকর হয়নি, বারবারই এই রকম হোঁচট খেয়েছে, সেখানে এরূপ অনুমান ও আশঙ্কা কাঙ্ক্ষিত না হলেও অস্বাভাবিক নয়। এই আশঙ্কাকে আরো জোরদার করেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা ও হুঁশিয়ারি। এক-এগারোর শক্তি এখনো তৎপর রয়েছে।
২০০৬ সালের চিত্রের কিছু কিছু দিক এখন আবারও দেখা যাচ্ছে। সেই সময় শাসক দলের দুর্নীতি, অপশাসন মানুষকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই ২০০৮ সালে জনগণ ভোটের মাধ্যমে সেই শাসক দলকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। এবারের নাটকটি প্রায় একই রকমের, তবে পাত্র-পাত্রীরা ঠিক বিপরীত ভূমিকায় অংশ নেবেন। এবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দলে বিএনপি। সম্ভাবনা আছে কিছুটা পরিমাণে অবাধ নির্বাচন হলে হয়তো ফলাফলটি ঠিক উল্টে যাবে।
দুই দলের মধ্যে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি যেন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে যেটা দেখা গেল, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য সেদিনের সরকারের অর্থাৎ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা ধরনের কারসাজি, ফন্দি-ফিকিরই ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের জন্মও হয়েছিল। এখনো প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাইকোর্টের একটি রায়ের অর্ধেকাংশকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান উঠিয়ে দিয়ে ইতিমধ্যেই একটা সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে বসে আছেন। ওই রায়ে বলা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান-পরবর্তী আরো দুটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা রায়ের এই অংশকে উপেক্ষা করলেন। বিতর্কিত ও বহু নিন্দিত ১৫তম সংশোধনী এত তাড়াহুড়া করে পাস করানোর দরকারই বা কী ছিল, তা আজও বোধগম্য নয়। যা-ই হোক, একটি সাংবিধানিক জটিলতা পাকিয়ে বসে আছে। মনে পড়ে, ২০০৬ সালে প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে, ভোটার তালিকার হালনাগাদকরণ ইত্যাদি ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জটিল সাংবিধানিক সংকটের সুযোগেই এসেছিল সেই অন্ধকারের শক্তি, যার পেছনে ছিল বিদেশি শক্তিগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা। আমরা দেখেছি, সেই সময় কিভাবে বিদেশি দূতাবাসগুলো তৎপর ছিল এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রকাশ্যেই নাক গলাত। ২০১২ সালে কি মনে হচ্ছে না, অনেকটা একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে?
২০০৭ সালেও সাধারণ মানুষ দুটি বড় দলের প্রতি বিরক্ত হয়ে তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান করছিল। তাই এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ফখরুদ্দীনের সরকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসমর্থন পেয়েছিল। এমনকি শেখ হাসিনাও সমর্থন দিয়েছিলেন এবং তাঁর সংগ্রামের ফসল বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেই ভুল ভাঙতে অবশ্য তাঁর কয়েক মাসও লাগেনি, যখন তিনি নিজেই বন্দি হলেন। এখনো দেখা যাচ্ছে, জনগণ যেন দুই বড় দলের হাত থেকে পরিত্রাণ চায়। অতীতের ও বর্তমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে।
তৃতীয় বিকল্প আমরাও চাই। সদ্য সমাপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসেও দ্বিদলীয় বুর্জোয়া বলয়ের বাইরে বিকল্পের ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিকল্প সামরিক বা আধা সামরিক সরকার নয়, অথবা আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো একই ধরনের লুটেরা ধনিক শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থার আরেক সংস্করণ নয়। বর্তমান সরকারের আমলে যে ধরনের লুটপাট, অরাজকতা, সন্ত্রাস, দলবাজি, গুম, হত্যা, ব্যাংকের টাকা লোপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের দাপট, পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি ঘটনা মানুষকে বিকল্পের সন্ধানে মরিয়া করে তুলেছে। তেমনই বিগত বিএনপি আমলের অপশাসনের স্মৃতি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবস্থান