নিউইয়র্ক খনি বিপর্যয় by অনুবাদ : রাফিক হারিরি

হারুকি মুরাকামি : জাপানিজ ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার হারুকি মুরাকামি গত কয়েক বছর ধরেই নোবেল তালিকায় মনোনীতদের শীর্ষে ছিলেন। তবে নোবেল তার ভাগ্যে এলো না। খনি বিপর্যয় বা মাইন ডিজেস্টার গল্পটি হারুকি মুরাকামির সর্বশেষ গল্প গ্রন্থ ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গ্রন্থের। এই গ্রন্থের গল্পগুলো ১৯৮১ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে লেখা। ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিংপিং উইমেন গল্প গ্রন্থটি লিখে হারুকি মুরাকামি বলেন, উপন্যাস লেখা আমার কাছে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ। সেই তুলনায় গল্প খুব স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। কারণ উপন্যাস লেখা হল বিশাল একটা বন তৈরি করা আর গল্প হল ছোট্ট সৌখিন বাগান তৈরির মতো। জাপানিজ ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯ এ জাপানের কোয়েটায়। তার অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর, হিয়ার দ্য উইন্ড সঙ্গ, অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ উল্লেখযোগ্য।
তারা সবগুলো বাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে দিল পর্যাপ্ত বাতাস রক্ষা করার জন্য। তাদের চারপাশে অন্ধকার।
কেউ কথা বলছে না। তারা কেবল ছাদ থেকে প্রতি পাঁচ সেকেন্ড পর পর চুইয়ে চুইয়ে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ পাচ্ছে।
‘ঠিক আছে, সবাই একটু সাবধানে দম নেবেন আর ফেলবেন, যতটুকু সম্ভব শ্বাস কম নিয়ে বাতাস বাঁচানোর চেষ্টা করুন। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস নেই।’ একজন বুড়ো খনি শ্রমিক বলল।
সে খুব নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে কথা বলল, কিন্তু তারপরেও কথাগুলো ছাদের বিমে প্রতিশব্দ করে ফিরে এলো। অন্ধকারে খনি শ্রমিকেরা জড়াজড়া করে বসে আছে। সেখানে কেবল জীবনের প্রতিশব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা অপেক্ষা করছে।
ব্ইারে লোকজন গর্ত খুঁড়ে তাদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছে। পুরো বিষয়টা কেমন সিনেমার দৃশ্যপটের মতো মনে হচ্ছে।
আমার এক বন্ধুর স্বভাব হল ঝড়ের সময় চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়া। এ কাজটা সে গত দশ বছর ধরে করে আসছে। ঝড়ের সময় যখন লোকেরা তাদের দোকানের ঝাপ বন্ধ করায় ব্যস্ত থাকে, মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে, কেউ কেউ বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে আবার অন্যেরা তাদের রেডিও ঠিক আছে কিনা সেটা চেক করে, ঠিক সেই সময় আমার বন্ধু ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সংগ্রহ করা একটা সৈনিকদের জেকেট পরে পেন্টের পকেটে দুই কেন বিয়ার ভরে চিড়িয়াখানার উদ্দেশে বের হয়ে যায়। চিড়িয়াখানা তার বাসা থেকে মাত্র পনের মিনিট হাঁটা পথ।
