ফিচার গল্প- ‘ইতালির রাস্তায় পুলিশ খুঁজতাম' by বাবুল আক্তার

কিছু দিন আগে ইতালিতে গিয়েছিলাম একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পাঁচ সপ্তাহের মিডিল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে বাংলাদেশ থেকে আমরা গিয়েছিলাম ৯ জন পুলিশ অফিসার। আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৬টি দেশের ৯৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা অংশ নেন এই কোর্সে। ভেন্যু ছিল ভেনিস থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে ভিসেন্জা নামক শহরে। সকাল ৮টায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে ভিসেন্জা পেঁৗছতে আমাদের প্রায় রাত দুটো বেজে গেল। ভেনিস বিমানবন্দরে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম আর খুঁজছিলাম পুলিশের কাউকে দেখা যায় কি না। আমাদের রিসিভ করতে আয়োজক সংস্থার প্রতিনিধি আসার কথা ছিল।
এমন সময় দেখি একজন দীর্ঘদেহী পুলিশ আমাদের কাছে এসে আমরা কিছু বলার আগেই সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, 'আর ইউ ফরম বাংলাদেশ'? আমরা হ্যাঁসূচক জবাব দিতেই তিনি এগিয়ে এসে সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। আমরা সবাই যার যার লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে এএসপি এমদাদ সাহেব বললেন, তাঁর লাগেজটা পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রিসিভ করতে আসা পুলিশ অফিসারের একজন তখন এমদাদ সাহেবকে নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানালেন এবং আশ্বস্ত করলেন, আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই তাঁর ব্যাগ পাওয়া যাবে। ঠিকই দুই দিন পর ব্যাগটি পেঁৗছে দেওয়া হয়। আমরা বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে নির্ধারিত বাসে চেপে রওনা দিলাম। এক ঘণ্টা বাস চলার পর আমরা পেঁৗছলাম ট্রেনিং সেন্টারে। সেন্টারটির নাম 'সেন্টার অব এঙ্েিলন্স ফর স্ট্যাবেলিটি পুলিশ ইউনিট'। বিভিন্ন দেশের পুলিশ অফিসার এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসে। ২০০৫ সালে জি-৮ দেশগুলোর অ্যাকশন প্ল্যান অনুসারে এ ট্রেনিং সেন্টারটি স্থাপিত হয়। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের পুলিশ অফিসার এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের তিন হাজার প্রশিক্ষণার্থী এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মূলত জাতিসংঘে কাজ করার উপযোগী পুলিশ অফিসার গড়ে তোলা হয় এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
আমাদের প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্বে ছিল 'ক্যারাবিনিয়ারি'। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতালির পাঁচ ধরনের পুলিশের মধ্যে ক্যারাবিনিয়ারি অন্যতম। বিশেষ এই বাহিনী চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ অপরাধগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন ও তদন্ত করে থাকে। এদের পোশাক অনেকটা আমাদের র‌্যাবের মতো। ১৯৮১ সাল থেকে এ বাহিনী অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ইতালিতে। মনে হলো মানুষ ক্যারাবিনিয়ারিকে একটু বেশি সম্মান করে। একটা বিষয়ে খেয়াল করলাম, ক্যারাবিনিয়ারির কোনো সদস্য নেইম প্লেট ব্যবহার করে না। ব্যক্তিগত নামে নয়, ক্যারাবিনিয়ারি হিসেবেই তারা পরিচিত। অবশ্য পকেটমার ছাড়া তেমন কোনো অপরাধ ইতালিতে হয় না বললেই চলে। তবে ভ্যাটিকান সিটির জন্য আলাদা পুলিশ রয়েছে। আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছিল ইতালিতে পেঁৗছার দুই দিন পর। এ দুই দিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের আশপাশে। একদিন সকালে আমরা খবরের কাগজের দোকানের সামনে সবাই মিলে গল্প করছি_এমন সময় এক বাঙালির সঙ্গে দেখা হলো। তার মাধ্যমে অনেক বাঙালির খোঁজ পেলাম। ভিসেন্জার ভিয়া মিলানো অধিকাংশ বাংলাদেশির আড্ডাস্থল। কাজ শেষে বাঙালিরা এখানে এসে আড্ডা দেয়। কয়েকজন বাঙালির দোকানও আছে এখানে। আমাদের ট্রেনিং চলত বিকাল ৪-৫টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার আগেই ডিনার সারতে হতো। এটাই ওখানকার নিয়ম। প্রায়ই আমরা ডিনার সেরে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাপাড়ায় যেতাম। বাংলাপাড়া নামটা অবশ্য আমরাই দিয়েছিলাম। ওখানে বাঙালিদের ফোন-ফ্যাঙ্রে দোকানপাটসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে। এখান থেকে আমরা মাঝেমধ্যে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। ট্রেনিং সেন্টার থেকে বাংলাপাড়ায় আসা-যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে ছিল একটা পুলিশ স্টেশন। ইতালিয়ানরা