এক দুই এবং তিন by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
আমার
ধারণা, গত কয়েক সপ্তাহে এ দেশের সব মানুষের বিশাল একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।
অন্যদের কথা জানি না, অনেক বিষয়ে আমার নিজেরই চোখ খুলে গেছে, যে বিষয়গুলো
আগে আলাদা করে চোখে পড়েনি, আজকাল তার অনেক কিছুই চোখে পড়তে শুরু করেছে। তবে
রাজনীতি এখনও আমার কাছে অনেক জটিল বিষয়, অনেক কিছুই কমন সেন্সে মেলে না।
তাই সবকিছু বুঝতে পারি না। তারপরও আমি এ জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়টিকে নিজের
মতো করে বুঝে নিয়েছি এবং এ মুহূর্তে আমি মাত্র তিনটি মাপকাঠি দিয়ে
বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিজের কাছে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কাছে
মাপকাঠিগুলো এ রকম :প্রথমটি অবশ্যই বাংলাদেশকে নিয়ে। আজকাল মাঝে মধ্যেই
আমার মনে হয় অনেকেই বুঝি বাংলাদেশের আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছেন। অনেকের
ধারণা, গাছে পেকে যাওয়ার পর আম যেভাবে টুপ করে নিচে এসে পড়ে, বাংলাদেশটাও
বুঝি সেভাবে তাদের হাতে এসে পড়েছে। তাই মানুষ যেভাবে আম খায় তারাও বুঝি
সেভাবে কেটে কেটে ঝাল-মরিচ দিয়ে কিংবা চটকে চটকে দুধ দিয়ে কিংবা চিপে চিপে
রস বের করে শুকিয়ে আমসত্ত্বা বানিয়ে খেতে পারবে। ব্যাপারটা মোটেও সে রকম
নয়। বাংলাদেশটা আমরা পেয়েছি রীতিমতো একটা যুদ্ধ করে আর সেটাও রাজায় রাজায়
যুদ্ধ ছিল না, সেটা ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এ দেশের মানুষ যেভাবে
প্রাণ দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই। তাই যারা প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে যুদ্ধ
করে এই দেশটা এনে দিয়েছে, তারা যে স্বপ্ন দেখেছিল, সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশ।
তাই এ দেশের রাজনীতি হোক, অর্থনীতি হোক, লেখাপড়া হোক, চাষাবাদ হোক,
গানবাজনা হোক, সুখ-দুঃখ হোক, মান-অভিমান হোক_ কোনো কিছুই মুক্তিযুদ্ধের
স্বপ্নের বাইরে হতে পারবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি
হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যারা এটিকে অস্বীকার করে তাদের এ দেশে রাজনীতি করা তো
দূরে থাকুক এ দেশের মাটিতে পা রাখারই অধিকার নেই।
অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বুকের ভেতরে এক ধরনের তীব্র আবেগ রয়েছে; কিন্তু কেউ যেন মনে না করে, এটা শুধু একটা অর্থহীন আবেগ। আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটুকুও রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধে। আজ থেকে প্রায় ৪২ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, তখন এই দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না। পাশের দেশ ভারত এখন সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার সাহস রাখে_ অমর্ত্য সেন সেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেছেন, আমরা অনেক দিক দিয়ে ভারত থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশের সাফল্যের রহস্যটি বোঝার জন্য রীতিমতো একাডেমিক গবেষণা করা হয় আর সেই গবেষণার ফলাফল আমাদের কাছে অবাক করা বিষয় নয়, আমরা সেটা বহুদিন থেকে জানি। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা আত্মবিশ্বাসী জাতির পরিচয়; অন্যটি হচ্ছে হাজার বছর থেকে ঘরের ভেতর আটকে রাখা মেয়েদের ঘরের বাইরে এসে সবার সঙ্গে কাজ করে দেওয়ার সুযোগ।
কেউ কি লক্ষ্য করেছে, জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের প্রধান এলার্জি ঠিক এই দুটি বিষয়ে? যে দুটি শক্তি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই, ঠিক সেই দুটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা আমাদের পেছনে ঠেলে দিতে চায়?
