এক বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন ৩ জন, মারা যান রাব্বি by ফাহিমা আক্তার সুমি

২২ বছর বয়সী রাব্বি মিয়া। রাজধানীর তেজগাঁও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পঞ্চম সেমিস্টারে পড়তেন। পাশাপাশি ওয়ালটনে সার্ভিস ম্যানেজমেন্টে চাকরি করতেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনদী নতুন মহল্লার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ২০শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিকালে ঘুম থেকে উঠে চারতলার বেলকনিতে যান রাব্বি। এ সময় একটি গুলি এসে রাব্বির বুকের পাশে বিদ্ধ হয়ে অপর পাশে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে ঢলে পড়ে সেখানেই মারা যান তিনি। রাব্বির গ্রামের বাড়ি জামালপুরের নয়াপাড়ায়। তার বাবা আব্দুর রহিম কৃষিকাজ করতেন। বয়সের ভার ও অসুস্থতার কারণে বর্তমানে ঘরে থাকেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রাব্বি ছিলেন ছোট। বাবার অভাবের সংসারে বড় ভাইয়ের পাশাপাশি রাব্বিও হাল ধরতে চেয়েছিলেন। তবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার।

রাব্বির বড় ভাই অন্তর মিয়া মানবজমিনকে বলেন, রাব্বি আমাদের পরিবারের আলো ছিল। আমি একটি কোচিং সেন্টারে চাকরি করি। রাব্বি মাত্র পাঁচ মাস চাকরি শুরু করেছিলো পড়াশোনার পাশাপাশি। চেয়েছিলাম রাব্বির পড়া শেষ হলে দুই ভাই মিলে বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করবো। রাব্বি আমাদের খুব আদরের ছিল, ওকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে বাবা-মা। রাব্বির সঙ্গে ঘটনার দিন সকাল ৯টায় শেষ কথা হয়েছে। ওকে কল দিয়ে গুলির মধ্যে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তখন কে জানতো যে বাসার মধ্যেও মানুষ নিরাপদ নয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলো রাব্বি। ৭ বছর ধরে ঢাকায় থাকতো। তিনি বলেন, সেদিন সারাদিন মায়ের খুব মন খারাপ হচ্ছিলো, রাব্বিকে বার বার কল দিতে বলেছিলেন মা। কিন্তু কল করলে রাব্বি রিসিভ করে না। পরে বিকাল পাঁচটার দিকে আবার কল করলে তার এক সহকর্মী জানায় রাব্বি অসুস্থ। পরে সত্যি ঘটনা খুলে বলে। একজন মানুষ ঘরের মধ্যে এভাবে মারা যায় কী করে? আমরা কীভাবে এটি মেনে নিবো? আমার একমাত্র ভাইকে হারিয়ে আমি একা হয়ে গিয়েছি। রাব্বির মৃত্যুতে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাবা তো আগে থেকেই অসুস্থ। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে আমার ভাই আর নেই। আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।
সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনদী নতুন মহল্লার এই বাসাটিতে গিয়ে দেখা যায়, দরজায় এখনো রয়েছে গুলির ক্ষতচিহ্ন। সেখানে শুধু রাব্বি গুলিবিদ্ধ হননি। সানজিদা নামে এক নারী ও রনি নামে আরেকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় বাসাটির বারান্দার গ্রিল ধরে ঝুলে ছিল একটি শিশুও। তিনজন একসঙ্গে গুলিবিদ্ধ হলেও শিশুটির গায়ে গুলি লাগেনি। দুইজন বেঁচে ফিরলেও রাব্বি ঘটনাস্থলে মারা যান। আহত সানজিদাদের ভাড়া বাসায় সাবলেট নিয়ে থাকতেন রাব্বি ও রনি।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহত সানজিদা বলেন, সেদিন ছিল আমাদের জীবনের খুব ভয়াবহ দিন। এখনো মনে পড়লে ঘুমাতে পারি না। বাইরে ঝামেলা হচ্ছে সেটি আমরা জানতাম না। আমার চার বছরের মেয়ে বেলকনিতে থাকায় তাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য আনতে যাই। নিচে তাকিয়ে দেখি অনেক লোক। এ সময় আমার মেয়েকে বেলকনি থেকে নিয়ে ভেতরে মাত্র এক পা ফেলি। পেছন থেকে এসে গুলি লাগে আমার কোমরের কাছে। তখন বিকাল পাঁচটা বাজে। পেছন দিক থেকে যে আমার গুলি লেগেছে সেটি আমি বুঝতে পারিনি। আরেকটি গুলি আমার হাতে স্পর্শ করে চলে যায়। পেটেরটা অপারেশন করে বের করতে হয়েছে। গুলিটা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাই মেঝেতে। আমার মেয়ে তখন আমার সামনে ছিল। আমাদের একটি রুমে রনি ও রাব্বি ভাড়া থাকতেন। এ সময় তারা দু’জন ঘুম থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার মেয়ে বেলকনির গ্রিলের উপরে উঠে নিচে দেখতেছিল। আমার শরীরে গুলি লাগার পর পেছন সাইডে ঘুরে দেখি রাব্বি বেলকনিতে পড়ে আছে। তার হাতের নিচে লেগে বুকের পাশ থেকে আরেক পাশে বের হয়ে যায় গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সে মারা যায়। রনিরও গুলি লাগে। তিনি বলেন, আমাকে ও রনিকে প্র-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সানজিদার মা আমেনা বলেন, সেদিন বাইরে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল কেউ এগিয়ে আসেনি। রাব্বি তো ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমার মেয়ে ও রনিকে নিয়ে কোনো মতে মানুষের হাত-পা ধরে হাসপাতালে যাই। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি লাগে। ভাগ্য ভালো যে আমার নাতনিটার কিছু হয়নি। খবর পেয়ে রাত সাড়ে তিনটা বাজে রাব্বির স্বজনরা এসে লাশ নেয়। ততক্ষণে সে মেঝেতেই পড়ে ছিল। তখন রাস্তায় কোনো গাড়ি পাওয়া যায়নি। যখন আমরা হাসপাতালে যাই তখন বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়েছে। আমার ঘরে ও বাইরের দৃশ্য দেখে আমার বুক কাঁপছিল। আমার ঘরে একটা লাশ আরও দুইজন আহত কীভাবে আমি স্বাভাবিক থাকি। তিনজনের চারটা গুলি লাগে। রাব্বির অবস্থা খুব ভয়াবহ ছিল সঙ্গে সঙ্গে সে মেঝেতে পড়ে মারা যায়।
আহত রনি বলেন, আমরা সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাসার নিচে কান্নার আওয়াজ শুনে দেখার জন্য যাই বারান্দায়। গিয়ে দেখি নিচে এক ব্যক্তির গুলি লেগেছে সে চিৎকার করছে। আমরা দাঁড়ানোর ১-২ মিনিট পরই গুলিটা আসে। সম্ভবত হেলিকপ্টার থেকে গুলিগুলো এসেছিল। এখন শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও ডান হাতে ভারী কিছু নিতে পারছি না। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। আমার বাড়ি বরিশালে। ওয়ালটনে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করি। গুলি লাগার পরে আমি বুঝতে পারিনি শুধু দেখলাম রাব্বি হঠাৎ পড়ে গেছে মেঝেতে। ও যখন পড়ে যায় তখন আমি তাকিয়ে দেখি রক্ত মেঝেতে ভরে যাচ্ছে। পরে দেখি আমার শরীরেও গুলিবিদ্ধ হয়। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.