পুলিশ স্টেশনকে কস্তুরা বলে। যতবার কস্তুরার সামনে দিয়ে গিয়েছি, কখনো সেটার সামনে অথবা ভেতরে কোনো লোক দেখিনি। আমাদের দেশে পুলিশ স্টেশন বা থানার সামনে তো সবসময় লোকজন গিজগিজ করে। এখানে কোনো প্রয়োজন হলে পুলিশকে ফোন করলেই যথেষ্ট। কখনো সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি চললে অন্যান্য সব গাড়ি তাকে সাইড দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইতালিতে পুলিশ দিনে ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি করে। এরপর আর কেউ তার খোঁজ করে না। সপ্তাহের দুটো ছুটির দিন এখানে সবাই খুব এনজয় করে। শনি ও রবিবার এখানে সাপ্তাহিক ছুটি। রবিবার তো কোনো কিছুই খোলা থাকে না। সোমবার কাজে যাওয়ার জন্য রবিবার রাত ১০টার মধ্যেই সবাই সবার বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পুলিশের চাকরি করি বলে বাইরে বের হলে পুলিশ খুঁজতাম চারদিকে। কিন্তু পুলিশ কিংবা পুলিশের গাড়ি চোখেই পড়ত না। খুব বেশি ব্যস্ত এলাকায় হয়তো দেখা যেত মাঝেমধ্যে দুজন পুলিশ প্রাইভেট কারে চড়ে টহল দিচ্ছে। পুলিশ না থাকলেও মানুষের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা বেশি। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। কিন্তু কেউ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো আছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। কোনো গাড়ি আইন অমান্য করলে ক্যামেরায় সেটা ধরা পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে ওই গাড়ির মালিকের বাড়িতে পেঁৗছে যায় জরিমানার পরোয়ানা। সেই সঙ্গে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বরও কাটা যায়। হর্ন বাজানোর দরকার হয় না এখানে। গাড়ির হর্ন সারা মাসে শুনেছি একবার। পেছন থেকে হর্ন বাজালে সেটা সামনের গাড়ি চালকের জন্য অবমাননাকর হিসেবে ধরা হয়। পেছন থেকে কেউ হর্ন দিলে সবাই তাকিয়ে থাকে সামনের ওই গাড়ি আর চালকের দিকে।
একদিন বিকেলে আমাদের সঙ্গে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী আতিক ও মাহাবুব স্যারের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছি। একটা পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পার্কে হাঁটাহাঁটি করছেন। হঠাৎ মনে হলো বৃদ্ধা পায়ের কোথাও আঘাত পেয়েছেন। বৃদ্ধ একটা ফোন করলেন। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে দেখি দুই-তিনটা পুলিশের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ও ডাক্তারসহ হাজির। কেউ বৃদ্ধাকে পরীক্ষা করে দেখছে, কেউ ব্যান্ডেজ করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রাথমিক কাজ সেরে বৃদ্ধাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হলো। দেখলাম আর ভাবলাম কতই না পিছিয়ে আছি আমরা। একদিন ডিনার সেরে সন্ধ্যায় যাচ্ছিলাম বাংলাপাড়ার দিকে। কাছাকাছি পেঁৗছতেই দেখি রাস্তার ওপর একটা বিল্ডিং থেকে পানি পড়ছে। এর ফলে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে অসুবিধা হচ্ছিল সাধারণ পথচারীর। কিছু সময় পর দেখা গেল পুলিশের গাড়ি এসে বাড়িওয়ালাকে জরিমানা করে চলে গেল।
জানা গেল ফুলের টবে পানি দিতে গিয়ে একটু বেশি হওয়ায় পানি নিচে পড়েছে। এখানকার মানুষের ভেতরে যে বোধটা বেশি কাজ করে, সেটা হলো কেউ কারোর বিরক্তির কারণ হয় না। এখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি সুবিধা, তা হলো সব নাগরিকের তথ্য আছে তাদের কাছে। কেউ জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সম্পর্কে রেকর্ড তৈরি হতে থাকে। যা সংরক্ষণ করা হয় মৃত্যু পর্যন্ত। কেউ শহরে স্থায়ীভাবে থাকলে অথবা চলে গেলে অথবা দীর্ঘদিন কেউ কারোর বাড়িতে মেহমান হিসেবে থাকলে সেটা পুলিশকে জানাতে হয়। সে কারণে অনেক কিছুই সহজ এখানকার পুলিশের জন্য।
========================
খবর- মৃত ভেবে মাছুমার নিথর দেহ ওরা ফেলে দেয় মহাসড়কে  অদ্ভুত ফিচার- 'বাংলার বিস্ময়ঃ আশ্চর্য কুলাগিনা' by মেহরিন জাহান  স্মরণ- 'ডা. মিলনকে যেন না ভুলি' by পলাশ আহসান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যার যা কাজ' by আতাউস সামাদ  নিবন্ধ- 'অবলা বলে কেন না-বলা থাকবে' by মোস্তফা হোসেইন  ইতিহাস- সিপাহি বিদ্রোহঃ সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে  আন্তর্জাতিক- 'কোরিয়া সীমান্তে তুলকালাম' by দাউদ ইসলাম  আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক  আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম



দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ বাবুল আক্তার

সিনিয়র এএসপি, হাটহাজারী সার্কেল, চট্টগ্রাম

এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.