কেউ যেন মনে না করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, আদর্শ, চেতনা_ এই বিষয়গুলো শুধু এক ধরনের আবেগ এবং মোটামুটি একটি বিমূর্ত বিষয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুলো অনেক যত্ন করে তুলে ধরা হয়েছিল (কারও যদি কৌতূহল হয় তাহলে তারা বাহাত্তরের সংবিধানটি পড়ে দেখতে পারেন)। একটু একটু করে যখন সেই সংবিধানের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, প্রতিবার আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আবার একদিন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।
তাই যখন আমরা শুনতে পাই কেউ ঘোষণা করছে, বাহাত্তরের সংবিধানে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি, তখন আমি অবাক হয়ে যাই। না, মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হই না, আমি অবাক হই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা দেখে। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কখনও রাজনীতি করতে পারবে না। কেউ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, তাহলে বুঝতে হবে এই মানুষটির আর যে ক্ষমতাই থাকুক বাংলাদেশের মানুষকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে তার রাজনৈতিক দলের সম্পদ নয়, তার দলের বোঝা, তার দলের জঞ্জাল।
গত কয়েক সপ্তাহে আমি যেসব বিষয় জানতে পেরেছি তার একটি আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতি কিছু বিদেশি কূটনীতিকের অসম্মানজনক ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি একদিন বিদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে চলে এসেছিলাম। এখন আমার দেশেই সেই বিদেশি কূটনীতিকদের অপমান সহ্য করতে হয়। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে, তাদের একটা দল বিজয় দিবসে আমাদের স্মৃতিসৌধে যায়নি।
আমি যতদূর জানি, আমাদের বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের সাহায্যের ওপর সেভাবে নির্ভর করে না। এখনও এ দেশে নিশ্চয়ই অনেক টাকা-পয়সা আসে এবং সেগুলো আসে বিভিন্ন এনজিওর কাছে। আমি এ রকম একটা এনজিওর বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন সদস্য হিসেবে তাদের বড় কর্মকর্তার বেতন ঠিক করে দিয়েছিলাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর হিসেবে আমি তখন যত বেতন পাই, সেই বেতনটি ছিল তার চার থেকে পাঁচগুণ। কাজেই এনজিও কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই ভালো থাকেন এবং যে দেশ থেকে তাদের বেতন-ভাতা আসে, সে দেশের প্রতি তাদের নিশ্চয়ই এক ধরনের কৃতজ্ঞতা থাকে। সে দেশের এজেন্ডাগুলো নিশ্চয়ই সোজাসুজি কিংবা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়নের একটা চাপ থাকে। তাই তারা তাদের নির্ধারিত কাজ ছাড়াও বাড়তি কিছু করেন। এ দেশের মানুষকে ফ্রি উপদেশ দেন। সেটি সমস্যা নয়, আমরা সবাই উপদেশ দিতে পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দেশটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত, মানুষকে পুড়িয়ে মারার হোলি উৎসব চলছে, রেললাইন তুলে ফেলে ট্রেনকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, রাস্তা কেটে ফেলা হচ্ছে, পুলিশকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আমাদের এনজিও কর্মকর্তারা এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস বন্ধ করার কথা বললেন না, তারা সরকারকে নির্বাচন বন্ধ করার উপদেশ দিলেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এ দেশে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চলছিল, তাই প্রকারান্তরে তারা সন্ত্রাসেরই পক্ষ নিলেন।
এ ব্যাপারটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি জানি, আমাদের দেশের এনজিওগুলো অসাধারণ কাজ করে। আমি তাদের অনেকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য। তারা মাঝে মধ্যে আমাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। আমার কাছে যখন সেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমি তখন লিখি। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, বিদেশিদের টাকা দিয়ে চলছে এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেটে ফেলার সময় হয়েছে, আমার শ্রমটুকু হয়তো দেওয়া উচিত দীনহীন দুর্বল প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবকদের, যারা নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তারা যতই দুর্বল হোক তারা আমার দেশের প্রতিষ্ঠান। যারা আমার দেশকে অপমান করে তাদের কাছ থেকে তারা কোনো টাকা নেয় না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই এক ধরনের গৌরব আছে।
