রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ

আজ ও আগামী কয়েক দিন বাংলাদেশে কথা হতে থাকবে হরতাল নিয়ে। ৩০ নভেম্বর বিএনপির হরতাল পার না হওয়া পর্যন্ত এমনভাবেই চলবে। কেউ বলবেন, হরতাল করা খুব খারাপ। দেশের সর্বনাশ হয়ে যায়। কেউ বলবেন, আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। কেউ বা জবাব দেবেন, তা কী করে হয়। দাবি আদায়ের জন্য হরতাল একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার। তবে তাঁরাও স্বীকার করবেন, তূণের শেষ অস্ত্রগুলোর মধ্যে হরতাল একটি। এর ব্যবহার হিসাব করে করা উচিত। বিএনপি বলবে, আমরা নাচার হয়ে হরতাল ডেকেছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মন্তব্য করবে, সব বাজে কথা, বিএনপি হরতাল ডেকেছে খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি পুনরুদ্ধার, তাঁর দুই ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা তুলে নেওয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য।
বিএনপি তখন বলবে, আমরা জনগণের স্বার্থে দ্রব্যমূল্য কমাবার, চাঁদাবাজি বন্ধ করার, চাকরির জন্য সবার সমান অধিকার থাকার, মা-বোনদের ইজ্জত রাখার, দেশে খুনখারাবি বন্ধ করার, নদীর পানির হিস্যা পাওয়ার এবং ভারতকে নিঃশর্তভাবে ট্রানজিট না দেওয়ার দাবিতে হরতাল ডেকেছি। দুই বছর হয়ে গেল তবু আওয়ামী লীগ সরকার এসব দাবির একটাও পূরণ করেনি। উপরন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে, জেল-জুলুম চালাচ্ছে আর খালেদা জিয়াকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাই হরতালের মতো শক্ত প্রতিবাদ করা ছাড়া গতি কী?
দেশের শীর্ষ বণিক সমিতি এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি এ কে আজাদ দাবি করেছেন, আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করতে হবে। সাবেক সভাপতি আনিসুল হক তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। তবে জনাব আজাদ এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, হরতাল বন্ধ করার জন্য তিনি দেশের কোটি কোটি ব্যবসায়ী ও বেকার যুবকদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
দেশের সেরা ধনী শীর্ষ ব্যবসায়ীরা জনমত সৃষ্টি করার, বিবদমান রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার, রাজনৈতিক আন্দোলনে শান্তি ও অহিংসতা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা এবং জাতীয় সংসদে আলোচনা করে সব সমস্যা মীমাংসা করার কথা বলুন, ঠিক আছে। তবে রাজনৈতিক হরতালের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করার কথা বললে তাঁরা অসুবিধায় পড়তে পারেন এ জন্য যে তাঁদের পাল্টা কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একটা উদাহরণ দিই, গত ২২ নভেম্বর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের অডিটরিয়ামে 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়' প্রামাণ্যচিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হলো। চলচ্চিত্রটি নূর হোসেন নামে যে ছেলেটি খালি গায়ে বুকে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক' এবং পিঠে 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান লিখে ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭ এরশাদবিরোধী ডাকা অবরোধ আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে তাঁর কাহিনী নিয়ে তৈরি। ওই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্ণনাও আছে। যাঁরা বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে একজন (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অথবা হায়দার আকবর খান রনো) একটা মন্তব্য করলেন, 'এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ এবং বহু সংগঠন যোগ দেয় তবে আসেনি ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি' এবং এনজিওগুলোর সংগঠন 'এডাব'। উক্তিটি স্বব্যাখ্যাত। তবু আরেকটু এগিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, 'ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কী এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার, নারী নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, যথাযথ ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমি অধিগ্রহণ, নদী দখল, পরিবেশ দূষণ, কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিক্ষেপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি দলীয়করণ এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান বর্ণিত বাজিকরদের উৎপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন বা রাজপথে নেমে আন্দোলনের কথা বলেছেন? এ প্রশ্নের উত্তর যদি 'না' হয় তাহলে প্রশ্নকর্তা বলতেই পারেন, 'সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের সঙ্গেই থাকি।' আসলে যার যা কাজ তার সেটা করাই সাজে। তা ছাড়া বড় ব্যবসায়ীরা তো রাজনৈতিক নেতাদের খুশি রেখে বা তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে বড় অঙ্কের ব্যবসা করেন। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তাঁরা কত দূরই বা যাবেন।
