ভ্রমণ- 'ঘুরি দেশে দেশে' by মাহফুজ রহমান

৫৭ বছর বয়সী কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি আবদুস সাত্তার গাড়িতে চেপে বেরিয়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে। গত বছরের ২ আগস্ট কানাডার টরন্টো থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। একে একে ২২টি দেশ ঘুরে এবার এসেছেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। শুনুন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর তাঁর বিশ্বভ্রমণের গল্প।
চোখে পড়ার মতো একটি খবর আমরা দেখেছিলাম ১০ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। শিরোনাম ছিল ‘বিশ্বভ্রমণকারীর বাংলাদেশ দর্শন’। কী ছিল খবরটিতে? সংক্ষেপে বলা যায়, ৫৭ বছর বয়সী কানাডা-প্রবাসী বাংলাদেশি আবদুস সাত্তার ও ২৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্যাল বয় বেরিয়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে।
গত বছরের ২ আগস্ট কানাডার টরন্টো থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। একে একে ২২টি দেশ ঘুরে সাত্তার ও স্যাল এসেছিলেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। কিন্তু হায়! আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পরে তাঁর বিশ্বভ্রমণ গেল থমকে! থমকে গেল তাঁদের গাড়িটি এখন চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে বলে। আবদুস সাত্তার ও স্যাল বয়ের গাড়ি নিয়ে বিশ্বভ্রমণের এমন প্রচেষ্টা আনকোরা নয়। তবে বিশ্বের হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন পাগলাটে মানুষই তেমনটা করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সাত্তার ও স্যালের বিশ্বভ্রমণের এই অসমাপ্ত গল্পটি বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর। কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বাদ দিলে তাঁদের এই অসমাপ্ত গল্পটি সত্যিই রোমাঞ্চকর।
পৃথিবীর পথে
যশোরের চৌগাছায় জন্ম আবদুস সাত্তার সালাহউদ্দীনের। বয়স আনুমানিক ৫৭। মা-বাবা বেঁচে নেই। এক ভাই আছেন, কানাডা-প্রবাসী। যশোর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ঢাকার মতিঝিলে একটি ব্যাংকে চাকরি করেছেন প্রায় সাত-আট বছর। ১৯৮৮ সালের একদিন দেশ ছেড়ে সাত্তার পারি জমান কানাডায়। তার পর থেকে সেখানেই থিতু। কানাডার নাগরিকত্বও পেয়েছেন তিনি। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর পরিবার। সাত্তার কানাডায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কয়েক বছর। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের পড়াশোনার পাট এখনো চুকেনি। সবকিছু ভালোই চলছিল। তবে বয়স যখন ৫৬, তখনই হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল সাত্তারের! ভূতের নাম বিশ্বভ্রমণ!
‘বাংলাদেশিদের অনেক কিছুতেই রেকর্ড আছে। কিন্তু সড়কপথে গাড়ি চালিয়ে বিশ্বভ্রমণের মতো কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি পুরো এশিয়ায়ও এমন কোনো রেকর্ড নেই। ইন্টারনেট ঘেঁটে আমরা জানতে পারি, বিশ্বে গুটিকয়েক মানুষই এমন পাগলামি করেছিলেন বা কেউ কেউ করছেন। তাই হঠাৎ করে বিষয়টি আমাদের মাথায় খেলে যায়। আমরা কি পারি না, এমন কিছু করতে? মানুষ তো তার কাজের মধ্যেই বেঁচে থাকে।’ বিশ্বভ্রমণে বেরোনোর আগে নিজের পরিকল্পনার কথা বলছিলেন আবদুস সাত্তার। পরিকল্পনা তো হলো, চাই বাস্তবায়ন। তাই সেসব কথাই সাত্তার পেশ করেছিলেন পরিচিতজনদের কাছে। কিন্তু সেটাকে স্রেফ পাগলামি বলেই উড়িয়ে দেয় তাঁর পরিবার ও কানাডা-প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি।