তার ভাগ্য খারাপ হলে সে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে সেটা বন্ধ পায়। তখন তার কিছুই করার থাকে না। চিড়িয়াখানার মূল ফটকের সামনে তখন সে একটা পাথরের ওপর বসে তার বিয়ারটা খেয়ে বাসায় ফিরে আসে। আর যখন সে চিড়িয়াখানার দরজা খোলা পায় তখন টিকিট কেটে সিগারেট ধরায়, তারপর ভেতরে ঢুকে একটার পর একটা প্রাণী দেখতে থাকে। অধিকাংশ পশুই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের আশ্রয়ে চলে যায়, কতগুলো নিষ্পলক চোখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার কতগুলো অস্থির হয়ে খাঁচার ভেতর ঘোরাঘুরি করে।
আমার বন্ধু সব সময় বেঙ্গল টাইগারের খাঁচার সামনে গিয়ে তার বিয়ারের কেনটা খুলে খেতে থাকে। ঝড়ের সময় বেঙ্গল টাইগার সবচেয়ে বেশি হিংস ভাব দেখায়।
দ্বিতীয় বিয়ারের কেনটা সে গরিলার খাঁচার সামনে খুলে। টাইফুনের সময় গরিলা তেমন কোনো অস্থির ভাব দেখায় না। সে বেশ শান্ত থাকে।
টাইফুনের বিষয়টা ছাড়া আমার বন্ধুর সঙ্গে অন্য কারও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আমার বন্ধু একটা এক্সপোর্ট কোম্পানিতে কাজ করে। সে বৈদেশিক বিনিয়োগ বিভাগের দায়িত্বে আছে। সে একা একা খুব পরিষ্কার একটা ফ্ল্যাটে থাকে। প্রতি ছয় মাস পর পর সে নতুন করে তার বান্ধবী পাল্টায়। কেন সে ঠিক ছয় মাসের মাথায় বান্ধবী পাল্টায় সেই রহস্য আমার কাছে অজানা।
আমার বন্ধুর খুব সুন্দর একটা ব্যবহৃত গাড়ি আছে, তার সুট কালো, জুতা কালো, টাই কালো। সব কিছুই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য একদম ঠিক। আমি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের কোনো নিমন্ত্রণ পেলেই ওর কাছ থেকে এ গুলো ধার করতাম। ওর সুটটা অবশ্য আমার একটু বড় হতো।
‘দুঃখিত তোমাকে আবারও বিরক্ত করতে আসলাম। আরেকটা শেষকৃত্যের নিমন্ত্রণ আছে।’ শেষবারের মতো তাকে বলেছিলাম।
‘কাজটা তুমি নিজেই করে নাও। তোমাকে খুব তাড়াহুড়া দেখাচ্ছে। সঠিক সময় কেন আস না?’ উত্তরে সে বলল।
আমি যখন তার বাসায় আসলাম দেখলাম সব কিছু সে প্রস্তুত করে রেখেছে। ফ্রিজের ভেতর ঠাণ্ডা বিয়ার, সুট ইস্ত্রি করা, জুতা পলিশ করে চক চক করে রেখেছে। এই হল আমার বন্ধু।
‘এক দিন চিড়িয়াখানায় আমি একটা বিড়াল দেখলাম।’ একটা বিয়ার সে খুলতে খুলতে বলল।
‘বিড়াল?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, দুই সপ্তাহ আগে। ব্যবসায়িক কাজে আমাকে হুকাইডু যেতে হয়েছিল, সেখানে একটা হোটেলের পাশেই চিড়িয়াখানা ছিল। বেড়াল লেখা একটা খাঁচার ভেতর আমি একটা বেড়ালকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম।’
‘কি ধরনের বিড়াল ছিল এটা?’
‘খুব সাদামাটা। বাদামি রঙের ডোরা কাটা দাগ ওর শরীরে।’
যা হোক সেই বছরটা আমার জন্য ছিল শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের বছর। আমার বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু এরকম অনেকেই মারা গেল। একের পর এক মরতেই থাকল। আমার বয়স আটাশ, বন্ধুদেরও প্রায় একই, কারও বয়স সাতাশ, কেউ আটাশ, কেউ ছাব্বিশ। মরে যাওয়ার জন্য বয়সটা উপযুক্ত ছিল না।
