ক্যাসিনো রাজা খালেদের উত্থান যেভাবে by শুভ্র দেব
এলাকায়
তিনি বড় ভাই নামেই পরিচিত। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা হলেও বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে উঠেছেন শাহজাহানপুর
রেলওয়ে কলোনিতে। একসময় জড়িয়ে পড়েন নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। ভারতে পলাতক
শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের নির্দেশে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর,
কমলাপুর এলাকার বাজার ও বিভিন্ন স্থাপনা থেকে চাঁদা উঠাতেন। মানিককে ধরিয়ে
দেবার জন্য সরকার পুরষ্কার ঘোষণা করার পর পালিয়ে ভারতে চলে যায়। ভারতে বসেই
সে এলাকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। খালেদ চাঁদাবাজি করে টাকা
তুলে সেই টাকার একটি অংশ ভারতে মানিকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সরকার
পরিবর্তনের পর রং পাল্টান খালেদ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর যুবলীগ
নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন। ২০১৩ সালে তিনি অনেক নেতাকর্মী নিয়ে
আনুষ্ঠানিকভাবে যুবলীগে যোগ দেন। যুবলীগের মহানগর কাউন্সিলে তিনি সাংগঠনিক
সম্পাদকের পদ পেয়ে যান। আলোচনা আছে পদটি পেতে তিনি বড় অংকের অর্থ ব্যয়
করেন। ২০১৪ সালে যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ারে নিহত হন
ঘাতক আরেক নেতা তারেক। এর পর যুবলীগের প্রভাবশালী এক নেতার ছত্রছায়ায় খালেদ
শক্তিশালী হতে থাকেন। ক্ষমতার অপ্রব্যবহার করে ছোট বড় অনেক নেতাকে শহর
ছাড়া করতে শুরু করেন। তার ভয়ে দেশ ছেড়েছেন কেউ কেউ। বুধবার রাতে ক্যাসিনো
রাজা বলে খ্যাত খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার গ্রেপ্তারের পর তাকে নিয়ে আলোচনা এখন
দেশজুড়ে। যেই রেল কলোনীতে তার বেড়ে উঠা সেখানেও তাকে নিয়ে চলছে নানা
আলোচনা। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও এলাকার ত্রাস এই নেতার বিষয়ে এখন
সবাই কথা বলছেন প্রকাশ্যে। ওইসব এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা
অপকর্ম হতো তার নেতৃত্বে। অস্ত্র ও দেহরক্ষী নিয়ে তিনি চলাফেরা করতেন।
গতকাল পুরো এলাকা ঘুরে তার সম্পর্কে পাওয়া গেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাফর আহমেদ খোকনের সঙ্গে এক সময় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন খালেদ। পরে তিনি খিলগাঁও এলাকার আরেক পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে। জিসানের সহযোগীতা নিয়ে তিনি চাঁদাবাজির পাশাপাশি টেন্ডারবাজিতে নাম লেখান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে শুরু করে রেলভবন, গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার বিভিন্ন জোনের টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। সেখানকার টাকার ভাগ চলে যেত জিসানের কাছে। কিছুদিন পর জিসানের সঙ্গে টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয় খালেদের। তারপর জিসানের কাছ থেকেও সরে আসেন খালেদ। জিসানের ক্যাডার বাহিনীকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ধরিয়ে দেন। এককভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেন খালেদ। এরপর থেকে জিসান-খালেদ দ্বন্ধ চরম আকার ধারন করে। খালেদের ওপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে জিসানের। খালেদ তখন থেকে বিশাল ক্যাডার বাহিনীর প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করেন। তার সঙ্গে অস্ত্রধারী কিছু ক্যাডার থাকেন। গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে বিদেশে বসে জিসান খালেদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
গত জুলাই মাসে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম ঢাকার খিলগাঁর সিপাহীবাগ এলাকা থেকে ফয়সাল নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই এলাকার ফাইভ স্টার নিবাসের আট তলায় অভিযান চালিয়ে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশী অস্ত্র ও ১টি রিভলবার উদ্ধার করে। গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে তারা সবাই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ক্যাডার বাহিনী। যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্য জিসানই এই অস্ত্রগুলো তাদেরকে সরবরাহ করেছে। ওই নেতার সঙ্গে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ে দ্বন্ধ চলছে জিসানের। এদিকে খালেদ জিসানের কাছ থেকে দুরে সরে এসে সখ্যতা গড়ে তুলেন