শুরুর দিকের সেসব বাধাবিপত্তির কথাই বললেন সাত্তার, ‘২০০৯-এর এপ্রিল, মে ও জুনে কানাডায় আমাদের কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে তিনটি বৈঠকে বসি। সেখানে পরিকল্পনার কথা জানাই সবাইকে। সব শুনে কেউ কেউ তো পাগল বলে ঠাওরাল আমাদের। তবে হাতেগোনা কয়েকজন আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। আমরাও নিরুৎসাহিত না হয়ে কাজে নেমে পড়লাম।’
আবদুস সাত্তার তাঁর প্রতিটি কথায় ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলছেন। এই ‘আমরা’র আরেকজন কে? তিনি স্যাল বয়। কমিউনিটির সঙ্গে তিনটি বৈঠকেই উপস্থিত ছিলেন ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ। আর তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমিও আছি তোমার সঙ্গে।’ হাইস্কুলে সাত্তারের ছেলের সঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন স্যাল। সেই সূত্রে পরিচয়, সাত্তারের সঙ্গে ‘আঙ্কেল-স্যাল’ সম্পর্ক তাঁর। বলা বাহুল্য, সাত্তারের সঙ্গে স্যালের বয়সের ব্যবধান বিশ্বভ্রমণের সঙ্গী হতে মোটেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তবে সাত্তারের মতোই স্যালও একই সমস্যায় পড়েছিলেন শুরুর দিকে। বিশ্বভ্রমণের মতো পাগলামিতে ছেলের নাম লেখানোয় মা-বাবার প্রবল আপত্তি। কানাডার সেন্ট্রাল টেকের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশনস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র স্যাল। বিশ্বভ্রমণের আগে বাকি ছিল আরও কয়েকটি সেমিস্টার। মা-বাবার আপত্তি সেখানেই। স্যাল অবশ্য শেষতক অনেক কায়দা-কসরত করে মা-বাবার মন গলাতে পেরেছিলেন। কিন্তু আবদুস সাত্তার সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ! তার পরও তিনি দমার পাত্র নন। কিনে ফেলেন মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার ২০০৬ মডেলের পুরোনো একটি গাড়ি। শুধু গাড়ি কিনলেই তো চলে না, বিশ্বভ্রমণের জন্য চাই আরও অনেক কিছুই। সাত্তার ও স্যাল তালিকা করতে বসে যান। এদিক-সেদিক ঘুরে কিনেও ফেলেন সবকিছু। আর সঙ্গে নিয়ে নেন সারা জীবনের সঞ্চিত টাকাপয়সা। প্রস্তুতি পর্ব শেষ, এবার বেরিয়ে পড়ার পালা।
‘গত বছরের ২ আগস্ট আমাদের গাড়ি চালিয়ে বিশ্বভ্রমণের শুরু। তবে আমরা কেবল ঘোরাঘুরির জন্যই বিশ্বভ্রমণে বের হইনি। উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ববাসীর কাছে আমরা বাংলাদেশের কথা বলব। প্রচার করব সমাজসচেতনামূলক কিছু বাণী। বাণীগুলো হলো—১. নিজেকে জানো, বিশ্বকে জানো, ২. পরিবেশ বাঁচাও, পৃথিবী বাঁচাও, ৩. স্বাস্থ্য বাঁচাও, পরিবার বাঁচাও।’
বিচিত্র ভুবন
বিশ্বভ্রমণের শুরুতেই হোঁচট খান সাত্তার ও স্যাল। অতিরিক্ত ওজনের মালামাল (কিছু মালামাল বিমানে পাঠাতে হয়েছিল) বহনের দায়ে কানাডার বিমানবন্দরে গুনতে হয় আক্কেল সেলামি। লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে আবার আরেক বিড়ম্বনা অপেক্ষা করছিল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাগজভর্তি একটি লাগেজ হারিয়ে যায় কেমন করে! ভাগ্য ভালো, সাত দিনের মাথায় তা ফিরে পান তাঁরা। আর এরই মধ্যে কয়েকটি দিন লন্ডন-প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে সাত্তার ও স্যাল তাঁদের বাণী প্রচারের কাজটিও সেরে ফেলেন।
