৫ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল নিয়ে নানা নাটক by দীন ইসলাম
পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল নিয়ে
নাটকের পর নাটক হয়েছে। অভিযুক্তদের বাঁচাতে সরকারের ভেতরের নানা শক্তিশালী
গ্রুপ লবিস্ট হিসেবে কাজ করছে। স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞার পক্ষে
লবিস্ট হিসেবে সবচেয়ে বেশি সাফাইকারী তৎপর রয়েছেন। স্বাস্থ্য সচিবের
লবিস্টকারীর তালিকায় রয়েছেন সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ
সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তাদের সবার
মুখে এক কথা, স্বাস্থ্য সচিব লোকটি খুব ভাল। তিনি অনেক স্কুল-কলেজ নির্মাণ
করেছেন। এলাকায় দান করার ক্ষেত্রে তার সুনাম রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে
পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএ হান্নান
মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগেও পাঁচ সচিবের সনদ
বাতিল নিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল
হক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর প্রতিবেদন পাওয়ার পর থেকে তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে এক চুলও ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। অবশ্য বিভিন্ন
পক্ষের তদবিরের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোল্লা
ওয়াহেদুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা সনদটি বাতিল না করে স্থগিত করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, দুদকের তদন্তে
মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় গত ১৪ই সেপ্টেম্বর
চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব অর্থাৎ পাঁচ সিনিয়র আমলার মুক্তিযোদ্ধা সনদ
বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। এরপর থেকেই এ
নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএ
হান্নান। জামুকায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে চলে
যান বিদেশ সফরে। দেশে ফিরে সার্টিফিকেট বাতিলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে যেন জামুকা’র সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন না হয়। এ জন্য যারপরনাই চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার অফিসে এসেই
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ
বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলেন। মন্ত্রীর আদেশ শোনার পর থেকেই এ
নিয়ে শুরু হয় নানা টালবাহানা। এরপর কয়েক দফা তাগাদা দিলেও মন্ত্রীর
নির্দেশ কাজে আসেনি। বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এদিন বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সচিবকে
উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, আমি আসছি। আপনি থাকেন। এসেই সনদ বাতিলের
প্রজ্ঞাপন জারি করবো। একথা বলে মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর পরই সচিব তার
কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের আদেশ জারি
করতে তোমাদের এত আগ্রহ কেন? তোমরা বাসায় চলে যাও। মন্ত্রী অফিসে ফেরার আগ
পর্যন্ত আমি থাকছি। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে মন্ত্রী ফিরে আসার পর সচিবকে
তার রুমে সালাম জানান। সচিব মন্ত্রীর রুমে আসা মাত্রই সনদ বাতিলের ফাইলের
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। তখন সচিব ডেস্ক অফিসার সলিমুল্লাহকে খুঁজতে
থাকেন (যদিও সচিবের নির্দেশে আগেই অফিস ত্যাগ করেন ডেস্ক অফিসার)। কয়েকবার
খোঁজার পর না পেয়ে মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সচিব বলেন, স্যার আজকে অফিসের
সবাই চলে গেছেন। কাল সকালে এসেই প্রজ্ঞাপন জারি করবো। সোমবার নির্ধারিত
সময়ের মধ্যেই অফিসে আসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তবে সচিব বিভিন্ন
অজুহাত দিয়ে দুপুরে অফিসে আসেন। এরই মধ্যে মন্ত্রী তাকে কয়েকবার খোঁজাখুঁজি
করেও পাননি। মন্ত্রীর পীড়াপীড়িতে বিকালে চার সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ
বাতিল এবং একজনের সনদ স্থগিত করার আদেশ জারি করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে,
সোমবার সন্ধ্যার কিছু পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে
দেশ ছাড়েন। সনদ বাতিলের আদেশটি প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয় যাতে গরম কোন সিদ্ধান্ত না নেয় এজন্যই সোমবার বিকালে আদেশ জারি
করা হয়। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ
উদ্দিন মিয়ার যাওয়ার বিষয়টি মসৃণ করার জন্যও এমনটা করা হয়। ওদিকে
মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হওয়া চার সচিব হলেন স্বাস্থ্য সচিব এম নিয়াজ উদ্দিন
মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব একেএম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ
বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী (বর্তমানে ওএসডি) এবং
একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার। অন্যদিকে
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান
বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে
রয়েছেন। তার সনদটি স্থগিত করা হয়েছে।
No comments