থাইল্যান্ডে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় দুজনে মিলে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন। সূত্র বলছে, তারা দুজনে মিলে ব্যাংককে একটি টু স্টার মানের হোটেল করেছেন। এছাড়া ফ্ল্যাট ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। কুয়ালালামপুরে অভিজাত সুপারমল প্যাভিলিয়নে এগার কোটি টাকা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। স্কটল্যান্ডে বাড়ি কিনেছেন। অনুসন্ধানে জানাগেছে, রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, মেরাদিয়া, বনশ্রী, রামপুরা, মুগদা এলাকার সবকিছুই খালেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব এলাকায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই খালেদ ছাড়া কেউ নিতে পারত না। সবকিছুতেই তার হস্তক্ষেপ থাকত। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে বলেছে, এসব এলাকায় খোদ আওয়ামী লীগের নেতাদের আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ ছিল না।
এছাড়া ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। সবার কাছে খালেদ বড় ভাই নামে পরিচিত। সিটি কর্পোরেশনের কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে অবৈধভাবে মাছের বাজার, ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি। রেলওয়ের জমি দখল করে ৯০টি দোকান নির্মান, খিলগাঁও কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি সবই খালেদ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে চাঁদা তোলার কাজ তিনি নিজে করতেন না। করতেন তার অধীনস্থ নেতাকর্মীরাই। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট কালোবাজারিতে খালেদের হাত আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্টেশনের সামনে সিটি করপোরেশনের একটি পাবলিক টয়লেট দখল করে তিনি বাস কাউন্টার বানিয়ে শ্যামলী পরিবহণের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। খিলগাঁও বাজারের পেছনে মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত বিনোদন ক্লাবে জুয়ার আসর বসাতেন। এই ক্লাবেরও হর্তাকর্তা তিনি। এলাকায় কেউ ভবন নির্মাণ করতে চাইলে তাকে আগে খুশি করতে হত। তা না হলে ভবন নির্মাণে বাধা প্রদান করত খালেদের ক্যাডার বাহিনী। মতিঝিল, ফকিরাপুল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেটের হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে তার লোকজন। কেউ চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টোপাশে ইস্টার্ন কমলাপুর টাওয়ারের টর্চার সেলে তাকে নিয়ে যেতেন। সেখানে ওই ব্যক্তির উপর চলত নির্যাতন। বুধবার র্যাবের একটি অভিযানিক টিম খালেদের টর্চার সেলে অভিযান চালিয়েছে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনেক গোপন তথ্য দিয়েছেন। খালেদ ও যুবলীগের আরেক শীর্ষ নেতা মিলেই ক্যাসিনোর রমরমা বাণিজ্য করতেন। অন্তত ১৭টি ক্যাসিনো তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ক্যাসিনোয় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য হত। এসব টাকার ভাগ তারা পুলিশ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, কথিত সাংবাদিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দিতেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসি, এসিরা পেতেন। এমনকি ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি ডিএমপি পুলিশ সদরদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা জানতেন বলে দাবি করেছেন খালেদ। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে নেতাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত উপহার দিতে হয়। র্যাবসূত্র বলছে, ক্যাসিনো ক্লাবগুলোতে চেয়ারম্যান হিসাবে একজন সংসদ সদস্যকে সামনে রাখা হয়। যদিও ক্লাবে তাদের আনাগোনা তেমন একটা থাকে না। মতিঝিল, পল্টন ও ফকিরাপুল এলাকায় গড়ে উঠা অধিংকাশ ক্লাব একজন কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খালেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুটি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন ওই কাউন্সিলর। বাকিগুলো খালেদই করেন। আবার এই দুজনকে নিয়ন্ত্রণ করেন দক্ষিণ যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা। সরজমিন গতকাল শাহজাহানপুর রেল কলোনি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শতাধিক অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগ নেতা খালেদের হাতে। এসব স্থাপনা ভাড়া দিয়ে তিনি প্রতি মাসে হাতিয়ে নিতেন অর্ধশত কোটি টাকা। এছাড়া রেলওয়ের স্টাফদের জন্য বরাদ্দকৃত পাকা ভবনের দখলও এই নেতা করতেন। সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে স্টাফদের কাছ থেকে এককালীন টাকায় এসব কোয়ার্টার কিনে নেয়া হয়েছে। এখন বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। খিলগাঁও কাঁচাবাজার মার্কেটের পাশে রেলওয়ের জমি দখল করে ৯০টি দোকান কোঠা তৈরি করেছেন। এসব দোকান থেকে বরাদ্ধের নামে টাকা নিয়েছেন। এসব দোকানের ব্যবসায়ীরা এখন বিপাকে পড়েছেন।
