কারগিল যুদ্ধ: যেভাবে জেনারেল মোশাররফের ফোনে আড়ি পেতেছিল ভারত
আপডেট- ২৬ জুলাই ২০১৯: ভারতের দিল্লি থেকে বিবিসি সাংবাদিক রেহান ফজলের প্রতিবেদন।
২৬ মে, ১৯৯৯। রাত সাড়ে নটার সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান, জেনারেল ভেদ প্রকাশ মালিকের ঘরে ফোন বেজে উঠল।
সাধারণ ফোন নয়। এই একেবারে গোপন আর নিরাপদ ফোন লাইন, ইংরেজিতে যাকে বলে সিকিওর ইন্টারনাল এক্সচেঞ্জ ফোন।
অন্য প্রান্তে ছিলেন ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর এজেন্সি রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং বা 'র'-এর সচিব অরভিন্দ দাভে।
তিনি জেনারেল মালিককে বলেন, পাকিস্তানের দুই জেনারেলের মধ্যে কথোপকথন তারা রেকর্ড করেছেন।
দুই
জেনারেলের কথাবার্তার কিছুটা অংশ পড়েও শোনালেন মি. দাভে এবং বললেন, "এই
কথোপকথনের মধ্যে বেশ কিছু গোপন তথ্য রয়েছে, যেটা আমাদের কাছে খুবই
গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।"
সেই ফোনের কথা মনে করে জেনারেল মালিক
বিবিসিকে বলছিলেন, "দাভের এই ফোনটা আসলে করা উচিত ছিল ডাইরেক্টর জেনারেল
মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সকে। কিন্তু তার সেক্রেটারি ভুল করে আমার নম্বরে ফোন
করে ফেলেছিল। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে ডি জি এম আইয়ের [সেনাবাহিনীর
নিজস্ব গুপ্তচর বিভাগ] বদলে আমার কাছে ফোনটা চলে এসেছে, খুব লজ্জা
পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলেছিলাম ওই কথোপকথন লিখিত আকারে যেন আমাকে খুব
তাড়াতাড়ি পাঠানো হয়।"
"পুরোটা যখন আমি পড়লাম, তখন আমি আবারও
অরভিন্দ দাভেকে ফোন করলাম। বলেছিলাম, আমার ধারণা এর মধ্যে একটা গলার স্বর
জেনারেল মোশাররফের। তিনি সেই সময়ে চীনে ছিলেন। আর অন্য গলাটা আরেকজন খুব
সিনিয়র জেনারেলের। আমি দাভেকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওই দুটো ফোন নম্বরে আড়ি
পাতা যেন বন্ধ না হয়। 'র' সেই কাজটা চালিয়ে গিয়েছিল," জানাচ্ছিলেন
জেনারেল মালিক।
বিবিসিকে তিনি আরও বলছিলেন, "দিন তিনেক পরে দুই
পাকিস্তানি জেনারেলের মধ্যে আবারও একটা কথোপকথন রেকর্ড করে 'র'। কিন্তু
এবার আমাকে বা ডি জি এম আইকে না পাঠিয়ে তারা ওই ফোনালাপের লিখিত বয়ান
পাঠিয়ে দিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র আর প্রধানমন্ত্রী
অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে।"
এর কদিন পরে ২ জুন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী আর মি. মিশ্রর সঙ্গে মুম্বাইতে নৌবাহিনীর একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন জেনারেল মালিক।
ফেরার সময়ে প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ফোনে আড়ি পেতে নতুন কী তথ্য পাওয়া গেল।
"তখন
ব্রজেশ মিশ্র বুঝতে পারলেন যে আমার কাছে পরের রেকর্ডিংগুলো লিখিত ভাবে
আসেই নি। দিল্লিতে ফিরেই তিনি পুরো ট্র্যান্সস্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন," বলছিলেন জেনারেল মালিক।
এই একটা ঘটনাতেই পরিষ্কার হয়ে
যায় যে যুদ্ধের সময়েও নিজের দপ্তরের গুরুত্ব বজায় রাখতে গোয়েন্দা তথ্য
সবাইকে না পাঠিয়ে কিছু বাছাই করা ব্যক্তির কাছে পাঠানো হচ্ছিল।
কী কথা হয়েছিল দুই পাকিস্তানী জেনারেলের মধ্যে?
