ওসমানী বিমানবন্দরের ২১১৬ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২ হাজার ১১৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন সিলেটের এক ব্যবসায়ী নেতা। প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো স্মারকলিপিতে তিনি দাবি করেছেন- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্মকর্তাদের অবহেলা, অনিয়ম ও ষড়যন্ত্রের কারণে এ কাজ শেষ হয়নি। এ কারণে আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দরে নামতে পারেনি দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটও। অভিযোগকারী ওই ব্যবসায়ী নেতা হলেন আব্দুল জব্বার জলিল কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার জলিল। সিলেটের একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি নগরের যাত্রীক ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী। স্মারকলিপিতে ওই ব্যবসায়ী নেতা জানান- গত সরকারের আমলে ২ হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওসমানী বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও দেশি-বিদেশি ফ্লাইট চালুর লক্ষ্যে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২০ সালের ২৭শে আগস্ট কাজ শুরু করে ২০২৩ সালের ২৭শে মে’র মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে আরও এক বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও মাত্র ২২ ভাগ কাজ হয়েছে। মাত্র ২২ ভাগ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর এর সংশ্লিষ্টদের কাছে ধরা পড়ে প্রকল্পের নকশাটি ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)’র মানদণ্ডে হয়নি। সিলেটবাসীর ধারণা; প্রকল্পের অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্টরা জ্ঞাতসারেই নকশায় এই ত্রুটি রেখেছিলেন। ফলে শুরুতেই থমকে যায় সিলেটবাসীর স্বপ্নের ওই মেগা প্রকল্প। প্রকল্পে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। স্মারকলিপিতে এ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়; প্রকল্প শুরুর আগেই ইক্যুইপমেন্ট মোবিলাইজেশন বাবত অগ্রিম ২১২ কোটি টাকা গ্রহণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি)। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ২২ ভাগ কাজ হয়েছে বললেও আমার ধারণা এখনো প্রতিষ্ঠানটি ১০০ কোটি টাকার বেশি কাজ করেনি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো অগ্রিম নেয়া টাকার ভাগের হিসাবও দেয়নি। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্নের লক্ষ্যে দু’জন পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলেও ‘সিভিল এভিয়েশন অথোরিটি অব বাংলাদেশ-ক্যাব’র কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার জন্য তারা প্রকল্প থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। আব্দুল জব্বার বলেন- ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নকশায় ত্রুটি রেখে প্রকল্পের কাজ শুরুর একমাত্র কারণ ছিল প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে অর্থ আত্মসাৎ। এর প্রমাণও এখন মিলছে। প্রকল্পের প্রায় ৩০ ভাগ কাজ বাদ দিয়ে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১৬ কোটি ৫০ টাকা। প্রকল্পের মূল নকশা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ৩টি বোডিং ব্রিজ, কার্গো বিল্ডিং অ্যান্ড পার্কিং এরিয়া, কার্গো এনেক্স বিল্ডিং, ফায়ার ফাইটিং স্টেশন। প্রকল্পের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন- তদন্ত করলে প্রকল্পের দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যাবে। স্মারকলিপিতে আব্দুল জব্বার জলিল বলেন- প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলের অন্তত ২৫ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসীদের সিংহভাগই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। মাতৃভূমি ও পরিবার-পরিজনের টানে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে আসেন। তাই সিলেটের প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাতে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোও ওসমানী বিমানবন্দর থেকে অপারেট করার দাবি জানিয়ে আসছে। অতীতে বিভিন্ন সময় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও সিভিল এভিয়েশনের কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঢাকার কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক ও হোটেল মালিক মিলে গঠিত সিন্ডিকেট সেই উদ্যোগ সফল হতে দেননি। কারণ সিলেট থেকে বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চালু হলে সিলেটের প্রবাসীরা সরাসরি সিলেট থেকে যাতায়াত করবেন। এতে ঢাকার ট্রাভেল এজেন্সি ও হোটেল মালিকরা সিন্ডিকেট করে অর্থ লুটপাটের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া নতুন বাংলাদেশ হবে দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত- সারা দেশের মানুষের মতো সিলেটবাসীরাও এমন স্বপ্ন দেখছেন। আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের আপসহীন মনোভাবের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। সিলেটবাসী মনে করছেন; আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে সকল দুর্নীতির শেকড় মূলোৎপাটন করে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ দ্রুত শেষ হওয়ার পাশাপাশি ওসমানীকে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হবে। পূণ্যভূমির আকাশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি উড়োজাহাজ উড়বে। স্মারকলিপিতে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প কাজের অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠান ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দ্রুত প্রকল্পটির কাজ সম্পন্নের উদ্যোগ এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চালুর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। আব্দুল জব্বার জলিল জানান- গতকাল তিনি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ স্মারকলিপি পেশ করেন। এর আগে রেজিস্ট্রার্ড এডি’র মাধ্যমেও তিনি স্মারকলিপির একটি কপি পাঠিয়েছেন। সিলেটের মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টার নজরে আনার জন্য তিনি এ নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান।
No comments