গ্রহণ, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি, জামায়াতের সঙ্গে ঘর করা ইত্যাদি কারণে জনগণের একটা বড় অংশ চায় না যে বিএনপি আবার ফিরে আসুক। ঠিক এই অবস্থার সুযোগ নিতে চাচ্ছে অন্ধকারের শক্তি। এর পেছনে বিদেশি শক্তির মদদ আছে বলেও অনুমান করা যেতে পারে। যারা এক-এগারোর পরিকল্পনা করেছিল, তাদের সেই প্রকল্প নানা কারণে তখনকার মতো ব্যর্থ হলেও সেই বিদেশি ও দেশীয় অপশক্তি যে ওই প্রজেক্ট স্থায়ীভাবে বাতিল করেছে, তা না-ও হতে পারে। নতুন পরিস্থিতিতে তারা আবার তৎপর হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের একটা মুখোশ বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের জন্য সুবিধাজনকও বটে। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চলে আসছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। ভারতেও এখন কেন্দ্রে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মাঝেমধ্যে সামরিক শাসনের ছেদ পড়লেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও তাই। এতে সুবিধার দিক হচ্ছে এই যে বিক্ষুব্ধ জনগণ পালাক্রমে বুর্জোয়াদের কোনো একটি দলকেই শাসক হিসেবে বেছে নেয়। ফলে শ্রেণী হিসেবে বুর্জোয়াদের কোনো ক্ষতি নেই। এ রকম দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রথম উদ্ভব ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তখনই ফ্রেডারিখ অ্যাঙ্গেলস তা লক্ষ করেছিলেন এবং লিখেছিলেন (মার্কসের লেখা 'ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ' গ্রন্থের বিংশ বার্ষিকী উপলক্ষে সংস্করণের ভূমিকা, ১৮৯৯)_'উত্তর আমেরিকায় যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় আসীন থাকে, তাদের উভয়কেই আবার চালিত করছে কতগুলো লোক, রাজনীতি নিয়েই যারা ব্যবসা করে, যারা কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিধানসভাগুলোর আসন নিয়ে ফটকা খেলে, কিংবা নিজ নিজ দলের হয়ে প্রচার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এবং নিজ নিজ দল জয়লাভ করলে যাদের পুরস্কার জোটে বড় বড় পদ। সবাই জানে যে অসহ্য হয়ে ওঠা এই জোয়াল কাঁধের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আমেরিকানরা ৩০ বছর ধরে কত চেষ্টাই না করছে, অথচ তা সত্ত্বেও কিভাবে তারা ক্রমেই দুর্নীতির পঙ্কে ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।...এখানে আমরা দেখি রাজনৈতিক ফটকাবাজির দুটি বিরাট দল, পাল্টাপাল্টি করে তারা শাসন-ক্ষমতা দখলে রাখছে, আর সেই রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করছে সবচেয়ে দুর্নীতিভরা পদ্ধতিতে সবচেয়ে দুর্নীতিপূর্ণ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য_আর সমগ্র জাতি শক্তিহীন দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতিকদের এই দুটি বিরাট জোটের সমক্ষে, যারা বাহ্যত তার সেবক অথচ প্রকৃতপক্ষে তার কর্তা ও লুণ্ঠনকারী।'
এই লাইন কয়টি পড়লে কি মনে হয় না যে অ্যাঙ্গেলস যেন আজকের বাংলাদেশকে মনে রেখেই লিখেছিলেন শতবর্ষ আগে? আসলে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একটি রূপ এবং বুর্জোয়ার জন্য বেশ উপযোগীও বটে। কিন্তু কখনো কখনো বুর্জোয়ারা নিজেরাই এই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে এবং গণতন্ত্রের ভড়ংটুকুও মুছে ফেলতে উদ্যত হয়। ইতিহাসে এ রকম নজির যথেষ্ট আছে। আবার ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত দেখা যাক। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিকাশের যুগে ফ্রান্সে ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিল, যখন ১৮৪৮ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের অল্প পরেই ১৮৫১ সালে নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই বোনাপার্ট ক্যুদেতা করে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করে সম্রাট হয়ে বসেছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার'। সেই গ্রন্থের এক জায়গায় মার্কস লিখেছিলেন, 'বুর্জোয়া শ্রেণী শেষ পর্যন্ত স্বীকার করছে যে নিজেদেরই স্বার্থে তার প্রয়োজন তার স্বীয় শাসনের বিপদ থেকে অব্যাহতি, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই তার বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ঘুমন্ত রাখতে হবে; তার সামাজিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন, বুর্জোয়া ব্যক্তি হিসেবে অন্যান্য শ্রেণীকে শোষণ এবং নিরুপদ্রবে সম্পত্তি, পরিবার, ধর্ম, শৃঙ্খলা উপভোগ করে যেতে পারে একমাত্র এই শর্তে যে অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে তাদের শ্রেণীকেও সমান রাজনৈতিক শূন্যতার অভিশাপ বহন করতে হবে; টাকার থলি বাঁচাতে হলে রাজমুকুট ছাড়তে হবে...।'