এই দেশের রাজনীতিতে আমার চাওয়া খুবই কম। যে দলটি দেশ চালাবে সে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাসী। একই সঙ্গে যে দলটি বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেটিও হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। শুধু এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের সব মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। সরকার পরিবর্তন হলেও কারও মনে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা থাকবে না। একটি ভিন্ন দল দেশকে চালানোর দায়িত্ব পাবে, কিন্তু দেশটুকু অগ্রসর হবে একই গতিতে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে না তার এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। দ্বিতীয় মাপকাঠিটি নিয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষজনের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার। গত কয়েকদিন এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আঘাত নেমে এসেছে তার চেয়ে লজ্জা এবং অপমানের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি, তাই এ দেশে আমার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আছে। আমার তো একটি হিন্দু পরিবারেও জন্ম হতে পারত। আমি কোথায় জন্ম নেব সেখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই। একটি শিশু ঘটনাক্রমে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে বলে তার জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না_ আমরা কেমন করে সেটি ঘটতে দিলাম? খবরের কাগজে যখন একজন ভীত মায়ের কোলে একজন শিশুর অসহায় মুখটি দেখি, তখন আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হয়, এর জন্য নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আমরাই দায়ী।
যারা এটি করে তাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে আমার জানা নেই। এর মাঝে শুধু যে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আছে তা নয়। একটা হিন্দু পরিবারকে কোনোভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করতে পারলে তার জায়গাটা দখল করে নেওয়ার সুযোগ আছে। সেই ব্যাপারটিতে শুধু জামায়াত-বিএনপি আছে তা নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যে নেতাদের সঙ্গে তাদের ছবি ছাপা হয়। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দেওয়া না হয় কিংবা যতক্ষণ পর্যন্ত এ রকম ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করা না হয়, এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষরা আমাদের ক্ষমা করবে না। শুধু পুলিশ-র্যাব দিয়ে বাড়ি পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করার পরিকল্পনা করা যথেষ্ট নয়_ আসলে সেই এলাকার মানুষজনকেও দায়িত্ব নিতে হবে। একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন এগুলো করত, এখন সেটি আর ঘটতে দেখি না। এখন আমরা ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটতে দিই, তারপর সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় শহরে একটা মানববন্ধন, সেমিনার করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলি।
আমাদের আরও এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ কী ভাবছে সেটা বোঝার জন্য তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হতো। এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো হওয়ার কারণে কাজটা সহজ হয়েছে। কে কী ভাবছে সেটা নেটওয়ার্কে তাদের কথাবার্তা-মন্তব্য দেখে বোঝা যায়। আমরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছি, আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষিত-মার্জিত রুচিশীল অনেক মানুষের ভেতরটাও আসলে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ভাবনা দিয়ে অন্ধকার হয়ে আছে। আমার ১৯৭১ সালের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একটা অসহায় হিন্দু পরিবার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছে, আমার মা তাদের একটু অর্থ সাহায্য করার চেষ্টা করলেন। আমরা যে পরিবারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি তাদের একজন আমার মাকে বলল, 'বিধর্মী' মানুষকে সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হবে না। যদি সাহায্য করতেই চান, তাহলে একজন বিপদগ্রস্ত মুসলমানকে সাহায্য করেন!' শুনে শুধু আমার মা নয় আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম!
সেই ৪২ বছর আগের এ দেশের কিছু কিছু মানুষের চিন্তাভাবনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়তো নিজে নিজে কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হয়। এ দেশে যেন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বাড়তে না থাকে, সে জন্য আমাদের হয়তো দীর্ঘ সময়ের একটা পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুলের বাচ্চাদের জীবনটা শুরু করতে হবে সব ধর্মের জন্য ভালোবাসার কথা শুনে। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিদের হয়তো বলতে হবে মানুষের কথা, মানুষে মানুষে যে কোনো ভেদাভেদ নেই, সেই সত্যটির কথা। টেলিভিশনে নাটক লিখতে হবে, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষ নিজে অসাম্প্রদায়িক হলেই চলবে না, দায়িত্ব নিতে হবে তার আশপাশে যারা আছে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতার সৌন্দর্যটুকু বোঝানোর।
তাই আমি এখন অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দেওয়া_ যেন তারাও এই দেশটিকে তাদের নিজের দেশ বলে ভাবতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ না হলে ক্ষতি নেই, পদ্মা সেতু না হলেও ক্ষতি নেই, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ না হলেও ক্ষতি নেই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ না হলেও ক্ষতি নেই, যদি এই সরকার (কিংবা অন্য যে কোনো সরকার) এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বী সব মানুষকে একটি নিশ্চিন্ত-নির্ভাবনার দেশ উপকার দিতে পারে।
