অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান

বাহুতে নয়, তাঁর শক্তি ছিল মনে। মানসিক শক্তি দিয়েই নাড়াচাড়া করতে পারতেন ছোটখাট বস্তু। এই আজব ক্ষমতাধর নারীর নাম নিনা কুলাগিনা। তাঁর আশ্চর্য গল্প শোনুন... নিনা কুলাগিনা ছিলেন গৃহবধূ। একদিন কেন যেন খুব রেগে গেলেন। রাগে কাঁপতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর সঙ্গে চারপাশের ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিলগুলোও কাঁপছে। রাগ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল তখন তাক থেকে নিচে পড়ে গেল পানির পাত্র। ঘরের বাতি আর পাখা নিজে নিজেই চালু আর বন্ধ হতে লাগল।
ঘাবড়ে গেলেন নিনা। বুঝতে পারলেন, গোলমেলে এক ক্ষমতা আছে তাঁর। এর পর শুরু করলেন কঠোর যোগব্যায়াম। ধীরে ধীরে আয়ত্তে নিয়ে এলেন অন্য রকম এক শক্তি। যার নাম সাইকোকিনেসিস। বাংলা করলে দাঁড়ায় 'মনো-গতিবিদ্যা'। নিনার এই অস্বাভাবিক মানসিক ক্ষমতা চাপা থাকেনি। ১৯৬০-এর দিকে তাঁকে নিয়ে শুরু হয় হৈচৈ। তখন চলছিল রাশিয়া-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ। ওই সময়টিতে নিনার এই ক্ষমতার প্রদর্শনী নিয়ে তৈরি হয় নানা সাদাকালো ভিডিওচিত্র। তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে চলে গুঞ্জন, গবেষণা। একবার প্রায় ৪০ বিজ্ঞানীর সামনে এই ক্ষমতা প্রদর্শন করেন নিনা। সবার আগে তাঁর পরীক্ষা নেন জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড নাওমোভ। তিনি একটি টেবিলে ম্যাচের অনেক কাঠি ছড়িয়ে দেন। টেবিলের সামনে বসে ম্যাচের কাঠিগুলোর ওপর দিয়ে হাত নাড়তে থাকেন। হঠাৎ দেখা গেল কাঠিগুলো নড়ে উঠছে। এর পর নিনার হাতের ইশারায় টেবিলের কার্নিশে গিয়ে একটি একটি করে মাটিতে পড়তে থাকে কাঠিগুলো। এ সময় নিনাকে দেখা গেল কাঁপছেন, আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন।
কিভাবে এগুলো করেন, জানতে চাইলে গবেষকদের নিনা বলেছিলেন যে এ জন্য প্রথমে মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করতে হয় তাঁকে। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই চিন্তামুক্ত হতে হয়। এর পর যে বস্তুটি নাড়াবেন তার ওপর গভীর মনোযোগ দেন। পুরো মনোযোগ ওই বস্তুর ওপর স্থির হলেই মেরুদণ্ডে তীক্ষ্ন ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। আর নড়তে থাকে সেই বস্তুটি। এভাবে কখনো ম্যাচের কাঠি, কখনো কলম আবার কখনো কম্পাসের কাঁটা ঘুরিয়ে সাধনা করতেন তিনি।
নিনার এসব কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু ভিডিওচিত্র খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমা বিশ্বে। মস্কোয় আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক প্যারাসাইকোলোজি সম্মেলনে দেখানো হয় এসব ভিডিও। আর এখন তো ইউটিউবে তাঁর নাম লিখে সার্চ করা মাত্রই চলে আসবে সব। তবে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সেই সময়ের মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই সোভিয়েত প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নিনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। এমনই এক মার্কিন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম এ ম্যাকগেরি ১৯৭০ সালে নিনার সঙ্গে দেখা করে এসে জানালেন, তাঁর সামনেই নিনা টেবিলে রাখা আংটি ও বোতলের ঢাকনাসহ আরো কিছু বস্তু নেড়েছেন। চেক প্রজাতন্ত্রের বিজ্ঞানী ড. জেনেক রেজডাক এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, '১৯৬৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি নিনার সঙ্গে দেখা করি। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন নিনার স্বামী, সাংবাদিক ব্লাজেক ও মনোবিজ্ঞানী জে এস জেরেভ। প্রথমে জেরেভ নিনার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন ও নিশ্চিত করেন যে তাঁর শরীরের কোথাও কোনো চুম্বক জাতীয় পদার্থ লুকানো নেই। যেই টেবিলে নিনা বসেছিলেন সেটিও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। খানিক পরেই দেখা গেল টেবিলে রাখা কম্পাস, ম্যাচের বাঙ্, ম্যাচের কিছু কাঠি ও একটি সিগারেট নাচতে শুরু করল নিনার ইশারায়। প্রতিটি বস্তু যেন নিজে থেকেই টেবিলজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।'