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। দ্বিদলীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও দুটি বড় বুর্জোয়া দলের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রের ভড়ং যেটুকু আছে, তা-ও ছুড়ে ফেলে দিয়ে এই দেশের বুর্জোয়া শ্রেণী ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ওপর এক-এগারোর ধরনের শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা খুব অমূলক নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল ও সরকার এবং তাঁদের অপশাসন ও কাণ্ডকারখানাই এর জন্য প্রধানত দায়ী থাকবে। প্রধান বিরোধী দলের অতীত ভূমিকা এবং বর্তমানের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজও কম দায়ী থাকবে না।
কিন্তু তাদের অপকর্মের জন্য আমরা দেশবাসী কেন কষ্ট ভোগ করব? মনে রাখতে হবে, এক-এগারোর মতো ব্যবস্থা চালু হলে অর্থাৎ গণতন্ত্র সংকুচিত হলে সবচেয়ে কষ্ট ভোগ করবে শ্রমজীবী মানুষ। তাই গণতন্ত্রকামী মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে এবং যেমন করেই হোক এই অশুভ তৎপরতা রুখতে হবে। একই সঙ্গে দ্বিদলীয় বৃত্তকেও ভাঙতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু যত কঠিনই হোক, এটা করতেই হবে। অন্যথায় জাতির ভবিষ্যৎ বড়ই অন্ধকার।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও লেখক
২০০৬ সালের চিত্রের কিছু কিছু দিক এখন আবারও দেখা যাচ্ছে। সেই সময় শাসক দলের দুর্নীতি, অপশাসন মানুষকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই ২০০৮ সালে জনগণ ভোটের মাধ্যমে সেই শাসক দলকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। এবারের নাটকটি প্রায় একই রকমের, তবে পাত্র-পাত্রীরা ঠিক বিপরীত ভূমিকায় অংশ নেবেন। এবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দলে বিএনপি। সম্ভাবনা আছে কিছুটা পরিমাণে অবাধ নির্বাচন হলে হয়তো ফলাফলটি ঠিক উল্টে যাবে।
দুই দলের মধ্যে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি যেন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে যেটা দেখা গেল, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য সেদিনের সরকারের অর্থাৎ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা ধরনের কারসাজি, ফন্দি-ফিকিরই ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের জন্মও হয়েছিল। এখনো প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাইকোর্টের একটি রায়ের অর্ধেকাংশকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান উঠিয়ে দিয়ে ইতিমধ্যেই একটা সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে বসে আছেন। ওই রায়ে বলা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান-পরবর্তী আরো দুটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা রায়ের এই অংশকে উপেক্ষা করলেন। বিতর্কিত ও বহু নিন্দিত ১৫তম সংশোধনী এত তাড়াহুড়া করে পাস করানোর দরকারই বা কী ছিল, তা আজও বোধগম্য নয়। যা-ই হোক, একটি সাংবিধানিক জটিলতা পাকিয়ে বসে আছে। মনে পড়ে, ২০০৬ সালে প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে, ভোটার তালিকার হালনাগাদকরণ ইত্যাদি ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জটিল সাংবিধানিক সংকটের সুযোগেই এসেছিল সেই অন্ধকারের শক্তি, যার পেছনে ছিল বিদেশি শক্তিগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা। আমরা দেখেছি, সেই সময় কিভাবে বিদেশি দূতাবাসগুলো তৎপর ছিল এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রকাশ্যেই নাক গলাত। ২০১২ সালে কি মনে হচ্ছে না, অনেকটা একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে?