লন্ডনের পাট চুকে গেলে ফের গাড়িতে চেপে বসা। গন্তব্য ফ্রান্স। সাত্তার ও স্যাল চলতে থাকলেন। পালা করে চালকের আসনটি বদলাতে থাকলেন তাঁরা। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, শুধু দিনেই গাড়ি চালাবেন। সেভাবেই চলতে থাকল। পথেই খাওয়াদাওয়া, পথেই ঘুম ও যাবতীয় কর্মকাণ্ড। সাত্তারেরা প্রায় দেড় বছর চলার মতো পর্যাপ্ত শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়েছিলেন। সেখানে চিঁড়া-মুড়ি-চাল-ডাল থেকে পাস্তা-নুডলস-চকলেটের মতো অনেক খাবারই ছিল। খাবারের এই মজুদপ্রক্রিয়া সম্ভব হয়েছিল গাড়ির ভেতর একটা ফ্রিজ জুড়ে নিয়েছিলেন বলেই। শুধু ফ্রিজই নয়, সাত্তার ও স্যাল তাঁদের গাড়িটিকে আস্ত একটা ঘরই বানিয়ে ফেলেছেন রীতিমতো! দিনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই মোটামুটি তাঁরা ভরে নিয়েছিলেন সেখানে। পাশাপাশি গাড়ির যন্ত্রাংশ ও মেরামতসামগ্রীও নিয়েছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে।
‘ফ্রান্স থেকে আমরা চলে যাই জার্মানিতে। এরপর পোল্যান্ড, লিথুনিয়া, লাটভিয়া, বেলারুস, ইউক্রেন, স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, স্লোভেনিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়া। এ দেশগুলোর কয়েকটা ছোট আয়তনের, তাই এক দিনেই একটা করে দেশ পেরিয়ে গেছি কখনোসখনো। আর এই দেশগুলো পেরিয়ে যাওয়ার সময় বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় কখনো বা মুগ্ধ, কখনো বা বিরক্ত আর কখনো হতবাক হয়েছি আমরা। তবে তুরস্কে গিয়ে শুধু হতবাকই নয়, পুরোপুরি কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ি আমরা দুজন। সেখানে চলতি পথে পুলিশ সেজে দুজন ডাকাত পথরোধ করে আমাদের। অস্ত্রের মুখে ক্রেডিট কার্ড বাদে যাবতীয় টাকাপয়সা কেড়ে নেয়! স্যাল তো অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল এসব দেখে। তারপর কী করি, পুলিশের কাছে গেলাম। পুরো দুটি দিন সেখানে কাটিয়েও কিছু হয়নি শেষতক। প্রশাসন ব্যর্থ, ডাকাত লাপাত্তা।’ বলছিলেন সাত্তার।
পথে তো নেমেছিলেনই, তবে সেই আকস্মিক বিপদে আক্ষরিক অর্থেই পথে নেমে গিয়েছিলেন সাত্তার ও স্যাল। কী আর করা, ফের সাহসে বুক বেঁধে রাজধানী শহরের দিকে ছুটলেন দুই বিশ্বভ্রমণকারী। কপালগুণে সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা পেলেন। ক্রেডিট কার্ডে কিছু টাকা ছিল, কায়দা-কসরত করে তা ভাঙিয়ে কোনোমতে সাহসটুকু ফিরে পাওয়ার চেষ্টাও চালালেন তাঁরা। তবে অমন বিপদের মধ্যেও প্রকৃতি তাঁদের চোখে বিস্ময় এঁকে দিল।
সাত্তার বললেন সেই বিস্ময়ের কথা, ‘কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।” তুরস্কের পাহাড় না দেখলে ওই পঙিক্তটির মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারতাম না কোনো দিন। সত্যিই সেখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে থাকে! অত উঁচু পাহাড় আর কোথাও দেখিনি আমরা। কত যে বিচিত্র হতে পারে পাহাড়ের রূপ!’ তবে বিস্ময়গ্রস্ত হয়েছিলেন বলেই কিনা আরেক বিপদে পড়লেন সাত্তার ও স্যাল। তুরস্ক ছেড়ে ইরানের পথে চলতে চলতে পথ ভুল করে বসলেন হঠাৎ! উঠে পড়লেন খাড়া এক পাহাড়ের ওপর, তাও আবার এক মাজারের সামনে! অগত্যা পিছু ফিরতে হলো। অনেক কষ্টেসৃষ্টে পথ তো খুঁজে পেলেন, কিন্তু পেটে তখন ছুঁচোর বুকডন চলছে। তাই তড়িঘড়ি করে তুরস্ক-ইরান সীমান্তবর্তী একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লেন ক্ষুধার্ত বিশ্বভ্রমণকারীদ্বয়। বিপদ তাঁদের পিছু ছাড়বে না বলেই পণ করেছিল হয়তো। কারণ, নাশতা করে বসেছেন, হঠাৎ স্যাল পেছন ফিরে দেখেন, রেস্তোরাঁর মালিক ভয়ঙ্কর সব আগ্নেয়াস্ত্র সাফসুতরোতে ব্যস্ত! নতুন বিপদের আশঙ্কা, তাই কিসের নাশতা কিসের কী, সাত্তার গলা নামিয়ে বললেন, ‘পালাও!’