কারন রেলওয়ে এই অবৈধ মার্কেট ভেঙ্গে দিবে। তাই ব্যবসায়ীরা তাদের অগ্রিম টাকা না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। সুচনা ডেকোরেটার্সের মালিক কাওসার বলেন, খুব বিপদে আছি। এসব জুলুমবাজদের কাছ থেকে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করুক। পুরো এলাকাটাকে জিম্মি করে রেখেছিল। সব কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব নেই। সবই একজন। তার ওপরে কথা বলার কেউ নেই। এখানে রেলওয়ের কর্মচারিদের জন্য তিনটি ক্লাব ছিল। প্রত্যেকটি ক্লাব খালেদ ও তার ক্যাডার বাহিনীরা দখল করেছে। রেলওয়েরে কর্মচারিদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। এই ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। আমি ডেকোরেটার্সের ব্যবসা করি। কোনো অনুষ্ঠানে তারা মালামাল নিয়ে ব্যবহার করে টাকা দিতে চায় না।
চার ক্যাসিনো সিলগালা: র্যাব জানিয়েছে বুধবার তারা ঢাকার চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়েছে। এসব ক্যাসিনোয় অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা, ডলাল, বিদেশী মদ, নেশাজাতীয় দ্রব্য, ক্যাসিনো পরিচালনার সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে। ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকাসহ ১৪২ জনকে আটক করা হয়। আটককৃতদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। বনানীর আহম্মেদ টাওয়ারে অবস্থিত গোল্ডর ঢাকা বাংলাদেশ ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে কাউকে না পেয়ে সেটি সিলগালা করে দেয় র্যাব। মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লবে অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ ২৭৮ হাজার টাকা, ২০ হাজার ৫০০ জাল টাকাসহ ক্যাসিনোটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে ৪ রাখ ৯৮ হাজার ৬০০ টাকাসহ ক্যাসিনো পরিচালনা ও খেলার অভিযোগে ৪০ জনকে আটক করা হয়।
খালেদের বিরুদ্ধে তিন মামলা: এদিকে র্যাব খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে এ মামলাগুলো করা হয়। এসব মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল খালেদকে আদালতে হাজির করেছেন গুলশান থানার পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। আদালত শুনানি শেষে অস্ত্র ও মাদক মামলায় ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া মাদক আইনে মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগে বুধবার রাতে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্রসহ আটক করে র্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে একটি শর্টগান, দুটি পিস্তল, শর্টগানের ৫৭ রাউন্ড গুলি ও ৭.৬৫ এএম এর ৫৩ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। এছাড়া ৫৮৫ পিস ইয়াবা, ১০ লাখের বেশি নগদ টাকা ও সাত লাখের মত বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাফর আহমেদ খোকনের সঙ্গে এক সময় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন খালেদ। পরে তিনি খিলগাঁও এলাকার আরেক পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে। জিসানের সহযোগীতা নিয়ে তিনি চাঁদাবাজির পাশাপাশি টেন্ডারবাজিতে নাম লেখান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে শুরু করে রেলভবন, গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার বিভিন্ন জোনের টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। সেখানকার টাকার ভাগ চলে যেত জিসানের কাছে। কিছুদিন পর জিসানের সঙ্গে টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয় খালেদের। তারপর জিসানের কাছ থেকেও সরে আসেন খালেদ। জিসানের ক্যাডার বাহিনীকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ধরিয়ে দেন। এককভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেন খালেদ। এরপর থেকে জিসান-খালেদ দ্বন্ধ চরম আকার ধারন করে। খালেদের ওপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে জিসানের। খালেদ তখন থেকে বিশাল ক্যাডার বাহিনীর প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করেন। তার সঙ্গে অস্ত্রধারী কিছু ক্যাডার থাকেন। গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে বিদেশে বসে জিসান খালেদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