আমার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশ্বাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গীকারের পর তৃতীয় মাপকাঠিটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম নৈতিকতা। যে মানুষটি রাজনীতি করবে তাকে সৎ হতে হবে এবং এর মাঝে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এবারে নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকাগুলো তাদের নিজেদের দেওয়া হিসাবগুলোই হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছিল আর সেটা নিয়ে শুধু সারাদেশ নয়, সামাজিক নেটওয়ার্কের কল্যাণে সারা পৃথিবীতেই বিশাল একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যারা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা প্রথমে তথ্যগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তারপর নানাভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সাধারণ মানুষ বুঝতে ভুল করে না। সবচেয়ে বড় কথা যাদের সবাই সৎ মানুষ বলে জানে, তাদের সম্পদ তো হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি_ তাদের তো কিছু ব্যাখ্যাও করতে হয়নি। তাই আসলে কী ঘটেছে সবাই বুঝে গেছে।
কিছুদিন আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও নির্বাচিত হতে পারেননি। এটাকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফর্মুলা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও সত্যি কথাটি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ তাদের ভোট দেয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ এ রকম ব্যাপারগুলোতে সরকার যথেষ্ট ভালো কাজ করলেও কেন তাদের কেউ ভোট দিল না সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল। আমার কোনো গোপন সূত্র নেই কিন্তু পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটিভাবে বোঝা গেছে সাধারণ মানুষ তাদের আশপাশে যেসব ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দেখেছে, দৈনন্দিন জীবনে তাদের কারণে যেসব হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছে, দুর্নীতি-চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে, সেগুলো তাদের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। একশ'টা পদ্মা সেতু, এক হাজারটা হলমার্ক কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করত, একটি বিশ্বজিৎ হত্যা তার থেকে বেশি ক্ষতি করেছে।
দুর্নীতি কিংবা অসততার কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা রাজনীতি করে তাদের সৎ হতেই হবে। এটি নতুন পৃথিবী, কোনো কিছুই আর গোপন থাকে না, কে দুর্নীতিবাজ, কে সন্ত্রাসী, কে গডফাদার_ সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে যায়। কাজেই আমাদের আগামী বাংলাদেশে আমরা আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা দেখতে চাই না।
২. আমি কী চাই সেটা আমি নিজেকে বলতে পারি, যারা আমার পরিচিত তাদের বলতে পারি, যারা আমার কথা শুনতে চায়, তাদের জোর করে শোনাতে পারি; কিন্তু যাদের কাছে আমরা সেটা চাই, সেই রাজনীতিবিদরা কি আমাদের সেটা দেবেন? তারা কি আমাদের চাওয়া-পাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেন?
দেওয়ার কথা নয়। ভুল হোক শুদ্ধ হোক তাদের অনেক আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পেঁৗছেছে। আমরা দিলি্লর নির্বাচনে দেখেছি আম আদমি পার্টি নামে একটা তরুণদের রাজনৈতিক দল সব হিসাব ওলটপালট করে ক্ষমতায় চলে এসেছে। যেহেতু বাংলাদেশে বিশাল একটা তরুণের দল আছে, অনেক হিসেবে তারা ভারতবর্ষের তরুণদের থেকে বেশি রাজনীতিসচেতন, তাই তারা চাইলেও কি এ দেশের রাজনীতির জগতেও একটা ওলটপালট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে না?
আমাদের এত কষ্টের, এত ভালোবাসার দেশকে আমরা যেভাবে চাই যদি সেভাবে গড়ে তোলা না হয়, তাহলে কি এ দেশেও নতুন একটা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে না? যার চালিকা হবে নতুন প্রজন্ম? আগামী এক-দুই-পাঁচ বছর না হোক, তারপরও কি হতে পারে না? তাদের তো হারানোর কিছু নেই, দেওয়ার অনেক কিছু আছে।
লেখক; অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট
অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বুকের ভেতরে এক ধরনের তীব্র আবেগ রয়েছে; কিন্তু কেউ যেন মনে না করে, এটা শুধু একটা অর্থহীন আবেগ। আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটুকুও রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধে। আজ থেকে প্রায় ৪২ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, তখন এই দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না। পাশের দেশ ভারত এখন সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার সাহস রাখে_ অমর্ত্য সেন সেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেছেন, আমরা অনেক দিক দিয়ে ভারত থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশের সাফল্যের রহস্যটি বোঝার জন্য রীতিমতো একাডেমিক গবেষণা করা হয় আর সেই গবেষণার ফলাফল আমাদের কাছে অবাক করা বিষয় নয়, আমরা সেটা বহুদিন থেকে জানি। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা আত্মবিশ্বাসী জাতির পরিচয়; অন্যটি হচ্ছে হাজার বছর থেকে ঘরের ভেতর আটকে রাখা মেয়েদের ঘরের বাইরে এসে সবার সঙ্গে কাজ করে দেওয়ার সুযোগ।
কেউ কি লক্ষ্য করেছে, জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের প্রধান এলার্জি ঠিক এই দুটি বিষয়ে? যে দুটি শক্তি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই, ঠিক সেই দুটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা আমাদের পেছনে ঠেলে দিতে চায়?