২০০৭ সালেও সাধারণ মানুষ দুটি বড় দলের প্রতি বিরক্ত হয়ে তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান করছিল। তাই এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ফখরুদ্দীনের সরকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসমর্থন পেয়েছিল। এমনকি শেখ হাসিনাও সমর্থন দিয়েছিলেন এবং তাঁর সংগ্রামের ফসল বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেই ভুল ভাঙতে অবশ্য তাঁর কয়েক মাসও লাগেনি, যখন তিনি নিজেই বন্দি হলেন। এখনো দেখা যাচ্ছে, জনগণ যেন দুই বড় দলের হাত থেকে পরিত্রাণ চায়। অতীতের ও বর্তমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে।
তৃতীয় বিকল্প আমরাও চাই। সদ্য সমাপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসেও দ্বিদলীয় বুর্জোয়া বলয়ের বাইরে বিকল্পের ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিকল্প সামরিক বা আধা সামরিক সরকার নয়, অথবা আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো একই ধরনের লুটেরা ধনিক শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থার আরেক সংস্করণ নয়। বর্তমান সরকারের আমলে যে ধরনের লুটপাট, অরাজকতা, সন্ত্রাস, দলবাজি, গুম, হত্যা, ব্যাংকের টাকা লোপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের দাপট, পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি ঘটনা মানুষকে বিকল্পের সন্ধানে মরিয়া করে তুলেছে। তেমনই বিগত বিএনপি আমলের অপশাসনের স্মৃতি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবস্থান গ্রহণ, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি, জামায়াতের সঙ্গে ঘর করা ইত্যাদি কারণে জনগণের একটা বড় অংশ চায় না যে বিএনপি আবার ফিরে আসুক। ঠিক এই অবস্থার সুযোগ নিতে চাচ্ছে অন্ধকারের শক্তি। এর পেছনে বিদেশি শক্তির মদদ আছে বলেও অনুমান করা যেতে পারে। যারা এক-এগারোর পরিকল্পনা করেছিল, তাদের সেই প্রকল্প নানা কারণে তখনকার মতো ব্যর্থ হলেও সেই বিদেশি ও দেশীয় অপশক্তি যে ওই প্রজেক্ট স্থায়ীভাবে বাতিল করেছে, তা না-ও হতে পারে। নতুন পরিস্থিতিতে তারা আবার তৎপর হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের একটা মুখোশ বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের জন্য সুবিধাজনকও বটে। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চলে আসছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। ভারতেও এখন কেন্দ্রে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মাঝেমধ্যে সামরিক শাসনের ছেদ পড়লেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও তাই। এতে সুবিধার দিক হচ্ছে এই যে বিক্ষুব্ধ জনগণ পালাক্রমে বুর্জোয়াদের কোনো একটি দলকেই শাসক হিসেবে বেছে নেয়। ফলে শ্রেণী হিসেবে বুর্জোয়াদের কোনো ক্ষতি নেই। এ রকম দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রথম উদ্ভব ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তখনই ফ্রেডারিখ অ্যাঙ্গেলস তা লক্ষ করেছিলেন এবং লিখেছিলেন (মার্কসের লেখা 'ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ' গ্রন্থের বিংশ বার্ষিকী উপলক্ষে সংস্করণের ভূমিকা, ১৮৯৯)_'উত্তর আমেরিকায় যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় আসীন থাকে, তাদের উভয়কেই আবার চালিত করছে কতগুলো লোক, রাজনীতি নিয়েই যারা ব্যবসা করে, যারা কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিধানসভাগুলোর আসন নিয়ে ফটকা খেলে, কিংবা নিজ নিজ দলের হয়ে প্রচার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এবং নিজ নিজ দল জয়লাভ করলে যাদের পুরস্কার জোটে বড় বড় পদ। সবাই জানে যে অসহ্য হয়ে ওঠা এই জোয়াল কাঁধের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আমেরিকানরা ৩০ বছর ধরে কত চেষ্টাই না করছে, অথচ তা সত্ত্বেও কিভাবে তারা ক্রমেই দুর্নীতির পঙ্কে ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।...