জাতীয় সংসদ-সংরক্ষিত আসনের 'বিশেষ সুবিধা' আসলে কার? by ফরিদা আখতার
জাতীয় সংসদে সাধারণ আসনসংখ্যা ৩০০ আর নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০, অর্থাৎ মোট ৩৫০টি আসন রয়েছে। কিন্তু সামনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্কের মধ্যে যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে কোনো আলোচনায় আসছে না, সেটা হচ্ছে নির্বাচন আসলে কত আসনে হচ্ছে? জানি অনেকে বলবেন,
এখানে বলাবলির কী আছে, ৩০০ আসনে নির্বাচিত সদস্যরাই নারীদের মনোনয়ন (তাদের ভাষায় নির্বাচিত করে) দেবেন! সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে ক্রমাগতভাবে।
হ্যাঁ দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটাই নিয়ম সাংবিধানিকভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা যে সংবিধান পেলাম তার 'পঞ্চম ভাগ' আইনসভার ধারা ৬৫(১) এবং ৬৫(২)-এ সাধারণ আসনের কথা বলা হয়েছে। মুশকিল বেধেছে ৬৫(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা আছে_ 'এই সংবিধানের প্রবর্তন হইতে দশ বছর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার কোনো কিছুই এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন কোনো আসনে কোনো মহিলার নির্বাচন নিবৃত্ত করিবে না।' অর্থাৎ মহিলারা অবশ্যই সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে পারবেন। সাধারণ আসন নারী-পুরুষ সবার জন্য, আর সংরক্ষিত আসন শুধুই নারীদের জন্য।
বর্তমান সংসদ তার একটি ভালো উদাহরণ, যেখানে সাধারণ আসনেও নারী আছেন, সংরক্ষিত আসনে তো বটেই। এখন মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯ জন নারী পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচন করে এসেছেন, যা মোট আসনের মাত্র ৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে। আর ৫০টি সংরক্ষিত আসন ধরে ৩৫০ আসনের মধ্যে নারীর মোট সংখ্যা হয় ৬৯ জন, যা মোট আসনের ১৯ শতাংশ। যে কয়জন সাধারণ আসনে জয়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন ৪ জন। কাজেই ইমেজের দিক থেকে দেখতে গেলে নারীদের জন্য এই আসন দেশের জন্য ভালো। কিন্তু আসল চিত্র কি তাই?
বলে রাখি, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিয়ে কথা বলার অর্থ এই নয় যে, যারা সেখানে যাবেন, আমরা ধরে নিচ্ছি যে তারা জনগণের পক্ষে এবং বিশেষ করে নারীদের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দেবেন। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রাজনৈতিক দল এবং তাদের আদর্শের ওপর। নির্বাচন এবং গণতন্ত্র যে এক কথা নয়, সে ভ্রম আমাদের নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে গেছে। নারী হিসেবে বুঝেছি আরও কঠিনভাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় প্রধান পেয়েছি নারী; স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, শ্রম অর্থাৎ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল স্থানেই নারীদের পেয়েছি। কিন্তু হায়! সমাজটাই যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, এরা সেই কাঠামোতে গিয়ে নারীদের স্বার্থ বলি দিয়ে দিলেন। কাজেই কোনো আশা নিয়ে নয়, জাতীয় সংসদের এই আসনগুলোর একটা মীমাংসা হওয়া দরকার, সে কারণেই প্রসঙ্গের অবতারণা। আমাদের সাফ কথা, যদি জনগণ তাদের নির্বাচিত না করতে পারে তাহলে বোনাস এবং বিশেষ সুবিধার আসনের দরকার কী?
একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। স্বাধীন দেশে শুরু হলো নারীদের প্রতি 'বিশেষ দৃষ্টিতে' জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি। নিয়ত ভালো ছিল কিন্তু ফল দাঁড়িয়েছে ভিন্ন। রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীদের নিজেদের মতো করে নির্বাচনী এলাকায় কাজ না করে বসে থাকলেই হবে। দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাদের ভাগে আসন জুটে যেতে পারে, সেই আশায় (গোঁফ তো নেই) মাথার চুলে তেল দিতে থাকবেন। আজকাল নারী আসনের জন্য প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়ছে প্রতিযোগিতা। কিন্তু যেহেতু ভোটার এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তাই তদবির ও তোয়াজ করে নেতাদের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে। এটা কি অপমানজনক নয়?