কেউ যেন মনে না করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, আদর্শ, চেতনা_ এই বিষয়গুলো শুধু এক ধরনের আবেগ এবং মোটামুটি একটি বিমূর্ত বিষয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুলো অনেক যত্ন করে তুলে ধরা হয়েছিল (কারও যদি কৌতূহল হয় তাহলে তারা বাহাত্তরের সংবিধানটি পড়ে দেখতে পারেন)। একটু একটু করে যখন সেই সংবিধানের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, প্রতিবার আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আবার একদিন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।
তাই যখন আমরা শুনতে পাই কেউ ঘোষণা করছে, বাহাত্তরের সংবিধানে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি, তখন আমি অবাক হয়ে যাই। না, মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হই না, আমি অবাক হই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা দেখে। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কখনও রাজনীতি করতে পারবে না। কেউ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, তাহলে বুঝতে হবে এই মানুষটির আর যে ক্ষমতাই থাকুক বাংলাদেশের মানুষকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে তার রাজনৈতিক দলের সম্পদ নয়, তার দলের বোঝা, তার দলের জঞ্জাল।
গত কয়েক সপ্তাহে আমি যেসব বিষয় জানতে পেরেছি তার একটি আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতি কিছু বিদেশি কূটনীতিকের অসম্মানজনক ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি একদিন বিদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে চলে এসেছিলাম। এখন আমার দেশেই সেই বিদেশি কূটনীতিকদের অপমান সহ্য করতে হয়। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে, তাদের একটা দল বিজয় দিবসে আমাদের স্মৃতিসৌধে যায়নি।
আমি যতদূর জানি, আমাদের বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের সাহায্যের ওপর সেভাবে নির্ভর করে না। এখনও এ দেশে নিশ্চয়ই অনেক টাকা-পয়সা আসে এবং সেগুলো আসে বিভিন্ন এনজিওর কাছে। আমি এ রকম একটা এনজিওর বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন সদস্য হিসেবে তাদের বড় কর্মকর্তার বেতন ঠিক করে দিয়েছিলাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর হিসেবে আমি তখন যত বেতন পাই, সেই বেতনটি ছিল তার চার থেকে পাঁচগুণ। কাজেই এনজিও কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই ভালো থাকেন এবং যে দেশ থেকে তাদের বেতন-ভাতা আসে, সে দেশের প্রতি তাদের নিশ্চয়ই এক ধরনের কৃতজ্ঞতা থাকে। সে দেশের এজেন্ডাগুলো নিশ্চয়ই সোজাসুজি কিংবা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়নের একটা চাপ থাকে। তাই তারা তাদের নির্ধারিত কাজ ছাড়াও বাড়তি কিছু করেন। এ দেশের মানুষকে ফ্রি উপদেশ দেন। সেটি সমস্যা নয়, আমরা সবাই উপদেশ দিতে পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দেশটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত, মানুষকে পুড়িয়ে মারার হোলি উৎসব চলছে, রেললাইন তুলে ফেলে ট্রেনকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, রাস্তা কেটে ফেলা হচ্ছে, পুলিশকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আমাদের এনজিও কর্মকর্তারা এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস বন্ধ করার কথা বললেন না, তারা সরকারকে নির্বাচন বন্ধ করার উপদেশ দিলেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এ দেশে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চলছিল, তাই প্রকারান্তরে তারা সন্ত্রাসেরই পক্ষ নিলেন।
এ ব্যাপারটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি জানি, আমাদের দেশের এনজিওগুলো অসাধারণ কাজ করে। আমি তাদের অনেকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য। তারা মাঝে মধ্যে আমাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। আমার কাছে যখন সেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমি তখন লিখি। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, বিদেশিদের টাকা দিয়ে চলছে এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেটে ফেলার সময় হয়েছে, আমার শ্রমটুকু হয়তো দেওয়া উচিত দীনহীন দুর্বল প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবকদের, যারা নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তারা যতই দুর্বল হোক তারা আমার দেশের প্রতিষ্ঠান। যারা আমার দেশকে অপমান করে তাদের কাছ থেকে তারা কোনো টাকা নেয় না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই এক ধরনের গৌরব আছে।