বাস্তবতা এবং অতিবাস্তবতার মাঝে প্রথম একটা পার্থক্য তৈরি করল আমাদেরই এক বন্ধু। সে আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়েছে। জুনিয়র হাইস্কুলে ইংরেজি শিখেছে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় তার স্ত্রী সন্তান প্রসবের জন্য বাবার বাড়ি যায়। রোববারের একটা স্বাভাবিক গরম পরা দিনে সেই বন্ধু দোকানে গিয়ে দুই কেন সেভিং ক্রিম কেনে, একটা ছুরি কেনে। ছুরিটা দিয়ে অনায়াসে একটা হাতির কান কেটে ফেলা যাবে। বাড়িতে ঢুকে বাথটাবে শুয়ে সে তার হাতের কব্জি কেটে ফেলে। রক্ত ঝরেই সে মারা যায়। দুই দিন পর তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বিবৃতি দিয়েছে এটা নির্জলা আÍহত্যা।
সে কোনো নোট লিখে যায়নি। তার ঘরে টেবিলের ওপর একটা গ্লাস, খালি হুইস্কির বোতল, দুই কেন সেভিং ক্রিম।
এর পরের বারো মাসে আরও অনেকেই মারা গেল।
একজন মারা গেল সৌদি আরবে তেলক্ষেত্রে, দু’জন মারা গেল হার্ট অ্যাটাকে জুন মাসে, অন্য আরেকজন ট্রাফিক দুর্ঘটনায়, জুলাই থেকে নভেম্বরটা শান্তিতেই ছিল, কিন্তু ডিসেম্বরে আরেক বন্ধু গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেল।
আমার প্রথম বন্ধুর মতো বাকি বন্ধুরা টেরই পেল না যে তারা মরতে যাচ্ছে।
‘আমার বিছানাটা ঠিক করে দিবে?’ যেই বন্ধু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল সে মারা যাওয়ার আগে তার স্ত্রীকে বলেছিল। এই বন্ধুটা আসবাবপত্রের ডিজাইনার ছিল। তখন সকাল এগারোটা বাজে। সে নয়টার সময় ঘুম থেকে উঠে তার ঘরে কিছুক্ষণ কাজ করল। তারপর সে বলল, তার ঘুম ঘুম লাগছে। রান্নাঘরে গিয়ে সে কফি বানাল, কফি খেল। কফিতে তার তেমন কোনো উপকার হল না।
‘আমার মনে হয় একটু ঘুমাতে হবে। মাথার ভেতর কেমন বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে।’ এটা ছিল তার সর্বশেষ কথা। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু ঘুম থেকে আর জাগল না।
যে বন্ধুটা ডিসেম্বরে মারা গেল সে ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। একমাত্র মেয়ে বান্ধবী। তার বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ।
ক্রিসমাসের আগে শীতের এক বৃষ্টিঘন সন্ধ্যায় একটা বিয়ারের বিশাল ট্রাকওয়ালা বান্ধবীটাকে চেপ্টা বানিয়ে দিল।
সর্বশেষ মৃত সৎকারের অনুষ্ঠানের পর আমার বন্ধুর ফ্ল্যাটে তার সুট-কোট ফেরত দেয়ার জন্য আমি গেলাম। ধন্যবাদস্বরূপ তাকে এক বোতল হুইস্কি দিলাম।
‘তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আবারও আমাকে সাহায্য করেছ।’ তার ফ্রিজ তখনও যথারীতি ঠাণ্ডা বিয়ারে ভর্তি ছিল।
সে কাপড়টা নিয়ে যথাস্থানে রাখল। তার চালচলন খুব ধীরস্থির ছিল।
‘আশা করি কাপড়ের মধ্যে কোনো মৃত সৎকারের গন্ধ নেই।’ আমি বললাম।
‘কাপড়টা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল এর ভেতরে কি আছে।’ সে বলল।
‘হিম’। আমি বললাম।
‘একটার পর একটা সৎকারের অনুষ্ঠান হচ্ছেই। কতগুলো অনুষ্ঠানে গেলে এই বছর?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘পাঁচজন।’ আমি হাতের আঙুল খুলে বললাম।
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘যথেষ্ট মানুষ মারা গেছে এই বছর।’
‘মনে হচ্ছে এটা পিরামিডের কোনো অভিশাপ। আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম পিরামিডের অভিশাপ এমন, যখন এটা শুরু হয় তখন যথেষ্ট মানুষ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই অভিশাপ শেষ হয় না।’ আমার বন্ধু বলল।
আমরা ছয় নম্বর পেক খাওয়া শেষ করে হুইস্কির দিকে ঝুঁকলাম।
‘তোমাকে কিছুটা বিষণ্ন লাগছে আজ।’ বন্ধু বলল।
‘আসলেই তেমন দেখাচ্ছে?’
