মশা কাহিনি ও ডেঙ্গু প্রসঙ্গ
মশা
সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মশা বেঁচে
থাকার জন্য আমাদের রক্ত খায়। আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা বিভিন্ন ফলমূল
থেকে বেঁচে থাকার জন্য জুস হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু নারী
মশাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজন হয়।
মশা বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হঠাৎ করে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে, এমনকি বেশকিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে এ কারণে। সাধারণত মশার বাড়াবাড়ি আমরা শীতকালে লক্ষ করি। কিন্তু এ সময়ে কীভাবে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেল, তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সত্যিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একটি ছোট্ট জীব কীভাবে মহাশক্তিশালী মানুষের মৃত্যুর কারণে পরিণত হতে পারে, তা কি ভাবনার বিষয় নয়? এখানে কি আমাদের জন্য কোনো শিক্ষা আছে?
কোরআনে মশা সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মোমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল? এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাউকেও বিপথগামী করেন না।’ (সূরা বাকারা : ২৬)।
এ আয়াতে সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমনÑ ১. মশা সৃষ্টির মধ্যেও মানুষের জন্য আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে। ২. মশার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্টি রয়েছে। ৩. বিশ্বাসীরাই কোরআনে বর্ণিত বিষয়গুলো সত্য-সঠিক হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন করে। ৪. অবিশ্বাসীরা কোনো কিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে পারে না। ৫. এ রকম নিদর্শনও মানুষের জন্য সঠিক পথের দিশা হতে পারে। ৬. আবার অনেককে বিপথগামী করতে পারে। ৭. অসৎ ব্যক্তিদের আল্লাহ কখনও সঠিক পথে নেন না।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষ করলেও আমরা আশ্চর্য হব এটা জেনে যে, কোরআন যে তথ্য প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে মানবজাতিকে দিয়েছিল, তা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কোরআনের বিশুদ্ধতা নয়; বরং কোরআন যে একটি জীবন্ত মোজেজা, তা-ও বিবেচিত হচ্ছে। এ আয়াতে তিনটি বৈজ্ঞানিক বিষয়কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যথা :
১. প্রথমত, গঠনগত কারণে মশার সৃষ্টি অন্য যে কোনো প্রাণী থেকে অনন্য, এমনকি অন্যান্য উড়ন্ত পতঙ্গ থেকেও অনেকগুলো কারণে ভিন্ন।
২. দ্বিতীয়ত, কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ ‘বাউদাহ’ মূলত স্ত্রীবাচক শব্দ, যা নারী মশাকে বোঝায়। আধুনিক বিজ্ঞান এরই মধ্যে এটি প্রমাণ করেছে যে, শুধু স্ত্রী মশাই মানুষের রক্ত খায়। রক্ত খায় তারা তাদের ডিমে নিউট্রিশনের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য।
৩. তৃতীয়ত, মশার চেয়েও ভিন্ন পতঙ্গ রয়েছে, যারা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের থেকে রক্ত খায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৯২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানী এফ ডব্লিউ এডওয়ার্ডস তার গবেষণাপত্রে দাবি করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মালয় অঞ্চলে এমন এক ধরনের পতঙ্গ পাওয়া গেছে, যা মশা থেকেই রক্ত খায়। তিনি এ প্রাণীটির নাম দিয়েছেন কুলিকোইডস এনোফেলিস। (দেখুন : সায়েন্টিফিক আমেরিকা, মস্কিউটস হেভ ফ্লাইং, ব্লাড সাকিং প্যারাসাইট অব দিয়ার ওন, ২০১৪)।
মশা সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মশা বেঁচে থাকার জন্য আমাদের রক্ত খায়। আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা বিভিন্ন ফলমূল থেকে বেঁচে থাকার জন্য জুস হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু নারী মশাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজন হয় এবং এটি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এ রক্ত সংগ্রহ করার সময় তাদের দ্বারা বাহিত বিভিন্ন রকমের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে আমাদের বিভিন্ন রকম অসুখ হয়। অর্থাৎ স্ত্রী মশারাই আমাদের মশাবাহিত রোগের মূল কারণ।
