ভর্তি পরীক্ষায় ‘মেধাবীদের’ ফেলের রেকর্ড by নুর মোহাম্মদ ও ফররুখ মাহমুদ
উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার আর জিপিএ-৫ এ রেকর্ড গড়ার প্রতিযোগিতা চলছে কয়েক বছর ধরে। প্রতি বছরই বাড়ছে পাসের হার। রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী পাচ্ছে জিপিএ পাঁচ। পাস আর জিপিএ-তে রেকর্ড গড়া এসব শিক্ষার্থীরা শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রতিযোগিতায় নেমে। আগের বছরগুলোর মানের পরীক্ষা হলেও ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার নেমে এসেছে লজ্জাজনক অবস্থায়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটে মাত্র পাঁচ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে যাওয়া পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় পাসের হার পাঁচ থেকে ২০ ভাগের বেশি হচ্ছে না। ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের এমন দৈন্যদশাকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মানকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা নানাভাবে এ অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার অগ্রগগির ব্যাপারে সরকার মুখে যা বলছে বাস্তবতার চিত্র কিন্তু উল্টো। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ তিনটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট এক লাখ ৬৬ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী। যাদের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৩০ হাজার ৬২০ জন। শতকরা হিসেবে যা ১৭.১৮ শতাংশ। এবার উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ। আর এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। সবেচেয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মঙ্গলবার প্রকাশিত ঢাবির ‘বি’ ইউনিটে ফল। সেখানে পাসের হার ৯.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ পাস করতে পারেনি ৯১ ভাগ শিক্ষার্থী। শিক্ষার মান উদ্বেগজনক জানিয়ে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, সরকার মান নয়, পাসের দিকে ঝোঁকার কারণেই এ অবস্থা।
একই চিত্র ছিল ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাতেও। সে বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৫৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়। এর আগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৫ ভাগ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৫৩ ভাগ জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়।
২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৭৮.৩৩ ভাগ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। আর এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে ৯৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৩১৩? অথচ ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইউনিটের প্রকাশ ফলাফলে পাসের হার গড়ে ১৭.১৮ শতাংশ। এর মধ্যে ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ। পরীক্ষা অংশগ্রহণ করার সবাই জিপিএ-৩.৫ থেকে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ ধারী। ২০১৩ সালে এইচএসসি ও সমমানের পাসের হার ছিল ৭৪.৩০ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। আর এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৮৯.৭২ শতাংশ। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির পাঁচটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২ লাখ ১৭ হাজার ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৪১ হাজার ৮৯১ জন। পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হন এক লাখ ৭৫ হাজার। পাসের হার ছিল ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে ‘চ’ ইউনিটে ৯৫ ভাগ, ‘গ’ ইউনিটের ৯১ ভাগ, ‘খ’ ইউনিটের ৮৬ ভাগ, ‘ঘ’ ইউনিটের ৯১ ভাগ এবং ‘এ’ ইউনিটে ৫৮ ভাগ শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৮৩ ভাগ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৮১ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করতে ব্যর্থ হন। ঢাবি কেন্দ্রীয় ভর্তি কেন্দ্রর তথ্যের অনুযায়ী, পাঁচটি ইউনিটে ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় পাস নম্বর ৪৮ (৪০% হিসাবে)। এর মধ্যে ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটে বাংলায় ৮ (পূর্ণ নম্বর ৩০), ইংরেজি ৮ (পূর্ণ নম্বর ৩০) ও সাধারণ জ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞানে ১৭ (পূর্ণ নম্বর ৬০) নম্বর করে পেলে তিন বিষয়ে পাস হিসেবে ধরা হয়। আর ‘গ’ ইউনিটে ইংরেজিতে পাস নম্বর ১২।
ভর্তির ফলে একই চিত্র দেখা গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ভতি পরীক্ষায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটের ৪৬ হাজার ৯শ’ ৮৯ জন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৯ হাজার ৭শ’ ৬৭ জন। পসের হার ১৬.২৪ শতাংশ। ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে মাত্র ৪.৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে তাতে ওই ইউনিটের আসন পূরণ করতে কোন সমস্যা হবে না। বেশি পাস দেখিয়ে পরীক্ষা ভর্তি হতে না পারলে শিক্ষার্থীদের মনে কষ্ট থাকে বলেও তিনি জানান।