আজিজ: 'পাকিস্তান থেকে বলছি। রুম নম্বর ৮৩৩১৫-এ ফোনটা কানেক্ট করে দিন।'
মোশাররফ: 'হ্যালো আজিজ'
আজিজ:
এদিকের অবস্থা একইরকম। ওদের একটা এম আই ১৭ হেলিকপ্টার আমরা ধ্বংস করে
দিয়েছি। আপনি কালকের খবর শুনেছেন? মিঞা সাহেব তার ভারতীয় সমকক্ষের সঙ্গে
কথা বলেছেন। তিনি ওদের জানিয়ে দিয়েছেন যে ওরাই ব্যাপারটাকে বাড়িয়ে
তুলছেন। বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করার আগে ওদের যে আরও অপেক্ষা করা উচিত
ছিল, সেটাও বলেছেন। তবে উত্তেজনা কমাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজকে
দিল্লিতে পাঠাতে পারেন, এই প্রস্তাবও দিয়েছেন।'
মোশাররফ: 'আচ্ছা! এই এম আই ১৭ হেলিকপ্টারটা কি আমাদের এলাকায় ভেঙ্গে পড়েছে?'
আজিজ:
'না স্যার। ওদের এলাকাতেই পরেছে। তবে আমরাই যে ওটা ধ্বংস করেছি, সেই দাবি
করিনি আমরা। মুজাহিদিনদের দিয়ে দাবি করিয়েছি যেন ওরাই নামিয়েছে
হেলিকপ্টারটা।'
মোশাররফ: 'ভাল করেছ।'
আজিজ: 'দৃশ্যটা দেখার মতো ছিল স্যার। আমার চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়ল ওদের হেলিকপ্টারটা।'
মোশাররফ: 'ওয়েল ডান। এখন কি আমাদের সীমার কাছাকাছি ওদের বিমান ঘোরাঘুরি করছে? ওরা ভয় পেয়েছে কী না, সেটা বল।'
আজিজ: 'হ্যাঁ। ওরা খুব চাপে আছে। ওদের বিমান কমই ঘুরছে এখন।'
মোশাররফ: 'বাহ। খুব ভাল।'
কথোপকথনের টেপ নওয়াজ শরীফকে শোনানোর সিদ্ধান্ত
পয়লা জুন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী আর মন্ত্রীসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির সদস্যদের ওই ফোনালাপ শোনানো হয়েছিল।
তার
তিন দিন পরে ভারত সিদ্ধান্ত নিল যে ওই টেপ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
নওয়াজ শরীফকে শোনানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠল ওই অতি সংবেদনশীল টেপ নিয়ে
কে যাবে ইসলামাবাদ!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে
নামকরা সাংবাদিক আর কে মিশ্রকে এই দায়িত্ব দেওয়ার কথা হয়। তিনি তখন
অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। তাকে ভারতে ফিরিয়ে এনে এই গুরুভার দেওয়া হয়।
ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে যাতে তাকে তল্লাশির মুখোমুখি না হতে হয়, সেইজন্য তাকে কূটনীতিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
তার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিবেক কাটজুকেও পাঠানো হয়েছিল।
নওয়াজ শরিফের সঙ্গে জলখাবার খেতে খেতে আর কে মিশ্র ওই টেপ শুনিয়েছিলেন আর ট্র্যান্সস্ক্রিপ্টটা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
মি.