রেজডাকের এই প্রতিবেদন সাড়া ফেলে চারদিকে। এর পর আরো কিছু ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয় নিনার ওপর। এমনই একটি ভিডিওতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানীর সামনে বসে নিনা হাতের ইশারায় স্বচ্ছ বাঙ্ েরাখা বিদ্যুৎ অপরিবাহী কিছু বস্তুকেও নাড়াচ্ছেন। নাড়ানোর সময় চোখমুখ বেশ শক্ত হয়ে আসে নিনার। দর্শক এই ক্ষমতা উপভোগ করলেও নিনার চোখমুখজুড়ে থাকে ক্লান্তি।
নিনার আরো একটি চমকপ্রদ ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল ১৯৭০ সালের মার্চে। মনো-গতিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে নিনা কোনো প্রাণীর শরীরের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন কি না তা দেখার জন্য একটি গবেষণার আয়োজন করেন এক দল বিজ্ঞানী। এর ভিডিওতে দেখা গেছে, মনের জোরে রীতিমতো ব্যাঙের হৃৎস্পন্দনই বন্ধ করে দিয়েছেন নিনা। সেখানে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের একজন সেরগেইভ বলেন, নিনা ব্যাঙের হৃৎপিণ্ডের দিকে মনোনিবেশ করলে তা প্রথমে দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্পন্দন কমতে থাকে। এক পর্যায়ে তা বন্ধই হয়ে যায়। আরেক ভিডিওতে দেখা গেছে, দুই মিটার দূরে রাখা ডিমের সাদা অংশ থেকে ইশারাতেই কুসুম আলাদা করে দেখিয়েছেন নিনা। শুধু মনো-গতিবিদ্যাই নয়, 'থটোগ্রাফি'ও পারতেন তিনি। বাংলা করলে দাঁড়ায় 'চিন্তাচিত্র'। তাঁর হাতের ইশারায় ফটোগ্রাফিক প্লেটে ভেসে উঠত ইংরেজি 'এ' ও 'ও' অক্ষর। আবার ইশারার জোরেই ওই প্লেটে নানা আঁকিবুঁকি তৈরি করতে পারতেন নিনা। এসব দাবি করেছেন পদার্থবিদ ভি এফ ভেৎজ। তবে এই গুণটি নিয়ে খুব একটা মাতামাতি হয়নি। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মাঝে মাঝে চর্চা করার সময় নিনার হাতে পোড়া দাগ তৈরি হয়ে যেত। একবার নাকি গায়ের কাপড়ে আগুনই ধরে গিয়েছিল।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী অদ্ভুত এ ক্ষমতাকে বললেন বিশেষ বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় শক্তি। নিনার শরীরের ভেতর যা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়। নিনাকে শুধু ওই শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয়েছে। তবে বিপক্ষ যুক্তিরও ছিল না কমতি। তাঁর ভিডিওগুলোর সত্যতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। তাঁর শক্তিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে অনেক বিজ্ঞান সংস্থা। তাদের দাবি, এসব ভিডিওচিত্র ধারণের আগে নিনার কাছে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল এবং পরিবেশও এমন ছিল যেখানে খুব সহজেই তিনি কৌশল অবলম্বন করতে পারতেন। অবশ্য তাই যদি হতো, তবে অবশ্যই বিশ্বসেরা জাদুকরদের সঙ্গে লিখতে হবে নিনার নামটাও।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, স্নায়ুযুদ্ধে এগিয়ে থাকার জন্য নিনার এসব ছোটখাটো ছল-চাতুরিকে বড় করে প্রচার করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই সময়কার মস্কোর একটি সংবাদপত্র নিনাকে মেকি ও প্রতারক বলেছিল। অনেকের দাবি, ওই ভিডিওগুলোতে কারচুপি ছিল। তবে সে সময়কার ভিডিওপ্রযুক্তি এখনকার মতো এতটা উন্নত ছিল না নিশ্চয়ই। নিনাবিরোধীরা বলেছেন, তিনি শরীরে চুম্বকজাতীয় জিনিস লুকিয়ে রাখতেন ও তা ব্যবহার করেই গতিহীন বস্তুকে গতিশীল করতেন। কিন্তু আপেল, গ্লাস বা ডিম এসব কি করে নাচিয়েছেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তাঁরা।
একদিকে চলছিল আলোচনা-সমালোচনা, আরেকদিকে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন নিনা। একবার ড. রেজডাকের সামনে অনেক শক্তিপরীক্ষা দেওয়ার পর খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তাঁর নাড়ির গতি কমে আসে। ফ্যাকাসে হয়ে যায় চেহারা। হাত-পা নাড়াতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। চিকিৎসক জেরেভ পরীক্ষা করে বুঝতে পারছিলেন নিনার হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত ও ডায়াবেটিস বেড়েছে। ধীরে ধীরে হাত-পায়ে ব্যথা ও চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন নিনা। ধারণা করা হয়, শরীরের পুরো শক্তি কাজে লাগিয়ে এত বেশি প্রদর্শনী করার কারণেই তাঁর এই অবস্থা। ১৯৭০ সালের শেষদিকে হার্ট অ্যাটাক হয় নিনার। এর পর চিকিৎসকরা তাঁকে মানসিক শক্তি প্রদর্শন করা ছেড়ে দিতে বলেন। তবু মাঝেমধ্যে চর্চা করতেন নিনা। ১৯৯০ সালে মারা যান 'ক্ষমতাধর' এই নারী।
=========================
স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী



দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মেহরিন জাহান


এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.