শুধু ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হারেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্ধারিত নম্বর না পাওয়ায় অনেক বিভাগে আসনই পূর্ণ করতে পারছে না কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ইংরেজিতে নির্ধারিত নম্বর রয়েছে যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে ওইসব বিষয়ে আসন খালি থাকছে। সার্বিক ভর্তি ফলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মানে গুণগত কোন পরিবর্তন আসেনি এটি তারই প্রমাণ। পাস নয় শিক্ষার মানের দিকে তাকাতে সরকারকে পরামর্শ দেন এ শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ভাল ফল করেও এত বেশি সংখ্যক ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে না পারা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এর সমাধানে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এস এম ফায়েজ বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নম্বর দিয়ে সাহস দেয়া যায়। তবে নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার পক্ষে নই আমি। এতে শিক্ষার্থীরা সহজে ভাল নম্বর পাওয়ায় পরবর্তীতে পড়ালেখায় একটু ঢিলেমি দিয়ে দেয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে এমন বিপর্যয় হচ্ছে। কলা অনুষদের ডিন ও ‘খ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেন, পাঠ্যবই থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে প্রশ্ন করা হয়। তারপরও শিক্ষার্থীরা ভাল করতে পারে না। তিনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় খাতা যথাযথ মূল্যায়ন না করা, স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষকের অভাবের কারণে এ সমস্যাগুলো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সংখ্যক আসন রয়েছে। তাই এই পরীক্ষা নেয়া হয় বাদ দেয়ার জন্য। এখানে পাস ফেলে কোন সমস্যা না। এবার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাবিতে ‘খ’ ইউনিটে পাস করতে পারেনি এক শিক্ষার্থী। ফেল করার কারণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওই শিক্ষার্থী জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে যা পড়ানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তার ধারে-কাছেও নেই। তিনি বলেন, এইচএসসির পড়াশোনার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার কোন মিল নেই।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই, হ-য-ব-র-ল শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে পাসের দিকে বেশি নজর দেয়া, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না করিয়ে অপরিকল্পিত সৃজনশীল পদ্ধতি চালু, সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং-এর প্রভাব, শ্রেণীকক্ষে সঠিক পাঠদানের ঘাটতি, অনুপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পাস করার প্রবণতা তৈরি করে দেয়া, ক্লাসরুমে পাঠ্যবইয়ে মনোযোগ না দেয়ার কারণে উচ্চশিক্ষার ভর্তিযুদ্ধে শিক্ষার্থীরা হোঁচট খাচ্ছে। মঙ্গলবার রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনরা বলেন, জোর করে পাসের হার বাড়ানো হচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারছে না সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা মান বেড়েছে এমন দাবিতে অনড় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসএসসি-এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো হয় না কেন? এক ঘণ্টার এমসিকিউ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার সার্বিক মান যাচাই করা যায় না বলেও দাবি তার।
ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ভর্তিযোগ্য ২ জন
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে ভর্তির হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী। অথচ এই বিভাগে আসন সংখ্যা ১২৫টি। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে ইংরেজিতে ২০ নম্বর পাওয়ার পাশাপাশি ইলেক্টিভ ইংলিশে ১৫ নম্বর পেতে হয়। মঙ্গলবার প্রকাশ হওয়া ‘বি’ ইউনিটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে সমসংখ্যক নম্বর পেয়েছেন। ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৫টি অংশ ছিল। এগুলো হলো- সাধারণ ইংরেজি, বাংলা, ইলেক্টিভ ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান ‘এ’ ও সাধারণ জ্ঞান ‘বি’। শিক্ষার্থীদের ৫টির মধ্যে ৪টি অংশ নিজেদের যোগ্যতাসাপেক্ষে নির্বাচন করার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রত্যেক বিষয়ে মোট ২৫টি প্রশ্নে ৩০ নম্বর ছিল। ১ ঘণ্টায় মোট ১২০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। ভর্তি নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়, ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় পাসসহ সাধারণ ইংরেজিতে ২০ নম্বর পেতে হবে। তবে ভর্তি পরীক্ষার তিন দিন আগে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর পরীক্ষায় উত্তরপত্রের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে ঢাবির কলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেন, ইংরেজি বিভাগে আসন সংখ্যা ১২৫টি। এ বছর এ বিভাগে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভর্তির যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি আমিও শুনেছি। শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পড়াশোনা না করায় এমনটা ঘটেছে। শিক্ষার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিষয়টা আমিও শুনেছি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার অগ্রগগির ব্যাপারে সরকার মুখে যা বলছে বাস্তবতার চিত্র কিন্তু উল্টো। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ তিনটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় মোট এক লাখ ৬৬ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী। যাদের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৩০ হাজার ৬২০ জন। শতকরা হিসেবে যা ১৭.১৮ শতাংশ। এবার উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ। আর এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। সবেচেয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মঙ্গলবার প্রকাশিত ঢাবির ‘বি’ ইউনিটে ফল। সেখানে পাসের হার ৯.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ পাস করতে পারেনি ৯১ ভাগ শিক্ষার্থী। শিক্ষার মান উদ্বেগজনক জানিয়ে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, সরকার মান নয়, পাসের দিকে ঝোঁকার কারণেই এ অবস্থা।
একই চিত্র ছিল ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাতেও। সে বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৫৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়। এর আগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৫ ভাগ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৫৩ ভাগ জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়।
২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৭৮.৩৩ ভাগ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। আর এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে ৯৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ৩১৩? অথচ ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইউনিটের প্রকাশ ফলাফলে পাসের হার গড়ে ১৭.১৮ শতাংশ। এর মধ্যে ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ। পরীক্ষা অংশগ্রহণ করার সবাই জিপিএ-৩.৫ থেকে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ ধারী। ২০১৩ সালে এইচএসসি ও সমমানের পাসের হার ছিল ৭৪.৩০ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। আর এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৮৯.৭২ শতাংশ। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির পাঁচটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২ লাখ ১৭ হাজার ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৪১ হাজার ৮৯১ জন। পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হন এক লাখ ৭৫ হাজার। পাসের হার ছিল ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে ‘চ’ ইউনিটে ৯৫ ভাগ, ‘গ’ ইউনিটের ৯১ ভাগ, ‘খ’ ইউনিটের ৮৬ ভাগ, ‘ঘ’ ইউনিটের ৯১ ভাগ এবং ‘এ’ ইউনিটে ৫৮ ভাগ শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৮৩ ভাগ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৮১ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করতে ব্যর্থ হন। ঢাবি কেন্দ্রীয় ভর্তি কেন্দ্রর তথ্যের অনুযায়ী, পাঁচটি ইউনিটে ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় পাস নম্বর ৪৮ (৪০% হিসাবে)। এর মধ্যে ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটে বাংলায় ৮ (পূর্ণ নম্বর ৩০), ইংরেজি ৮ (পূর্ণ নম্বর ৩০) ও সাধারণ জ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞানে ১৭ (পূর্ণ নম্বর ৬০) নম্বর করে পেলে তিন বিষয়ে পাস হিসেবে ধরা হয়। আর ‘গ’ ইউনিটে ইংরেজিতে পাস নম্বর ১২।
ভর্তির ফলে একই চিত্র দেখা গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ভতি পরীক্ষায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটের ৪৬ হাজার ৯শ’ ৮৯ জন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৯ হাজার ৭শ’ ৬৭ জন। পসের হার ১৬.২৪ শতাংশ। ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে মাত্র ৪.৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে তাতে ওই ইউনিটের আসন পূরণ করতে কোন সমস্যা হবে না। বেশি পাস দেখিয়ে পরীক্ষা ভর্তি হতে না পারলে শিক্ষার্থীদের মনে কষ্ট থাকে বলেও তিনি জানান।