মিশ্র আর মি. কাটজু সেদিনই কাজ শেষ করে সন্ধ্যের মধ্যে দিল্লি ফিরে
এসেছিলেন। এটা এতটাই গোপন রাখা হয়েছিল যে ওই সময়ে এটার কথা ঘুণাক্ষরেও
কেউ টের পায় নি।
বেশ কিছুদিন পরে ৪ জুলাই শুধুমাত্র কলকাতা থেকে
প্রকাশিত দা টেলিগ্রাফ কাগজে প্রণয় শর্মা একটা খবর লিখেছিলেন। হেডলাইন ছিল
'ডেলহি হিটস শরিফ উইথ আর্মি টেপ টক', অর্থাৎ দিল্লি শরিফকে সেনাবাহিনীর
কথোপকথন শুনিয়ে সরাসরি আঘাত করেছে।
ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে
নওয়াজ শরীফকে টেপ শোনানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিবেক
কাটজুকে ইসলামাবাদে পাঠানো হয়েছিল।
'র'-এর অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব বি রমন ২০০৭ সালে 'আউটলুক' পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন এ নিয়ে।
লেখাটার
শিরোনাম ছিল 'কারগিল টেপ প্রকাশ করাটা কি মাস্টারস্ট্রোক হয়েছিল না বড়
ভুল ছিল'! সেখানে তিনি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে নওয়াজ শরীফকে কথোপকথনের
রেকর্ডিংটা শুনিয়ে সেটা যেন আবার ফেরত নিয়ে আসা হয়। কোনওমতেই যেন ওই টেপ
ওদের হাতে না দেওয়া হয়।
আর কে মিশ্র অবশ্য অস্বীকার করেন যে তিনি
মি. শরীফকে টেপ শোনাবার কাজে যুক্ত ছিলেন। বিবেক কাটজুও কখনও জনসমক্ষে
ব্যাপারটা স্বীকার করেন নি।
পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সফরের আগে জনসমক্ষে টেপ প্রকাশ করে ভারত
নওয়াজ
শরীফকে ওই কথোপকথন শোনানোর এক সপ্তাহ পরে, ১১ জুন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র
মন্ত্রীর সরতাজ আজিজের ভারত সফরে আসা ঠিক ছিল। মি. আজিজ ভারতের মাটিতে পা
দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ভারত একটা সংবাদ সম্মেলন করে ওই টেপ জনসমক্ষে প্রকাশ
করে দেয়।
কয়েকশো কপি তৈরি করে দিল্লিতে প্রতিটা বিদেশি দূতাবাসে সেই টেপ পাঠানো হয়েছিল।
গোপনীয়তাকে এত অবহেলা কীভাবে করলেন মুশারফ
ভারতীয় গুপ্তচরেরা ঘটনার এত বছর পরেও এটা কখনও বলেন না যে কীভাবে ওই ফোনালাপে আড়ি পাতা হয়েছিল।
পাকিস্তানিরা
মনে করেন এর পেছনে সি আই এ অথবা মোসাদের সাহায্য পেয়েছিল ভারত। যারা ওই
টেপ শুনেছেন, তাদের সবারই মনে হয়েছে যে ইসলামাবাদের দিক থেকে কথা অনেক
স্পষ্ট। তাই সম্ভবত ইসলামাবাদ থেকেই আড়ি পাতা হয়েছিল।
কারগিল
যুদ্ধের ওপরে বহুল চর্চিত বই 'ফ্রম কারগিল টু দা ক্যু' বইতে পাকিস্তানী
সাংবাদিক নাসিম জাহেজা লিখেছেন, "নিজের চীফ অফ স্টাফের সঙ্গে সাধারণ
টেলিফোন লাইনে এত সংবেদনশীল কথোপকথন খোলাখুলি করে জেনারেল মোশাররফ প্রমাণ
করে দিয়েছিলেন যে তিনি কতদূর বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। ওই ফোনালাপেই
প্রমাণ হয়ে যায় যে কারগিল অপারেশনে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বের কতটা মদত
ছিল।"
ঘটনাচক্রে, আত্মজীবনী 'ইন দা লাইন অফ ফায়ার'-এ জেনারেল
পারভেজ মোশাররফ কিন্তু এই টেপ-কাণ্ডের কোনও উল্লেখই করেন নি। তবে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার পরে ভারতীয় সম্পাদক এম জে আকবরকে
দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ওই টেপের কথা তিনি স্বীকার করে নেন।
টেপ প্রকাশের পরেই সরতাজ আজিজ দিল্লিতে
নওয়াজ
শরীফকে কথোপকথনের রেকর্ড শোনানোর এক সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র
মন্ত্রী সরতাজ আজিজ দিল্লি এসেছিলেন। পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস সচিব বেশ
উদ্বিগ্ন হয়ে বিমানবন্দরের ভি আই পি লাউঞ্জে ঘোরাঘুরি করছিলেন সেদিন।
তার হাতে অন্তত ছটা ভারতীয় খবরের কাগজ ছিল, যেগুলোতে মোশাররফ-আজিজ কথোপকথনের খবরটা শীর্ষ শিরোনাম হিসাবে ছাপা হয়েছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যশবন্ত সিং বেশ শীতলভাবেই হাত মিলিয়েছিলেন মি. আজিজের সঙ্গে।
ওই
টেপের মাধ্যমেই সারা দুনিয়ার কাছে প্রমাণিত হয়েছিল যে কারগিলের ঘটনায়
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হাত ছিল না আর তার সেনাবাহিনী কারগিল
অভিযানের বিষয় গোপন করে রেখেছিল।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় জেনারেল পারভেজ মোশাররফ |
No comments