এই দেশের রাজনীতিতে আমার চাওয়া খুবই কম। যে দলটি দেশ চালাবে সে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাসী। একই সঙ্গে যে দলটি বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেটিও হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। শুধু এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের সব মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। সরকার পরিবর্তন হলেও কারও মনে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা থাকবে না। একটি ভিন্ন দল দেশকে চালানোর দায়িত্ব পাবে, কিন্তু দেশটুকু অগ্রসর হবে একই গতিতে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে না তার এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। দ্বিতীয় মাপকাঠিটি নিয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষজনের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার। গত কয়েকদিন এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আঘাত নেমে এসেছে তার চেয়ে লজ্জা এবং অপমানের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি, তাই এ দেশে আমার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আছে। আমার তো একটি হিন্দু পরিবারেও জন্ম হতে পারত। আমি কোথায় জন্ম নেব সেখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই। একটি শিশু ঘটনাক্রমে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে বলে তার জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না_ আমরা কেমন করে সেটি ঘটতে দিলাম? খবরের কাগজে যখন একজন ভীত মায়ের কোলে একজন শিশুর অসহায় মুখটি দেখি, তখন আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হয়, এর জন্য নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আমরাই দায়ী।
যারা এটি করে তাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে আমার জানা নেই। এর মাঝে শুধু যে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আছে তা নয়। একটা হিন্দু পরিবারকে কোনোভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করতে পারলে তার জায়গাটা দখল করে নেওয়ার সুযোগ আছে। সেই ব্যাপারটিতে শুধু জামায়াত-বিএনপি আছে তা নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যে নেতাদের সঙ্গে তাদের ছবি ছাপা হয়। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দেওয়া না হয় কিংবা যতক্ষণ পর্যন্ত এ রকম ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করা না হয়, এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষরা আমাদের ক্ষমা করবে না। শুধু পুলিশ-র্যাব দিয়ে বাড়ি পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করার পরিকল্পনা করা যথেষ্ট নয়_ আসলে সেই এলাকার মানুষজনকেও দায়িত্ব নিতে হবে। একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন এগুলো করত, এখন সেটি আর ঘটতে দেখি না। এখন আমরা ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটতে দিই, তারপর সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় শহরে একটা মানববন্ধন, সেমিনার করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলি।
আমাদের আরও এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ কী ভাবছে সেটা বোঝার জন্য তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হতো। এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো হওয়ার কারণে কাজটা সহজ হয়েছে। কে কী ভাবছে সেটা নেটওয়ার্কে তাদের কথাবার্তা-মন্তব্য দেখে বোঝা যায়। আমরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছি, আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষিত-মার্জিত রুচিশীল অনেক মানুষের ভেতরটাও আসলে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ভাবনা দিয়ে অন্ধকার হয়ে আছে। আমার ১৯৭১ সালের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একটা অসহায় হিন্দু পরিবার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছে, আমার মা তাদের একটু অর্থ সাহায্য করার চেষ্টা করলেন। আমরা যে পরিবারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি তাদের একজন আমার মাকে বলল, 'বিধর্মী' মানুষকে সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হবে না। যদি সাহায্য করতেই চান, তাহলে একজন বিপদগ্রস্ত মুসলমানকে সাহায্য করেন!' শুনে শুধু আমার মা নয় আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম!