অবাক বাংলাদেশ
পালাও বলেই ইরানের পথে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, ইরানে আবার ভিন দেশিদের জন্য তেলের দাম চার গুণ বেশি। পকেট তখন খাঁ খাঁ করছে। এদিকে জিপিআরএসটাও আর কাজ করছিল না। মানচিত্র থাকলেও তা পড়ার জো নেই, তুরস্ক থেকে কেনা সেই মানচিত্র তুর্কি ভাষায় লেখা। সাত্তার বললেন, ‘আগেই শুনেছিলাম, ইরানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো না।
তাই ইরানে পৌঁছানোর পরদিন খুব সাবধানে মানচিত্র কিনতে বেরিয়ে পড়ি। খুঁজে পেতে একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় লেখা একটা মানচিত্র চাইলাম। দোকানদার জানালেন, ইংরেজি ভাষায় লেখা মানচিত্র নেই, তবে জোগাড় করে দিতে পারবেন। তা জানিয়েই তিনি হুট করে দোকানের ঝাঁপ দিলেন বন্ধ করে! মুখ শুকিয়ে গেল আমাদের। তার পরও ভয়ে ভয়ে সেই দোকানির পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। আরেকটি বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেই একটা মানচিত্র পাওয়া গেল। মজার কাণ্ড ঘটে গেল মানচিত্রের দাম দিতে গিয়েই। সত্যি কথা বলতে, আমাদের পকেট তখন গড়ের মাঠ। তবুও ভান করছি, পয়সা আছে পকেটে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন মানচিত্রের দাম দিয়ে দিতে! কারণ কী? ভদ্রলোকদের জবাব, “তোমরা আমাদের অতিথি না!” তারপর সত্যি সত্যিই তাঁদের মধ্য থেকে সেই প্রথম দোকানি মানচিত্রের দাম দিয়ে দিলেন।’
ভয়-শঙ্কা থাকলেও শেষতক ভালোয় ভালোয় ইরান পেরোতে পেরেছিলেন সাত্তার ও স্যাল। ক্যালেন্ডারে তখন ২০০৯-এর নভেম্বর মাস। তবে বেলুচিস্তান সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে ঢোকার পর থেকেই শুরু হলো ডাকাত-তালেবানের ভয়, আর পথ ভুলে যাওয়ার ভোগান্তি। সঙ্গে সেনাবাহিনীর বেরসিক আচার-আচরণ। কথায় কথায় ‘বহুত খতরনাক’ বুলি। তার ওপর পাঞ্জাবে একদিন এক দানব ট্রাক পেছন থেকে এসে ধাক্কা দিয়ে গেল তাঁদের গাড়িটিকে! শুধু তা-ই নয়, পেরিয়ে আসা পথে যেসব বিপদের মুখোমুখি হননি, এক পাকিস্তানেই তার প্রায় সবই সাত্তার ও স্যালের সামনে উপস্থিত হলো ক্রমান্বয়ে। মোটকথা পুরো নাকাল যাকে বলে। তার পরও অনেক বিপদ অতিক্রম করেন সাত্তারেরা এ বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে চলে আসেন লাহোরে। সেখান থেকে পাকিস্তানের ওয়াঘা সীমান্ত।
তারপর ভারতের আর্টারি। আর সেখান থেকেই শুরু হলো গাড়িবিষয়ক ঝামেলা। বলা হলো, এখানে তোমাদের গাড়ি চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। সাত্তার ও স্যাল বয় প্রমাদ গুনলেন। তার পরও থেমে থাকলেন না। এত সহজেই তো দমে গেলে চলে না। চেষ্টা চলতে থাকল, ফলাফল শূন্য। স্যাল বয় একসময় চরম বিরক্ত হয়ে কানাডায় ফিরে গেলেন।
সাত্তার তখন পুরোপুরি একা। একা হলেও চেষ্টাচরিত্র করে গত ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে গাড়িটি জাহাজে তুলে দিলেন তিনি, চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে। আশা করেছিলেন, বাংলাদেশে পৌঁছালে হয়তো সব ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু কে জানত, তাঁর আশা এভাবে মিথ্যা হয়ে যাবে।
শেষ কোথায়?
চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়িটি ভেড়ার পরই শুরু হলো বিপত্তি। সাত্তার গাড়িটি ছাড়াতে ছুটলেন ঢাকার কমলাপুরের আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দপ্তরে। সেখান থেকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির কর্মকর্তার কাছে। সেখানেও কিছু হলো না। তারপর আমদানি-রপ্তানি দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রকের দরবারে। তাঁরা দেখিয়ে দিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পথ। কষ্টেসৃষ্টে গত ২৬ মে সেখানেও গেলেন সাত্তার। দরখাস্তও করলেন। পুরো আড়াইটি মাস সেখানে ধরণা দেওয়ার পর একটা ছাড়পত্র শেষতক মিলে যায় বটে। সেটি নিয়ে সাত্তার চলে যান আমদানি-রপ্তানি দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রকের কাছে। সেখান থেকে আবার আরেকটি ছাড়পত্র নিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাজির হন চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ে। কিন্তু সেখান থেকে জানিয়ে দিল, ‘এই ছাড়পত্র কেবল বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য।’ সাত্তার বললেন, ‘আমি তো কানাডার নাগরিক।’ প্রত্যুত্তর, ‘আপনি তো দেখতে বাংলাদেশিদের মতো। এ ছাড়পত্র আপনার জন্য নয়। আপনি রাজস্ব অধিদপ্তরে (এনবিআর) যান।’ তা-ই হলো। সেখানে বলা হলো, ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে গাড়িটি ছাড়াতে হবে। কত টাকা লাগবে? উত্তর—৯৫ লাখ টাকা! জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে কেবল সাহসে বুক বেঁধে আছেন সাত্তার। এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? তবে সাত্তার তো শুধু বিশ্বভ্রমণকারীই নন, একজন মুক্তিযোদ্ধাও, তাঁকে কেন এমন হয়রানি পোহাতে হচ্ছে? পৃথিবীর আর কোথাও এমন হেনস্তা হতে হয়নি তাঁকে। অথচ যে বাংলাদেশের কথা তিনি সারা বিশ্বে বলে বেড়ানোর কথা ভেবে পথে নেমেছিলেন, সেই বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলেই তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিশ্বভ্রমণ লাটে ওঠার পালা!
‘অনেক স্বপ্ন আমাদের চোখে। আমাদের বিশ্বভ্রমণের দুই-তৃতীয়াংশ বাকি এখনো। চেয়েছিলাম, বিশ্বভ্রমণ শেষ হলেই গণমাধ্যমের সামনে আসব। কিন্তু না, তা আর হলো না।
যা হোক, এখন সরকারের কাছে একটাই প্রার্থনা, গাড়িটি আমাদের হাতে তুলে দিন। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাটা উড়িয়ে আমরা বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি।’ কথাগুলো বলতে বলতে মধ্যবয়সী সাত্তারের গলা কি কেঁপে উঠল? চোখ কি খানিকটা ভেজা ভেজা? নাহ্, আমাদের চোখ-কানের ভুল হয়তো বা। আবদুস সাত্তারদের মতো সাহসী মুক্তিযোদ্ধা-বিশ্বভ্রমণকারীরা তো হেরে যেতে পারেন না!
==============================
প্রকৃতি- 'বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ' by খসরু চৌধুরী  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'সংসদীয় গণতন্ত্র, না ভানুমতির খেল' by সোহরাব হাসান  গল্পালোচনা- 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু...' by মুস্তাফা জামান আব্বাসী  ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার  খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে  অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান  স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহফুজ রহমান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.