জাতীয় সংসদে সদস্যসংখ্যা প্রথম ১০ বছরের জন্য ৩০০ আসনের সঙ্গে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ জন নারী। মোট সদস্যসংখ্যা হলো ৩১৫। সে সময় সাধারণ আসনে কোনো মহিলা ছিলেন না, তাই মনে করা যেতে পারে এই ১৫টি আসন সংরক্ষিত না থাকলে মহিলাদের জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণ শুরুই করা যেত না। এটা ছিল বিশেষ মেয়াদের জন্য 'বিশেষ সুবিধা'। ধারণা করা হয়েছিল যে, ১০ বছর অর্থাৎ সংসদের দুটি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর মহিলাদের এ ধরনের বিশেষ সুবিধা আর না দিলেও চলবে। এরপর তারা সাধারণ আসনের নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে পারবেন। সেটা অবশ্যই পারতেন যদি বিশেষ সুবিধাটা সরাসরি নির্বাচনের আওতায় আনা হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। পরিণতি হয়েছে এই যে, নারীদের শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করা হয়নি, দু'একজন আসতে পারলেও বেশিরভাগ থেকে গেছেন দয়া বা করুণার ওপর। শিশু যতদিন হাঁটতে শেখেনি ততদিন কোলে নিতে হয়, বয়স বাড়ছে কিন্তু কোল থেকে না নামালে হাঁটবে কীভাবে?
এখন ২০১২ সাল, চলছে নবম জাতীয় সংসদ। দুঃখ এবং লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে_ সংরক্ষিত আসন বিলুপ্ত করা হয়নি, বরং বেড়েছে। আগে ৩০০ জন মিলে ১৫ জনকে মনোনীত করতেন, এখন করতে হয় ৫০ জনকে। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচনের দাবির পর একটু গণতান্ত্রিক হয়েছে এভাবে যে, আগে শুধু একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দল করত, এখন আনুপাতিক হারে বিরোধী দলও মনোনীত করতে পারে। তাই নবম জাতীয় সংসদের শুরুতে ৪৫টি আসনের মধ্যে বিরোধী দল ৫টি আসন লাভ করেছে। কিন্তু মাঝখানে এসে যখন সরকারি দল আরও ৫টি আসন বাড়াল তখন তার ভাগ আর কেউ পেল না। এটা যেন সরকারি দলের এখতিয়ার। অর্থাৎ নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বলা হলেও দলের জন্যই বোনাস বা দলের বিশেষ সুবিধা ছাড়া আর কিছুই নয়। দলের অনেক নারী কর্মী নেতৃত্বের পর্যায়ে এসেও কোনো স্বীকৃতি পান না। স্বীকৃতি মানে একটি আসন দিয়ে দাও। মন্দ কি?