এখানে আমরা দেখি রাজনৈতিক ফটকাবাজির দুটি বিরাট দল, পাল্টাপাল্টি করে তারা শাসন-ক্ষমতা দখলে রাখছে, আর সেই রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করছে সবচেয়ে দুর্নীতিভরা পদ্ধতিতে সবচেয়ে দুর্নীতিপূর্ণ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য_আর সমগ্র জাতি শক্তিহীন দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতিকদের এই দুটি বিরাট জোটের সমক্ষে, যারা বাহ্যত তার সেবক অথচ প্রকৃতপক্ষে তার কর্তা ও লুণ্ঠনকারী।'
এই লাইন কয়টি পড়লে কি মনে হয় না যে অ্যাঙ্গেলস যেন আজকের বাংলাদেশকে মনে রেখেই লিখেছিলেন শতবর্ষ আগে? আসলে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একটি রূপ এবং বুর্জোয়ার জন্য বেশ উপযোগীও বটে। কিন্তু কখনো কখনো বুর্জোয়ারা নিজেরাই এই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে এবং গণতন্ত্রের ভড়ংটুকুও মুছে ফেলতে উদ্যত হয়। ইতিহাসে এ রকম নজির যথেষ্ট আছে। আবার ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত দেখা যাক। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিকাশের যুগে ফ্রান্সে ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিল, যখন ১৮৪৮ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের অল্প পরেই ১৮৫১ সালে নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই বোনাপার্ট ক্যুদেতা করে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করে সম্রাট হয়ে বসেছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার'। সেই গ্রন্থের এক জায়গায় মার্কস লিখেছিলেন, 'বুর্জোয়া শ্রেণী শেষ পর্যন্ত স্বীকার করছে যে নিজেদেরই স্বার্থে তার প্রয়োজন তার স্বীয় শাসনের বিপদ থেকে অব্যাহতি, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই তার বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ঘুমন্ত রাখতে হবে; তার সামাজিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন, বুর্জোয়া ব্যক্তি হিসেবে অন্যান্য শ্রেণীকে শোষণ এবং নিরুপদ্রবে সম্পত্তি, পরিবার, ধর্ম, শৃঙ্খলা উপভোগ করে যেতে পারে একমাত্র এই শর্তে যে অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে তাদের শ্রেণীকেও সমান রাজনৈতিক শূন্যতার অভিশাপ বহন করতে হবে; টাকার থলি বাঁচাতে হলে রাজমুকুট ছাড়তে হবে...।'
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। দ্বিদলীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও দুটি বড় বুর্জোয়া দলের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রের ভড়ং যেটুকু আছে, তা-ও ছুড়ে ফেলে দিয়ে এই দেশের বুর্জোয়া শ্রেণী ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ওপর এক-এগারোর ধরনের শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা খুব অমূলক নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল ও সরকার এবং তাঁদের অপশাসন ও কাণ্ডকারখানাই এর জন্য প্রধানত দায়ী থাকবে। প্রধান বিরোধী দলের অতীত ভূমিকা এবং বর্তমানের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজও কম দায়ী থাকবে না।
কিন্তু তাদের অপকর্মের জন্য আমরা দেশবাসী কেন কষ্ট ভোগ করব? মনে রাখতে হবে, এক-এগারোর মতো ব্যবস্থা চালু হলে অর্থাৎ গণতন্ত্র সংকুচিত হলে সবচেয়ে কষ্ট ভোগ করবে শ্রমজীবী মানুষ। তাই গণতন্ত্রকামী মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে এবং যেমন করেই হোক এই অশুভ তৎপরতা রুখতে হবে। একই সঙ্গে দ্বিদলীয় বৃত্তকেও ভাঙতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু যত কঠিনই হোক, এটা করতেই হবে। অন্যথায় জাতির ভবিষ্যৎ বড়ই অন্ধকার।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও লেখক
No comments