‘রাত হলে তুমি মনে হয় এসব বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা-ভাবনা কর। আমি রাতের বেলা এসব চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘তুমি কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর?’
‘আমি যখন খুব বিষণ্ন হয়ে পড়ি তখন বাড়িতে থেকে সব কিছু পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রাত যদি দুটো কিংবা তিনটা বাজে তাহলেও আমি এই কাজটা করি। ঘরের বাসন, থালা, রান্নাঘর সব কিছু পরিষ্কার করি। কাপড়গুলো আবার ধুয়ে ইস্ত্রি করি। তখন আমার আর কিছুই মনে থাকে না।’
আমি ঘরটার চারপাশে তাকালাম। ঘরটা সত্যিকার অর্থেই বেশ পরিচ্ছন্ন।
ফোন বেজে উঠল। আমার বন্ধু শোয়ার ঘরে ফোন ধরার জন্য উঠে গেল। তার মেয়ে বন্ধু ফোন করেছে। ফোনে সে কথা বলেই যাচ্ছে। আমি কিছু করার না পেয়ে টিভি ছেড়ে বসলাম। সাতাশ ইঞ্চির টিভি। চ্যানেল পাল্টানোর জন্য একটা রিমোট আছে। টিভির ছয়টা স্পিকারে বেশ ভালো শব্দ শোনা যায়। এ রকম দারুণ টিভি আমি সচরাচর দেখিনি।
বেশ কয়েকটা চ্যানেল আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু সংবাদ দেখতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধু ফিরে এলো।
‘দারুণ কোনো সংবাদ আছে না কি?’
‘নাহ তেমন কিছু নেই।’
‘তুমি কি প্রচুর টিভি দেখো?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম,‘আমার কোনো টিভি নেই।’
‘টিভিতে শুধু একটাই সুবিধা আছে। তুমি ইচ্ছে করলে যখন তখন এর মুখটা বন্ধ করে দিতে পারবে। টিভি তোমাকে কিছুই বলবে না। ’ আমার বন্ধুটি বলল।
আমার বন্ধু সুইচ অফ করে টিভিটা বন্ধ করে দিল। ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এলো। ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে। বাইরে যে সব বাড়িতে আলো জ্বালানো ছিল সেই আলোগুলো জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছে।
আমরা পাঁচ মিনিটের মতো চুপচাপ বসে থাকলাম। কেউ কোনো কথা বললাম না। হুইস্কি খেলাম। চুপচাপ বসে থেকে আমরা আরও নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। প্যারিসের একটা চিড়িয়াখানার বিষয় নিয়েও কথা বললাম। আমার বন্ধুর বাসার শ্যামপেনটা সত্যিই দারুণ ছিল।
নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে রুপুঙ্গির পানশালায় পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। পিয়ানো বাজছে, দারুণ সব খাবার আর পানীয় সাজিয়ে রাখা আছে। নতুন বছরের আগমনিতে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমার কিছু করার থাকে না। এ রকম অনুষ্ঠানে আমার কারও সঙ্গে কোনো কথা বলার কিংবা পরিচিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার সেটা ভালোও লাগে না। তাই আমি চুপচাপ নিজের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু নতুন বছরের সেই অনুষ্ঠানে কেউ একজন আমাকে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। অল্প কিছুক্ষণ স্বাভাবিক কথা বলে আমার মতো করে আমি এক কোনায় নিরিবিলি একটা জায়গায় চলে আসলাম। কিন্তু সেই মহিলাটা হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে আমাকে অনুসরণ করে আমার কাছে চলে এলো।
খুব বিনয়ের সঙ্গে আমার কাছে এসে বলল, ‘আমাকে আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে বলা হয়েছে।’ মেয়েটা সুন্দরী আর আকর্ষণীয়, দামি একটা পোশাক পরা সে, হাতের তিনটি আঙুলে তিন রকমের আঙটি। ঠোঁটে মৃদু একটা হাসি ঝুলে আছে।
‘আপনাকে আমার খুব পরিচিত লাগছে। আপনার মুখের আকৃতি, কথা বলার ঢং, কাঁধের বিস্মৃতি সব কিছুই আমার পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি এখানে আসার পর থেকেই আপনাকে লক্ষ্য করছিলাম।’ মেয়েটা বলল।
‘আপনি যার কথা বলছেন আমি যদি সত্যিই তার মতো হই তাহলে তার সঙ্গে আমার পরিচিত হওয়া দরকার।’ আমি বুঝতে পারছিলাম না এর চেয়ে ভালো কথা তখন আর কি বলা যেতে পারে।
‘আপনি সত্যিই তার সঙ্গে দেখা করতে চান?’ মেয়েটা বলল।
‘হ্যাঁ, আমি চাই। কারণ যে দেখতে হুবহু আমার মতো তার মুখোমুখি হওয়াটা আসলেই দারুণ একটা ব্যাপার হবে।’
‘কিন্তু আপনি তার সঙ্গে কোনোভাবেই দেখা করতে পারবেন না। এটা অসম্ভব।’
‘কেন?’