এ কথা বলতেই হবে যে, সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করে সংসদে নেতৃত্বদানকারী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বেশ লাভ হয়। এই নারী সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে সংসদের অধিবেশনগুলোতে আসেন, সাধারণ আসনের সদস্যদের 'অন্য' কাজ বেশি। সংসদ নেত্রী উপস্থিত থাকলে সাধারণ আসনের সদস্যদের উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ে, নইলে বিরোধী দলের মতো তারাও 'নিয়মিত বর্জন' করে চলেন। টেলিভিশনে সংসদ চ্যানেল থাকায় এ বিষয়টি আমরা দেখতে পারি। সংসদে নারীরা না থাকলে স্পিকারকে শূন্য আসন সম্বোধন করেই কথা বলতে হতো। নারী সদস্যদের ক্ষমতা বা সুযোগ নেই তেমন কিছু করার, কিন্তু তারা প্রশ্ন করছেন, নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা না থাকলেও যার যার জেলার উন্নয়নের কথা বলছেন। নেতা-নেত্রীর গুণগান করছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সমাজে সমাদৃত হচ্ছেন, বিশেষ বা প্রধান অতিথি হয়ে অনুষ্ঠান করছেন। আমি যতবার নিজে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের সভায় গেছি, তাদের আন্তরিকতা দেখেছি, দেশের জন্য কাজ করার মানসিকতাও দেখেছি। কিন্তু একই সঙ্গে দেখেছি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে না পারার অসহায়ত্ব।
আমি জানি না, হয়তো তারা এ কথা স্বীকার নাও করতে পারেন, কিন্তু 'ক্ষমতাহীন' বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ সদস্য হয়ে তারা গণতন্ত্রের স্বাদ কতটুকু ভোগ করতে পারছেন, এ কথা তাদের বলার সময় হয়েছে। তারা সংসদ সদস্য, অথচ নীতিনির্ধারণীতে তাদের কথা কতটুকু শোনা হয় বা গুরুত্ব দেওয়া হয়? সাধারণ আসনের সদস্য যারা বহু টাকা খরচ করে এবং ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কাছে এই সংসদ সদস্যদের গুরুত্ব নেই। তারা তো ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন। তাদের মনোনয়ন দিয়েছেন দলের নির্বাচিত নেতারা। তাহলে কাদের কাছে দায়বদ্ধ তারা? জনগণ তো নয়ই এমনকি নারীদের প্রতিনিধিত্বও তারা করছেন না। এটা তো তাদেরই ব্যক্তিগতভাবে 'বিশেষ সুবিধা' পাওয়া। জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তো বন্ধ করে রাখা হয়েছে সংবিধানেই। এভাবেই কি চলবে এবারের নির্বাচনেও?
বিশেষ সুবিধার অসুবিধা হলো যে, একবার শুরু করলে বন্ধ করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে গোষ্ঠী-স্বার্থ যুক্ত হয়ে যায়। তাই যে উদ্দেশ্যে প্রথম আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল পরবর্তীকালে তা আর সেভাবে থাকেনি। যাদের জন্য করা তাদের মধ্যে ভাব এই যে এই পদ্ধতিতে সহজভাবে পাওয়ার বিষয় হয়ে গেছে। অন্যদিকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ধরেই নেয় যে, ৩০০ আসনে যে কোনো একটি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে এবং তারাই এই বোনাসের ভাগ পাবে। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে পালা করে এবং এই আসন নিয়ে তাদের মতো করে সংবিধান পরিবর্তন করেছে; কিন্তু সরাসরি নির্বাচন নিয়ে নারী আন্দোলনের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলা করেছে। এমনকি নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করেনি। সংরক্ষিত আসনে তিনটি দিক আছে_ এক. আসনসংখ্যা, দুই. মেয়াদ এবং তিন. নির্বাচন পদ্ধতি। প্রথম দুটি বেড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে, সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে প্রথমে আসনসংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এবং মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে প্রথম ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আবারও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। সংবিধান (দশম সংশোধন) আইন, ১৯৯০ প্রবর্তনকালে আবার ১০ বছর বাড়ানো হয়।
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় থেকে ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ ১৯৮৭ সালে প্রথম দাবি করেছে, সংরক্ষিত আসন দুটি মেয়াদ আরও রাখা যেতে পারে তবে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনে মনোনয়ন দিতে হলে কমপক্ষে ২০ শতাংশ মনোনয়ন দিতে হবে। সাধারণ আসনে নারীদের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, নারীদের নাকি টাকা ও মাস্তান-পাওয়ার নেই। কাজেই তারা জিতবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো ধরে নেয় যে, নারী কর্মীদের জন্য তো সংরক্ষিত আসন রয়েছে। এখন দলের জন্য কাজ করুক, জিতলে একটি আসন দিয়ে দেওয়া যাবে।
নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে। কিন্তু তাদের এজেন্ডা কী? নির্বাচন কমিশন কি ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মালিকানা সম্ভাব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে সঁপে বসে আছে? এই আসনগুলোর সঙ্গে যদি জনগণের কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে এই আসন রাখার দরকার কী? এই আসনের নির্বাচন সরাসরি হলে শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়, নারী আন্দোলন কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন এবং জনগণের ভোট নিয়ে জাতীয় সংসদে আসতে পারেন।
আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে আর দাবি করব না, কারণ তারা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছেই আমাদের প্রশ্ন, এবারের নির্বাচন কত আসনের হচ্ছে? বিশেষ সুবিধা কারা এবং কীভাবে পাচ্ছে?