গত জুলাই মাসে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম ঢাকার খিলগাঁর সিপাহীবাগ এলাকা থেকে ফয়সাল নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই এলাকার ফাইভ স্টার নিবাসের আট তলায় অভিযান চালিয়ে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশী অস্ত্র ও ১টি রিভলবার উদ্ধার করে। গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে তারা সবাই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ক্যাডার বাহিনী। যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্য জিসানই এই অস্ত্রগুলো তাদেরকে সরবরাহ করেছে। ওই নেতার সঙ্গে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ে দ্বন্ধ চলছে জিসানের। এদিকে খালেদ জিসানের কাছ থেকে দুরে সরে এসে সখ্যতা গড়ে তুলেন থাইল্যান্ডে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় দুজনে মিলে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন। সূত্র বলছে, তারা দুজনে মিলে ব্যাংককে একটি টু স্টার মানের হোটেল করেছেন। এছাড়া ফ্ল্যাট ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। কুয়ালালামপুরে অভিজাত সুপারমল প্যাভিলিয়নে এগার কোটি টাকা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। স্কটল্যান্ডে বাড়ি কিনেছেন। অনুসন্ধানে জানাগেছে, রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, মেরাদিয়া, বনশ্রী, রামপুরা, মুগদা এলাকার সবকিছুই খালেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব এলাকায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই খালেদ ছাড়া কেউ নিতে পারত না। সবকিছুতেই তার হস্তক্ষেপ থাকত। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে বলেছে, এসব এলাকায় খোদ আওয়ামী লীগের নেতাদের আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ ছিল না।
এছাড়া ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। সবার কাছে খালেদ বড় ভাই নামে পরিচিত। সিটি কর্পোরেশনের কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে অবৈধভাবে মাছের বাজার, ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি। রেলওয়ের জমি দখল করে ৯০টি দোকান নির্মান, খিলগাঁও কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি সবই খালেদ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে চাঁদা তোলার কাজ তিনি নিজে করতেন না। করতেন তার অধীনস্থ নেতাকর্মীরাই। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট কালোবাজারিতে খালেদের হাত আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্টেশনের সামনে সিটি করপোরেশনের একটি পাবলিক টয়লেট দখল করে তিনি বাস কাউন্টার বানিয়ে শ্যামলী পরিবহণের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। খিলগাঁও বাজারের পেছনে মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত বিনোদন ক্লাবে জুয়ার আসর বসাতেন। এই ক্লাবেরও হর্তাকর্তা তিনি। এলাকায় কেউ ভবন নির্মাণ করতে চাইলে তাকে আগে খুশি করতে হত। তা না হলে ভবন নির্মাণে বাধা প্রদান করত খালেদের ক্যাডার বাহিনী। মতিঝিল, ফকিরাপুল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেটের হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে তার লোকজন। কেউ চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টোপাশে ইস্টার্ন কমলাপুর টাওয়ারের টর্চার সেলে তাকে নিয়ে যেতেন। সেখানে ওই ব্যক্তির উপর চলত নির্যাতন। বুধবার র্যাবের একটি অভিযানিক টিম খালেদের টর্চার সেলে অভিযান চালিয়েছে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনেক গোপন তথ্য দিয়েছেন। খালেদ ও যুবলীগের আরেক শীর্ষ নেতা মিলেই ক্যাসিনোর রমরমা বাণিজ্য করতেন। অন্তত ১৭টি ক্যাসিনো তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ক্যাসিনোয় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য হত। এসব টাকার ভাগ তারা পুলিশ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, কথিত সাংবাদিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দিতেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসি, এসিরা পেতেন। এমনকি ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি ডিএমপি পুলিশ সদরদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা জানতেন বলে দাবি করেছেন খালেদ। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে নেতাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত উপহার দিতে হয়। র্যাবসূত্র বলছে, ক্যাসিনো ক্লাবগুলোতে চেয়ারম্যান হিসাবে একজন সংসদ সদস্যকে সামনে রাখা হয়। যদিও ক্লাবে তাদের আনাগোনা তেমন একটা থাকে না। মতিঝিল, পল্টন ও ফকিরাপুল এলাকায় গড়ে উঠা অধিংকাশ ক্লাব একজন কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খালেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুটি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন ওই কাউন্সিলর। বাকিগুলো খালেদই করেন। আবার এই দুজনকে নিয়ন্ত্রণ করেন দক্ষিণ যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা। সরজমিন গতকাল শাহজাহানপুর রেল কলোনি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শতাধিক অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগ নেতা খালেদের হাতে। এসব স্থাপনা ভাড়া দিয়ে তিনি প্রতি মাসে হাতিয়ে নিতেন অর্ধশত কোটি টাকা। এছাড়া রেলওয়ের স্টাফদের জন্য বরাদ্দকৃত পাকা ভবনের দখলও এই নেতা করতেন। সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে স্টাফদের কাছ থেকে এককালীন টাকায় এসব কোয়ার্টার কিনে নেয়া হয়েছে। এখন বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। খিলগাঁও কাঁচাবাজার মার্কেটের পাশে রেলওয়ের জমি দখল করে ৯০টি দোকান কোঠা তৈরি করেছেন। এসব দোকান থেকে বরাদ্ধের নামে টাকা নিয়েছেন। এসব দোকানের ব্যবসায়ীরা এখন বিপাকে পড়েছেন।
কারন রেলওয়ে এই অবৈধ মার্কেট ভেঙ্গে দিবে। তাই ব্যবসায়ীরা তাদের অগ্রিম টাকা না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। সুচনা ডেকোরেটার্সের মালিক কাওসার বলেন, খুব বিপদে আছি। এসব জুলুমবাজদের কাছ থেকে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করুক। পুরো এলাকাটাকে জিম্মি করে রেখেছিল। সব কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব নেই। সবই একজন। তার ওপরে কথা বলার কেউ নেই। এখানে রেলওয়ের কর্মচারিদের জন্য তিনটি ক্লাব ছিল। প্রত্যেকটি ক্লাব খালেদ ও তার ক্যাডার বাহিনীরা দখল করেছে। রেলওয়েরে কর্মচারিদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। এই ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। আমি ডেকোরেটার্সের ব্যবসা করি। কোনো অনুষ্ঠানে তারা মালামাল নিয়ে ব্যবহার করে টাকা দিতে চায় না।
চার ক্যাসিনো সিলগালা: র্যাব জানিয়েছে বুধবার তারা ঢাকার চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়েছে। এসব ক্যাসিনোয় অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা, ডলাল, বিদেশী মদ, নেশাজাতীয় দ্রব্য, ক্যাসিনো পরিচালনার সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে। ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকাসহ ১৪২ জনকে আটক করা হয়। আটককৃতদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। বনানীর আহম্মেদ টাওয়ারে অবস্থিত গোল্ডর ঢাকা বাংলাদেশ ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে কাউকে না পেয়ে সেটি সিলগালা করে দেয় র্যাব। মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লবে অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ ২৭৮ হাজার টাকা, ২০ হাজার ৫০০ জাল টাকাসহ ক্যাসিনোটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে ৪ রাখ ৯৮ হাজার ৬০০ টাকাসহ ক্যাসিনো পরিচালনা ও খেলার অভিযোগে ৪০ জনকে আটক করা হয়।
খালেদের বিরুদ্ধে তিন মামলা: এদিকে র্যাব খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে এ মামলাগুলো করা হয়। এসব মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল খালেদকে আদালতে হাজির করেছেন গুলশান থানার পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। আদালত শুনানি শেষে অস্ত্র ও মাদক মামলায় ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া মাদক আইনে মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগে বুধবার রাতে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্রসহ আটক করে র্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে একটি শর্টগান, দুটি পিস্তল, শর্টগানের ৫৭ রাউন্ড গুলি ও ৭.৬৫ এএম এর ৫৩ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। এছাড়া ৫৮৫ পিস ইয়াবা, ১০ লাখের বেশি নগদ টাকা ও সাত লাখের মত বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়।
No comments