‘কারণ সে পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। এখন আপনার যে বয়স মারা যাওয়ার সময় তার বয়সও এমন ছিল।’
‘এটা কি আসলেই সত্যি?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, সত্যি। কারণ আমিই তাকে খুন করেছিলাম।’
পার্টি জমে উঠেছে। পিয়ানোর সুর পাল্টে অন্য আরেকটা সঙ্গীত অনুষ্ঠানের ভেতর চলছে।
‘আপনি কি গান পছন্দ করেন?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
‘যদি সেটা সুন্দর পৃথিবীতে হয় তাহলে সুন্দর গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।’
আমার কথা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর মুখে একটা সিগারেট ধরাল। আমি লাইটার জ্বালিয়ে দিলাম।
‘হুম, আমরা সেই লোকটার বিষয়ে কথা বলছিলাম যে দেখতে ঠিক আপনার মতো ছিল।’ মেয়েটা তার সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল।
‘আপনি কীভাবে তাকে খুন করেছিলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি তাকে একটা মৌচাকের বাসার ভেতর ছুড়ে মেরেছিলাম।’
‘আপনি আমার সঙ্গে মশকরা করছেন?’
‘হ্যাঁ।’ মেয়েটা বলল।
আমি বরফে মিশ্রিত আরেক পেগ হুইস্কি খেলাম।
‘অবশ্য আইনগতভাবে কিংবা নৈতিকভাবে আমি খুনি নই।’ মেয়েটা বলল।
‘আইনগতভাবে কিংবা নৈতিকভাবে না হলেও আপনি খুনি। কারণ আপনি কোনো একজনকে খুন করেছেন।’
‘হ্যাঁ, খুন করেছি। এমন একজনকে যে দেখতে আপনার মতো ছিল।’ মেয়েটা তার মাথা নেড়ে বলল।
হলঘরে একজন লোক চিৎকার করে হেসে উঠল। তার চারপাশে যারা ছিল তারাও হাসতে থাকল। গ্লাসগুলো কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটাও কেঁপে উঠল।
‘ওকে খুন করতে আমার মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সময় লেগেছিল।’ মেয়েটা বলল।
আমরা কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। মেয়েটাও কথা বলার জন্য সময় নিল।
‘আপনি কি কখনও স্বাধীনতার বিষয়ে চিন্তা করেছেন?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
‘কখনও কখনও ভেবেছি। কেন এমনটা জিজ্ঞেস করছেন?’
‘আপনি কি ডেজি ফুল আঁকতে পারবেন?’
‘মনে হয় পারব। এটা দিয়ে কি আপনি আমার ব্যক্তিত্ব যাচাই করছেন?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি কি পাস করেছি?’
‘হ্যাঁ, আপনি পাস করেছেন।’
ঘরের ভেতর আবারও সঙ্গীত বেজে উঠল।
‘আপনি প্রাণী পছন্দ করেন?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, আমি পছন্দ করি।’ আমার বন্ধুর কথা তখন মনে পড়ল যে কি-না চিড়িয়াখানার প্রাণী দেখতে পছন্দ করে।
‘আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।’ মেয়েটা বলল।
‘আপনিও ভালো থাকবেন।’ আমি বললাম।

No comments

Powered by Blogger.