সেই ৪২ বছর আগের এ দেশের কিছু কিছু মানুষের চিন্তাভাবনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়তো নিজে নিজে কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হয়। এ দেশে যেন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বাড়তে না থাকে, সে জন্য আমাদের হয়তো দীর্ঘ সময়ের একটা পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুলের বাচ্চাদের জীবনটা শুরু করতে হবে সব ধর্মের জন্য ভালোবাসার কথা শুনে। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিদের হয়তো বলতে হবে মানুষের কথা, মানুষে মানুষে যে কোনো ভেদাভেদ নেই, সেই সত্যটির কথা। টেলিভিশনে নাটক লিখতে হবে, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষ নিজে অসাম্প্রদায়িক হলেই চলবে না, দায়িত্ব নিতে হবে তার আশপাশে যারা আছে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতার সৌন্দর্যটুকু বোঝানোর।
তাই আমি এখন অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দেওয়া_ যেন তারাও এই দেশটিকে তাদের নিজের দেশ বলে ভাবতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ না হলে ক্ষতি নেই, পদ্মা সেতু না হলেও ক্ষতি নেই, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ না হলেও ক্ষতি নেই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ না হলেও ক্ষতি নেই, যদি এই সরকার (কিংবা অন্য যে কোনো সরকার) এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বী সব মানুষকে একটি নিশ্চিন্ত-নির্ভাবনার দেশ উপকার দিতে পারে।
আমার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশ্বাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গীকারের পর তৃতীয় মাপকাঠিটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম নৈতিকতা। যে মানুষটি রাজনীতি করবে তাকে সৎ হতে হবে এবং এর মাঝে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এবারে নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকাগুলো তাদের নিজেদের দেওয়া হিসাবগুলোই হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছিল আর সেটা নিয়ে শুধু সারাদেশ নয়, সামাজিক নেটওয়ার্কের কল্যাণে সারা পৃথিবীতেই বিশাল একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যারা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা প্রথমে তথ্যগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তারপর নানাভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সাধারণ মানুষ বুঝতে ভুল করে না। সবচেয়ে বড় কথা যাদের সবাই সৎ মানুষ বলে জানে, তাদের সম্পদ তো হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি_ তাদের তো কিছু ব্যাখ্যাও করতে হয়নি। তাই আসলে কী ঘটেছে সবাই বুঝে গেছে।
কিছুদিন আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও নির্বাচিত হতে পারেননি। এটাকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফর্মুলা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও সত্যি কথাটি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ তাদের ভোট দেয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ এ রকম ব্যাপারগুলোতে সরকার যথেষ্ট ভালো কাজ করলেও কেন তাদের কেউ ভোট দিল না সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল। আমার কোনো গোপন সূত্র নেই কিন্তু পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটিভাবে বোঝা গেছে সাধারণ মানুষ তাদের আশপাশে যেসব ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দেখেছে, দৈনন্দিন জীবনে তাদের কারণে যেসব হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছে, দুর্নীতি-চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে, সেগুলো তাদের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। একশ'টা পদ্মা সেতু, এক হাজারটা হলমার্ক কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করত, একটি বিশ্বজিৎ হত্যা তার থেকে বেশি ক্ষতি করেছে।
দুর্নীতি কিংবা অসততার কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা রাজনীতি করে তাদের সৎ হতেই হবে। এটি নতুন পৃথিবী, কোনো কিছুই আর গোপন থাকে না, কে দুর্নীতিবাজ, কে সন্ত্রাসী, কে গডফাদার_ সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে যায়। কাজেই আমাদের আগামী বাংলাদেশে আমরা আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা দেখতে চাই না।
২. আমি কী চাই সেটা আমি নিজেকে বলতে পারি, যারা আমার পরিচিত তাদের বলতে পারি, যারা আমার কথা শুনতে চায়, তাদের জোর করে শোনাতে পারি; কিন্তু যাদের কাছে আমরা সেটা চাই, সেই রাজনীতিবিদরা কি আমাদের সেটা দেবেন? তারা কি আমাদের চাওয়া-পাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেন?
দেওয়ার কথা নয়। ভুল হোক শুদ্ধ হোক তাদের অনেক আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পেঁৗছেছে। আমরা দিলি্লর নির্বাচনে দেখেছি আম আদমি পার্টি নামে একটা তরুণদের রাজনৈতিক দল সব হিসাব ওলটপালট করে ক্ষমতায় চলে এসেছে। যেহেতু বাংলাদেশে বিশাল একটা তরুণের দল আছে, অনেক হিসেবে তারা ভারতবর্ষের তরুণদের থেকে বেশি রাজনীতিসচেতন, তাই তারা চাইলেও কি এ দেশের রাজনীতির জগতেও একটা ওলটপালট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে না?
আমাদের এত কষ্টের, এত ভালোবাসার দেশকে আমরা যেভাবে চাই যদি সেভাবে গড়ে তোলা না হয়, তাহলে কি এ দেশেও নতুন একটা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে না? যার চালিকা হবে নতুন প্রজন্ম? আগামী এক-দুই-পাঁচ বছর না হোক, তারপরও কি হতে পারে না? তাদের তো হারানোর কিছু নেই, দেওয়ার অনেক কিছু আছে।
লেখক; অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট
No comments