মশার কথা আল্লাহ কেন কোরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করেছে। মশার আচরণ, প্রকৃতি ও গঠনগত দিক থেকে বেশকিছু তথ্য তারা আবিষ্কার করেছেন, যা সত্যিই সচেতন যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দেবে। এর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলোÑ ১. প্রায় ২ হাজার ৭০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। ২. মশার একশরও বেশি চোখ রয়েছে। ৩. মশার মুখে ৪৮টা দাঁত রয়েছে। ৪. একটি মশার তিনটি পূর্ণ হার্ট (হৃদযন্ত্র) রয়েছে। ৫. মশার নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছুরির পৃথক ব্যবহার তারা করে থাকে। ৬. মশার শরীরে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন আছে, যা রাতের আঁধারে মানুষের চামড়াকে শনাক্ত করার কাজে লাগায়। ৭. প্রত্যেক মশার নিজস্বভাবে এনেসথেশিয়া দেওয়ার জন্য একধরনের ভ্যাকসিন আছে, যা মানুষের শরীরে তাদের হুল ফোটানোর মাধ্যমে রক্ত নেওয়ার সময় ব্যবহার করে সেই জায়গাটাকে অবশ করে নেয়, যাতে রক্ত নিলেও কোনো ব্যথা না পাই আমরা। ৮. রক্ত পরীক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা এদের আছে। কারণ এরা সব ধরনের রক্ত পছন্দ করে না। ৯. পূর্ণিমার সময় মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়। ১০. মশা ওড়ার সময় সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তাদের পাখা নাড়ায়। ১১. বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্য সব প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী। ১২. ১৮ ফুট দূর থেকে তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারে। ১৩. পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশিদিন বাঁচে। ১৪. মশার মতো আরও একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ আছে, যা মশা থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞান মশা সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের দিয়েছে; তবু আমরা বলব, আরও অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। কার্যকরী উপায় বের হওয়ার আগেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে শক্তিমান এ মানবজাতির অনেককেই। তাই ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান হয়তো সেগুলোকেও আমাদের জানিয়ে দেবে।
আচ্ছা এতকিছু জানার পরও কি মনে হচ্ছে মশার মধ্যে কোনো নিদর্শন নেই? আমরা কি এখনও খুঁজে পাচ্ছি না মশার মাঝে আল্লাহর মহত্ত্ব, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা? যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে আরও একটা আয়াতকে স্মরণ করিয়ে দিই আপনাদের। আল্লাহ ঘোষণা করছেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়, একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সবাই একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়; তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।’ (সূরা হজ : ৭৩)।
আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব সম্পর্কে শুধু নয়; বরং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। আর আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যেও এমনভাবে নিহিত রয়েছে, যা করার ক্ষমতা কারও তো নেই-ই; বরং সেসব বিষয়ের চিন্তা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
মশা নিয়ে কোরআনের আরও একটি গল্প মনে করিয়ে দিতে চাই। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সময়ের রাজার নাম ছিল নমরুদ। সে নিজেকে এতটাই উচ্চতায় ভাবত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবেও দাবি করেছিল। জন্ম, মৃত্যু, খাদ্যের জোগান সবকিছু তার ক্ষমতার মধ্যে বলেও দাবি করেছিল। তার সঙ্গে নবী ইবরাহিম (আ.) এর একটি কথোপকথন আল্লাহ তায়ালা কোরআনে উল্লেখ করেছেন। (দেখুন : সূরা বাকারা : ২৫৮)। এ নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এ মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবি করা এ পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে।
কোরআনের এ গল্পটি আমাদের স্মরণ করে দেয় মশার ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন আমাদের পরীক্ষা করার নিমিত্তে হতে পারে, তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব কী হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে? কী পরিস্থিতি পার করছি আমরা। জীবন সেখানে অনিরাপদ হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, পাপের প্রসারতা, মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপকতা, হারামকে হালাল মনে করার প্রবণতা, দুর্নীতি বৃদ্ধি, ন্যায়বিচারের উপেক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনীহাসহ অন্যান্য কারণ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হতে পারে। আল্লাহই জানেন প্রকৃত রহস্য, উদ্দেশ্য। তবু হঠাৎ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং এরই মধ্যে কিছু প্রাণহানি কিন্তু আমাদের অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশু কোনো পথ দেখছি না। আমাদের প্রত্যেকের উচিত সৃষ্টিকর্তা যার ক্ষমতা শুধু অসীম নয়; বরং সবকিছুতে তাঁর কর্তৃত্ব সমাসীন, চিরস্থায়ী তার কাছেই জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি দোয়া আমাদের শিখিয়েছেন। তারই ভাষায়Ñ ‘আউযু বি কালিমাতিল্লাহি তাম্মাতি মিন শারির মা খালাক্বা।’ (অর্থ : আল্লাহর পূর্ণ কালিমার বিনিময়ে তাঁর সৃষ্টির সব অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি)। (দেখুন : সুনানু আবি দাউদ : ৩৮৯৮ এবং ৩৮৯৯)। আল্লাহ আমাদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন!