তা ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতির তো গর্ব করার মতো রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ইতিহাস রয়েছে। তিনি কিন্তু অন্য অনেকের চেয়ে ভালো করে জানেন, দলগুলো অনেক সময় ভুক্তভোগীদের অভিমত ও ইচ্ছার চাপে হরতালের মতো পদ্ধতির আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়। এ সমস্যার উত্তর হচ্ছে, কেউ হরতাল বা ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হোক সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো কাজ না করা বা কারণ না ঘটানো। আমারও ধারণা, এফবিসিসিআই যদি বিরোধী দলকে দিয়ে হরতাল প্রত্যাহার করতে বলে তবে বিরোধীদলীয় নেতারা তাঁর প্রতিনিধিদের বলবেন, 'আপনারা সরকারের কাছ থেকে আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আদায় করে এনে দিন।' আমার মনে হয়, অতীতেও এফবিসিসিআই এমন উত্তর শুনেছে বিভিন্ন সময়ে হরতাল আহ্বানকারীদের কাছ থেকে। এ অবস্থায় আমাদের মতো হতোদ্যম ব্যক্তিরা মনে মনে একটি প্রার্থনাই করতে পারি, হরতালের সময় বিক্ষোভ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'অ্যাকশনে' কেউ যেন প্রাণ না হারায়, আহত না হন এবং যানবাহন না পোড়ানো হয়। আর এ মুহূর্তে আবারও হরতাল ডাকার 'অনিবার্য প্রয়োজন' যেন পড়ে না বিএনপির। তা ছাড়া এ-ও চাইব, হরতাল, বিক্ষোভ, লং-মার্চ ইত্যাদির শেষে বিএনপি যেন জাতীয় সংসদে আগামী অধিবেশনে যোগ দেয়।
ইতিমধ্যে খুশি হওয়ার মতো তিন-চারটা ঘটনা ঘটেছে দেশে। চলমান রাজনীতিক উত্তেজনা এবং আরো অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও দেশে মঙ্গলকার কিছু যে হয় তার প্রতি দৃষ্ট আকর্ষণ করার জন্যই এগুলো উল্লেখ করছি। এক. বিদেশি ক্রেতাদের জন্য বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ বাংলাদেশেই তৈরি করছে আমাদের দেশি কম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।
দুই. গত চার মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ওই সময়ের রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
তিন. আফ্রিকার খরাসহিষ্ণু নারিকা জাতের ধান বাংলাদেশে সফলভাবে উৎপাদন করা গেছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধান সারা দেশে বছরজুড়ে কোথাও না কোথাও আবাদ করা যাবে। এ ধানের শীষ লম্বা, বোঁটা শক্ত, উচ্চতা পরিমিত এবং ঝড়-বৃষ্টিতে সহজে নুয়ে পড়ে না। সফল পরীক্ষামূলক চাষের পর নারিকা ধান এবার বেশি জায়গায় চাষ করা হবে।
চার. দেশের সমুদ্র উপকূলের অনেক জায়গায় স্থানীয় জনগণ নিজ উদ্যোগে গাছ লাগাচ্ছেন, তৈরি করছেন সবুজ বলয়।
সমুদ্র উপকূলের গাছ নিয়ে আমার দুটো ঘটনা খুব মনে পড়ে। প্রথমটা হলো ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের পরপরই ভোলার চরফ্যাশনে গিয়েছিলাম। সেখানে ঘরবাড়ি সব ধুয়েমুছে গিয়েছিল। তখনো মেঘনা নদীতে ও ডাঙায় মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এরই মাঝে দেখলাম একটা উঁচু গাছের ডালে একটা শাড়ির টুকরা আটকে আছে। ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত এলাকার এক কৃষক সেটা দেখিয়ে বললেন, 'সমুদ্রের পানি ওই কাপড় আটকে থাকা ডালটার সমান উঁচু হয়ে এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যার কাপড় দেখছেন সে বোধ হয় বেঁচে নেই।'
দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯৮৫ সালে উড়িরচরে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সপ্তাহখানেক পর সেখানে গিয়েছিলাম। ত্রাণ বিতরণের সারিতে এক মাঝবয়সী মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল ফরসা ফুটফুটে এক কিশোরী। জলোচ্ছ্বাসে কিশোরীর মা হারিয়ে গেছেন। আর এই বাচ্চা মেয়েটি পানিতে ভাসতে ভাসতে উড়িরচরের সমুদ্রতীরে একটা গাছের সঙ্গে আটকে যায়। পানি সরে গেলে সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। দ্বীপের লোকজন তার অচেতন দেহ দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে উড়িরচর ছেড়ে কোনো নিরাপদ স্থানে যাবে কি না। বাবার দিকে এক নজর তাকিয়ে সে বলেছিল, 'না, এই দ্বীপেই থাকবে সে।' আমরা যখন কথা বলছিলাম তখন সমুদ্রের জোয়ারের পানি দ্বীপে ঢুকতে শুরু করেছে। আমাদের পায়ের গোড়ালি তখন পানির নিচে। ছুটে গিয়ে অদূরে ঢিবির ওপর অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারে উঠে পড়েছিলাম। আজও যখন উড়িরচরের কথা ভাবি তখন মেয়েটার কথা মনে পড়ে। ভাবি, সে হয়তো আজও মাঝে মাঝে সমুদ্রতীরে জীবনদায়িনী গাছটির গায়ে হাত রেখে সমুদ্র দেখে। উপকূলের লোকরা তো গাছ লাগাবেনই। তাঁরা তো এর মূল্য বোঝেন। কিন্তু যারা এক রাতেই শয়ে শয়ে এসব গাছ লুট করে নিয়ে যায়, বিপন্ন করে উপকূলবাসীর জীবন, তাদের কি বিচার হচ্ছে?
======================
নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আতাউস সামাদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট


এই আলোচনাট'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.