ফরিদা আখতার :নারী আন্দোলনের
নেত্রী ও কলাম লেখক
হ্যাঁ দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটাই নিয়ম সাংবিধানিকভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা যে সংবিধান পেলাম তার 'পঞ্চম ভাগ' আইনসভার ধারা ৬৫(১) এবং ৬৫(২)-এ সাধারণ আসনের কথা বলা হয়েছে। মুশকিল বেধেছে ৬৫(৩) ধারা নিয়ে, যেখানে বলা আছে_ 'এই সংবিধানের প্রবর্তন হইতে দশ বছর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার কোনো কিছুই এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন কোনো আসনে কোনো মহিলার নির্বাচন নিবৃত্ত করিবে না।' অর্থাৎ মহিলারা অবশ্যই সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে পারবেন। সাধারণ আসন নারী-পুরুষ সবার জন্য, আর সংরক্ষিত আসন শুধুই নারীদের জন্য।
বর্তমান সংসদ তার একটি ভালো উদাহরণ, যেখানে সাধারণ আসনেও নারী আছেন, সংরক্ষিত আসনে তো বটেই। এখন মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯ জন নারী পুরুষ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচন করে এসেছেন, যা মোট আসনের মাত্র ৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে। আর ৫০টি সংরক্ষিত আসন ধরে ৩৫০ আসনের মধ্যে নারীর মোট সংখ্যা হয় ৬৯ জন, যা মোট আসনের ১৯ শতাংশ। যে কয়জন সাধারণ আসনে জয়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন ৪ জন। কাজেই ইমেজের দিক থেকে দেখতে গেলে নারীদের জন্য এই আসন দেশের জন্য ভালো। কিন্তু আসল চিত্র কি তাই?
বলে রাখি, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিয়ে কথা বলার অর্থ এই নয় যে, যারা সেখানে যাবেন, আমরা ধরে নিচ্ছি যে তারা জনগণের পক্ষে এবং বিশেষ করে নারীদের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দেবেন। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রাজনৈতিক দল এবং তাদের আদর্শের ওপর। নির্বাচন এবং গণতন্ত্র যে এক কথা নয়, সে ভ্রম আমাদের নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে গেছে। নারী হিসেবে বুঝেছি আরও কঠিনভাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় প্রধান পেয়েছি নারী; স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, শ্রম অর্থাৎ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল স্থানেই নারীদের পেয়েছি। কিন্তু হায়! সমাজটাই যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, এরা সেই কাঠামোতে গিয়ে নারীদের স্বার্থ বলি দিয়ে দিলেন। কাজেই কোনো আশা নিয়ে নয়, জাতীয় সংসদের এই আসনগুলোর একটা মীমাংসা হওয়া দরকার, সে কারণেই প্রসঙ্গের অবতারণা। আমাদের সাফ কথা, যদি জনগণ তাদের নির্বাচিত না করতে পারে তাহলে বোনাস এবং বিশেষ সুবিধার আসনের দরকার কী?
একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। স্বাধীন দেশে শুরু হলো নারীদের প্রতি 'বিশেষ দৃষ্টিতে' জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি। নিয়ত ভালো ছিল কিন্তু ফল দাঁড়িয়েছে ভিন্ন। রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীদের নিজেদের মতো করে নির্বাচনী এলাকায় কাজ না করে বসে থাকলেই হবে। দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাদের ভাগে আসন জুটে যেতে পারে, সেই আশায় (গোঁফ তো নেই) মাথার চুলে তেল দিতে থাকবেন। আজকাল নারী আসনের জন্য প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়ছে প্রতিযোগিতা। কিন্তু যেহেতু ভোটার এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তাই তদবির ও তোয়াজ করে নেতাদের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে। এটা কি অপমানজনক নয়?