মশা বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হঠাৎ করে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে, এমনকি বেশকিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে এ কারণে। সাধারণত মশার বাড়াবাড়ি আমরা শীতকালে লক্ষ করি। কিন্তু এ সময়ে কীভাবে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেল, তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সত্যিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একটি ছোট্ট জীব কীভাবে মহাশক্তিশালী মানুষের মৃত্যুর কারণে পরিণত হতে পারে, তা কি ভাবনার বিষয় নয়? এখানে কি আমাদের জন্য কোনো শিক্ষা আছে?
কোরআনে মশা সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মোমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল? এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাউকেও বিপথগামী করেন না।’ (সূরা বাকারা : ২৬)।
এ আয়াতে সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমনÑ ১. মশা সৃষ্টির মধ্যেও মানুষের জন্য আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে। ২. মশার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্টি রয়েছে। ৩. বিশ্বাসীরাই কোরআনে বর্ণিত বিষয়গুলো সত্য-সঠিক হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন করে। ৪. অবিশ্বাসীরা কোনো কিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে পারে না। ৫. এ রকম নিদর্শনও মানুষের জন্য সঠিক পথের দিশা হতে পারে। ৬. আবার অনেককে বিপথগামী করতে পারে। ৭. অসৎ ব্যক্তিদের আল্লাহ কখনও সঠিক পথে নেন না।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষ করলেও আমরা আশ্চর্য হব এটা জেনে যে, কোরআন যে তথ্য প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে মানবজাতিকে দিয়েছিল, তা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কোরআনের বিশুদ্ধতা নয়; বরং কোরআন যে একটি জীবন্ত মোজেজা, তা-ও বিবেচিত হচ্ছে। এ আয়াতে তিনটি বৈজ্ঞানিক বিষয়কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যথা :
১. প্রথমত, গঠনগত কারণে মশার সৃষ্টি অন্য যে কোনো প্রাণী থেকে অনন্য, এমনকি অন্যান্য উড়ন্ত পতঙ্গ থেকেও অনেকগুলো কারণে ভিন্ন।
২. দ্বিতীয়ত, কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ ‘বাউদাহ’ মূলত স্ত্রীবাচক শব্দ, যা নারী মশাকে বোঝায়। আধুনিক বিজ্ঞান এরই মধ্যে এটি প্রমাণ করেছে যে, শুধু স্ত্রী মশাই মানুষের রক্ত খায়। রক্ত খায় তারা তাদের ডিমে নিউট্রিশনের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য।
৩. তৃতীয়ত, মশার চেয়েও ভিন্ন পতঙ্গ রয়েছে, যারা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের থেকে রক্ত খায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৯২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানী এফ ডব্লিউ এডওয়ার্ডস তার গবেষণাপত্রে দাবি করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মালয় অঞ্চলে এমন এক ধরনের পতঙ্গ পাওয়া গেছে, যা মশা থেকেই রক্ত খায়। তিনি এ প্রাণীটির নাম দিয়েছেন কুলিকোইডস এনোফেলিস। (দেখুন : সায়েন্টিফিক আমেরিকা, মস্কিউটস হেভ ফ্লাইং, ব্লাড সাকিং প্যারাসাইট অব দিয়ার ওন, ২০১৪)।
মশা সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মশা বেঁচে থাকার জন্য আমাদের রক্ত খায়। আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা বিভিন্ন ফলমূল থেকে বেঁচে থাকার জন্য জুস হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু নারী মশাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজন হয় এবং এটি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এ রক্ত সংগ্রহ করার সময় তাদের দ্বারা বাহিত বিভিন্ন রকমের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে আমাদের বিভিন্ন রকম অসুখ হয়। অর্থাৎ স্ত্রী মশারাই আমাদের মশাবাহিত রোগের মূল কারণ।
মশার কথা আল্লাহ কেন কোরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করেছে। মশার আচরণ, প্রকৃতি ও গঠনগত দিক থেকে বেশকিছু তথ্য তারা আবিষ্কার করেছেন, যা সত্যিই সচেতন যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দেবে। এর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলোÑ ১. প্রায় ২ হাজার ৭০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। ২. মশার একশরও বেশি চোখ রয়েছে। ৩. মশার মুখে ৪৮টা দাঁত রয়েছে। ৪. একটি মশার তিনটি পূর্ণ হার্ট (হৃদযন্ত্র) রয়েছে। ৫. মশার নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছুরির পৃথক ব্যবহার তারা করে থাকে। ৬. মশার শরীরে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন আছে, যা রাতের আঁধারে মানুষের চামড়াকে শনাক্ত করার কাজে লাগায়। ৭. প্রত্যেক মশার নিজস্বভাবে এনেসথেশিয়া