শুধু ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হারেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্ধারিত নম্বর না পাওয়ায় অনেক বিভাগে আসনই পূর্ণ করতে পারছে না কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ইংরেজিতে নির্ধারিত নম্বর রয়েছে যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে ওইসব বিষয়ে আসন খালি থাকছে। সার্বিক ভর্তি ফলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মানে গুণগত কোন পরিবর্তন আসেনি এটি তারই প্রমাণ। পাস নয় শিক্ষার মানের দিকে তাকাতে সরকারকে পরামর্শ দেন এ শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ভাল ফল করেও এত বেশি সংখ্যক ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে না পারা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এর সমাধানে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এস এম ফায়েজ বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নম্বর দিয়ে সাহস দেয়া যায়। তবে নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার পক্ষে নই আমি। এতে শিক্ষার্থীরা সহজে ভাল নম্বর পাওয়ায় পরবর্তীতে পড়ালেখায় একটু ঢিলেমি দিয়ে দেয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে এমন বিপর্যয় হচ্ছে। কলা অনুষদের ডিন ও ‘খ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেন, পাঠ্যবই থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে প্রশ্ন করা হয়। তারপরও শিক্ষার্থীরা ভাল করতে পারে না। তিনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় খাতা যথাযথ মূল্যায়ন না করা, স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষকের অভাবের কারণে এ সমস্যাগুলো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সংখ্যক আসন রয়েছে। তাই এই পরীক্ষা নেয়া হয় বাদ দেয়ার জন্য। এখানে পাস ফেলে কোন সমস্যা না। এবার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাবিতে ‘খ’ ইউনিটে পাস করতে পারেনি এক শিক্ষার্থী। ফেল করার কারণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওই শিক্ষার্থী জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে যা পড়ানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তার ধারে-কাছেও নেই। তিনি বলেন, এইচএসসির পড়াশোনার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার কোন মিল নেই।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই, হ-য-ব-র-ল শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে পাসের দিকে বেশি নজর দেয়া, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না করিয়ে অপরিকল্পিত সৃজনশীল পদ্ধতি চালু, সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং-এর প্রভাব, শ্রেণীকক্ষে সঠিক পাঠদানের ঘাটতি, অনুপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পাস করার প্রবণতা তৈরি করে দেয়া, ক্লাসরুমে পাঠ্যবইয়ে মনোযোগ না দেয়ার কারণে উচ্চশিক্ষার ভর্তিযুদ্ধে শিক্ষার্থীরা হোঁচট খাচ্ছে। মঙ্গলবার রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনরা বলেন, জোর করে পাসের হার বাড়ানো হচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারছে না সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা মান বেড়েছে এমন দাবিতে অনড় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসএসসি-এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো হয় না কেন? এক ঘণ্টার এমসিকিউ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার সার্বিক মান যাচাই করা যায় না বলেও দাবি তার।
ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ভর্তিযোগ্য ২ জন
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে ভর্তির হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী। অথচ এই বিভাগে আসন সংখ্যা ১২৫টি। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে ইংরেজিতে ২০ নম্বর পাওয়ার পাশাপাশি ইলেক্টিভ ইংলিশে ১৫ নম্বর পেতে হয়। মঙ্গলবার প্রকাশ হওয়া ‘বি’ ইউনিটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে সমসংখ্যক নম্বর পেয়েছেন। ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৫টি অংশ ছিল। এগুলো হলো- সাধারণ ইংরেজি, বাংলা, ইলেক্টিভ ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান ‘এ’ ও সাধারণ জ্ঞান ‘বি’। শিক্ষার্থীদের ৫টির মধ্যে ৪টি অংশ নিজেদের যোগ্যতাসাপেক্ষে নির্বাচন করার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রত্যেক বিষয়ে মোট ২৫টি প্রশ্নে ৩০ নম্বর ছিল। ১ ঘণ্টায় মোট ১২০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। ভর্তি নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়, ইংরেজি বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় পাসসহ সাধারণ ইংরেজিতে ২০ নম্বর পেতে হবে। তবে ভর্তি পরীক্ষার তিন দিন আগে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর পরীক্ষায় উত্তরপত্রের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে ঢাবির কলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক সদরুল আমিন বলেন, ইংরেজি বিভাগে আসন সংখ্যা ১২৫টি। এ বছর এ বিভাগে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভর্তির যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি আমিও শুনেছি। শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পড়াশোনা না করায় এমনটা ঘটেছে। শিক্ষার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিষয়টা আমিও শুনেছি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে।
No comments