জাতীয় সংসদে সদস্যসংখ্যা প্রথম ১০ বছরের জন্য ৩০০ আসনের সঙ্গে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ জন নারী। মোট সদস্যসংখ্যা হলো ৩১৫। সে সময় সাধারণ আসনে কোনো মহিলা ছিলেন না, তাই মনে করা যেতে পারে এই ১৫টি আসন সংরক্ষিত না থাকলে মহিলাদের জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণ শুরুই করা যেত না। এটা ছিল বিশেষ মেয়াদের জন্য 'বিশেষ সুবিধা'। ধারণা করা হয়েছিল যে, ১০ বছর অর্থাৎ সংসদের দুটি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর মহিলাদের এ ধরনের বিশেষ সুবিধা আর না দিলেও চলবে। এরপর তারা সাধারণ আসনের নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে পারবেন। সেটা অবশ্যই পারতেন যদি বিশেষ সুবিধাটা সরাসরি নির্বাচনের আওতায় আনা হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। পরিণতি হয়েছে এই যে, নারীদের শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করা হয়নি, দু'একজন আসতে পারলেও বেশিরভাগ থেকে গেছেন দয়া বা করুণার ওপর। শিশু যতদিন হাঁটতে শেখেনি ততদিন কোলে নিতে হয়, বয়স বাড়ছে কিন্তু কোল থেকে না নামালে হাঁটবে কীভাবে?
এখন ২০১২ সাল, চলছে নবম জাতীয় সংসদ। দুঃখ এবং লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে_ সংরক্ষিত আসন বিলুপ্ত করা হয়নি, বরং বেড়েছে। আগে ৩০০ জন মিলে ১৫ জনকে মনোনীত করতেন, এখন করতে হয় ৫০ জনকে। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচনের দাবির পর একটু গণতান্ত্রিক হয়েছে এভাবে যে, আগে শুধু একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দল করত, এখন আনুপাতিক হারে বিরোধী দলও মনোনীত করতে পারে। তাই নবম জাতীয় সংসদের শুরুতে ৪৫টি আসনের মধ্যে বিরোধী দল ৫টি আসন লাভ করেছে। কিন্তু মাঝখানে এসে যখন সরকারি দল আরও ৫টি আসন বাড়াল তখন তার ভাগ আর কেউ পেল না। এটা যেন সরকারি দলের এখতিয়ার। অর্থাৎ নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বলা হলেও দলের জন্যই বোনাস বা দলের বিশেষ সুবিধা ছাড়া আর কিছুই নয়। দলের অনেক নারী কর্মী নেতৃত্বের পর্যায়ে এসেও কোনো স্বীকৃতি পান না। স্বীকৃতি মানে একটি আসন দিয়ে দাও। মন্দ কি?
এ কথা বলতেই হবে যে, সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করে সংসদে নেতৃত্বদানকারী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বেশ লাভ হয়। এই নারী সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে সংসদের অধিবেশনগুলোতে আসেন, সাধারণ আসনের সদস্যদের 'অন্য' কাজ বেশি। সংসদ নেত্রী উপস্থিত থাকলে সাধারণ আসনের সদস্যদের উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ে, নইলে বিরোধী দলের মতো তারাও 'নিয়মিত বর্জন' করে চলেন। টেলিভিশনে সংসদ চ্যানেল থাকায় এ বিষয়টি আমরা দেখতে পারি। সংসদে নারীরা না থাকলে স্পিকারকে শূন্য আসন সম্বোধন করেই কথা বলতে হতো। নারী সদস্যদের ক্ষমতা বা সুযোগ নেই তেমন কিছু করার, কিন্তু তারা প্রশ্ন করছেন, নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা না থাকলেও যার যার জেলার উন্নয়নের কথা বলছেন। নেতা-নেত্রীর গুণগান করছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সমাজে সমাদৃত হচ্ছেন, বিশেষ বা প্রধান অতিথি হয়ে অনুষ্ঠান করছেন। আমি যতবার নিজে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের সভায় গেছি, তাদের আন্তরিকতা দেখেছি, দেশের জন্য কাজ করার মানসিকতাও দেখেছি। কিন্তু একই সঙ্গে দেখেছি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে না পারার অসহায়ত্ব।
আমি জানি না, হয়তো তারা এ কথা স্বীকার নাও করতে পারেন, কিন্তু 'ক্ষমতাহীন' বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ সদস্য হয়ে তারা গণতন্ত্রের স্বাদ কতটুকু ভোগ করতে পারছেন, এ কথা তাদের বলার সময় হয়েছে। তারা সংসদ সদস্য, অথচ নীতিনির্ধারণীতে তাদের কথা কতটুকু শোনা হয় বা গুরুত্ব দেওয়া হয়? সাধারণ আসনের সদস্য যারা বহু টাকা খরচ করে এবং ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কাছে এই সংসদ সদস্যদের গুরুত্ব নেই। তারা তো ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন। তাদের মনোনয়ন দিয়েছেন দলের নির্বাচিত নেতারা। তাহলে কাদের কাছে দায়বদ্ধ তারা? জনগণ তো নয়ই এমনকি নারীদের প্রতিনিধিত্বও তারা করছেন না। এটা তো তাদেরই ব্যক্তিগতভাবে 'বিশেষ সুবিধা' পাওয়া। জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তো বন্ধ করে রাখা হয়েছে সংবিধানেই। এভাবেই কি চলবে এবারের নির্বাচনেও?