দেওয়ার জন্য একধরনের ভ্যাকসিন আছে, যা মানুষের শরীরে তাদের হুল ফোটানোর মাধ্যমে রক্ত নেওয়ার সময় ব্যবহার করে সেই জায়গাটাকে অবশ করে নেয়, যাতে রক্ত নিলেও কোনো ব্যথা না পাই আমরা। ৮. রক্ত পরীক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা এদের আছে। কারণ এরা সব ধরনের রক্ত পছন্দ করে না। ৯. পূর্ণিমার সময় মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়। ১০. মশা ওড়ার সময় সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তাদের পাখা নাড়ায়। ১১. বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্য সব প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী। ১২. ১৮ ফুট দূর থেকে তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারে। ১৩. পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশিদিন বাঁচে। ১৪. মশার মতো আরও একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ আছে, যা মশা থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞান মশা সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের দিয়েছে; তবু আমরা বলব, আরও অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। কার্যকরী উপায় বের হওয়ার আগেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে শক্তিমান এ মানবজাতির অনেককেই। তাই ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান হয়তো সেগুলোকেও আমাদের জানিয়ে দেবে।
আচ্ছা এতকিছু জানার পরও কি মনে হচ্ছে মশার মধ্যে কোনো নিদর্শন নেই? আমরা কি এখনও খুঁজে পাচ্ছি না মশার মাঝে আল্লাহর মহত্ত্ব, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা? যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে আরও একটা আয়াতকে স্মরণ করিয়ে দিই আপনাদের। আল্লাহ ঘোষণা করছেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়, একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সবাই একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়; তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।’ (সূরা হজ : ৭৩)।
আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব সম্পর্কে শুধু নয়; বরং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। আর আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যেও এমনভাবে নিহিত রয়েছে, যা করার ক্ষমতা কারও তো নেই-ই; বরং সেসব বিষয়ের চিন্তা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
মশা নিয়ে কোরআনের আরও একটি গল্প মনে করিয়ে দিতে চাই। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সময়ের রাজার নাম ছিল নমরুদ। সে নিজেকে এতটাই উচ্চতায় ভাবত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবেও দাবি করেছিল। জন্ম, মৃত্যু, খাদ্যের জোগান সবকিছু তার ক্ষমতার মধ্যে বলেও দাবি করেছিল। তার সঙ্গে নবী ইবরাহিম (আ.) এর একটি কথোপকথন আল্লাহ তায়ালা কোরআনে উল্লেখ করেছেন। (দেখুন : সূরা বাকারা : ২৫৮)। এ নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এ মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবি করা এ পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে।
কোরআনের এ গল্পটি আমাদের স্মরণ করে দেয় মশার ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন আমাদের পরীক্ষা করার নিমিত্তে হতে পারে, তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব কী হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে? কী পরিস্থিতি পার করছি আমরা। জীবন সেখানে অনিরাপদ হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, পাপের প্রসারতা, মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপকতা, হারামকে হালাল মনে করার প্রবণতা, দুর্নীতি বৃদ্ধি, ন্যায়বিচারের উপেক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনীহাসহ অন্যান্য কারণ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হতে পারে। আল্লাহই জানেন প্রকৃত রহস্য, উদ্দেশ্য। তবু হঠাৎ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং এরই মধ্যে কিছু প্রাণহানি কিন্তু আমাদের অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশু কোনো পথ দেখছি না। আমাদের প্রত্যেকের উচিত সৃষ্টিকর্তা যার ক্ষমতা শুধু অসীম নয়; বরং সবকিছুতে তাঁর কর্তৃত্ব সমাসীন, চিরস্থায়ী তার কাছেই জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি দোয়া আমাদের শিখিয়েছেন। তারই ভাষায়Ñ ‘আউযু বি কালিমাতিল্লাহি তাম্মাতি মিন শারির মা খালাক্বা।’ (অর্থ : আল্লাহর পূর্ণ কালিমার বিনিময়ে তাঁর সৃষ্টির সব অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি)। (দেখুন : সুনানু আবি দাউদ : ৩৮৯৮ এবং ৩৮৯৯)। আল্লাহ আমাদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন!
No comments