বিশেষ সুবিধার অসুবিধা হলো যে, একবার শুরু করলে বন্ধ করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে গোষ্ঠী-স্বার্থ যুক্ত হয়ে যায়। তাই যে উদ্দেশ্যে প্রথম আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল পরবর্তীকালে তা আর সেভাবে থাকেনি। যাদের জন্য করা তাদের মধ্যে ভাব এই যে এই পদ্ধতিতে সহজভাবে পাওয়ার বিষয় হয়ে গেছে। অন্যদিকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ধরেই নেয় যে, ৩০০ আসনে যে কোনো একটি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে এবং তারাই এই বোনাসের ভাগ পাবে। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে পালা করে এবং এই আসন নিয়ে তাদের মতো করে সংবিধান পরিবর্তন করেছে; কিন্তু সরাসরি নির্বাচন নিয়ে নারী আন্দোলনের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলা করেছে। এমনকি নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করেনি। সংরক্ষিত আসনে তিনটি দিক আছে_ এক. আসনসংখ্যা, দুই. মেয়াদ এবং তিন. নির্বাচন পদ্ধতি। প্রথম দুটি বেড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে, সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে প্রথমে আসনসংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এবং মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে প্রথম ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আবারও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। সংবিধান (দশম সংশোধন) আইন, ১৯৯০ প্রবর্তনকালে আবার ১০ বছর বাড়ানো হয়।
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় থেকে ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ ১৯৮৭ সালে প্রথম দাবি করেছে, সংরক্ষিত আসন দুটি মেয়াদ আরও রাখা যেতে পারে তবে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনে মনোনয়ন দিতে হলে কমপক্ষে ২০ শতাংশ মনোনয়ন দিতে হবে। সাধারণ আসনে নারীদের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, নারীদের নাকি টাকা ও মাস্তান-পাওয়ার নেই। কাজেই তারা জিতবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো ধরে নেয় যে, নারী কর্মীদের জন্য তো সংরক্ষিত আসন রয়েছে। এখন দলের জন্য কাজ করুক, জিতলে একটি আসন দিয়ে দেওয়া যাবে।
নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে। কিন্তু তাদের এজেন্ডা কী? নির্বাচন কমিশন কি ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মালিকানা সম্ভাব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে সঁপে বসে আছে? এই আসনগুলোর সঙ্গে যদি জনগণের কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে এই আসন রাখার দরকার কী? এই আসনের নির্বাচন সরাসরি হলে শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়, নারী আন্দোলন কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন এবং জনগণের ভোট নিয়ে জাতীয় সংসদে আসতে পারেন।
আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে আর দাবি করব না, কারণ তারা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছেই আমাদের প্রশ্ন, এবারের নির্বাচন কত আসনের হচ্ছে? বিশেষ সুবিধা কারা এবং কীভাবে পাচ্ছে?
ফরিদা আখতার :নারী আন্দোলনের
নেত্রী ও কলাম লেখক
No comments