নতুন সরকার- সামনে এখন সুশাসনের চ্যালেঞ্জ by ইফতেখারুজ্জামান
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রয়াণের আগের দুই সপ্তাহের মধ্যে পর পর দুটি অনুষ্ঠানে তাঁর পাশে থাকার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল। এর একটি ছিল ইতিহাসের মহিরুহ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার স্মরণে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান, যেখানে হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ম্যান্ডেলার জীবনাদর্শ থেকে কিছুই শেখেননি।
যুক্তি হিসেবে যে বিষয়ের ওপর তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা হলো ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবাসের পর বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা হিসেবে জনরায়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাঁচ বছরের এক মেয়াদ পালনের পর তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ জনসমর্থন নিশ্চিত জেনেও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও সম-অধিকারের মূলমন্ত্রের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কেমন করে প্রতিপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে জাতি গঠনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ম্যান্ডেলা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমাপের নেতা, বিশ্বব্যাপী রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক।
ম্যান্ডেলার আদর্শের চর্চা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিপূর্ণ প্রতিফলিত হবে—এমন আশা করা মূর্খের কাজ হবে। একদিকে ক্ষমতায় আরোহণ নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলনের নামে নির্মম রক্তক্ষয়ী সহিংসতা ও অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকার জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধূলিসাৎ করে জনরায়ের পথ রুদ্ধ করার যে অধ্যায় রচিত হলো, তা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য আত্মঘাতী। নৈতিকতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক রাজনীতি এ দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য চরম হতাশাব্যঞ্জক, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধানের মর্ম ও চেতনার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে ভোটার অংশগ্রহণের মাপকাঠির পাশাপাশি যেসব কারণে এই নির্বাচনের ফলে গঠিত সংসদ ও সরকার নিশ্চিতভাবে আস্থাহীনতার সংকটের মুখোমুখি, তার মধ্যে অন্যতম জনগণের ম্যান্ডেটের অনুপস্থিতি। এ নির্বাচন ছিল নিতান্তই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, এখানে নির্বাচনী ইশতেহার কোনো ভূমিকা পালন করেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিকতার ইশতেহার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল, জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবার নির্বাচনী ইশতেহার ব্যবহূত হয়নি। অর্থাৎ সরকারের নিজস্ব অবস্থান অনুযায়ী সরকার জনরায়ের সংকটে, যা কাটিয়ে উঠে জনগণের আস্থা অর্জন যত দিন তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিনের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ সঙ্গে থাকবে।
আস্থা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অংশগ্রহণমূলক একাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে আলোচনার পথ সুগম করা। নির্বাচনের আগে থেকে বলা হয়েছিল যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করা হবে, যদিও শপথ গ্রহণের পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়ে দিচ্ছেন যে সরকার পুরো পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে।
ম্যান্ডেটবিহীন সরকারের আস্থা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় এজেন্ডার কথা বলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ দমন, আইনের শাসন, সুশাসন, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি দেশবাসীর প্রাণের দাবি। আশার কথা, আগের আমলে যেসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মসহ গগনচুম্বী সম্পদাহরণের অভিযোগ ছিল, তাঁদের অনেককেই নতুন মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন যে তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তিনি কাউকে ছাড় দেবেন না। তবে সরকারের বি-টিমের ভূমিকায় লিপ্ত দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান বাস্তবে জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থানে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে, এরূপ আস্থা জনমনে নেই বললেই চলে।
সদিচ্ছা থাকলে অবশ্য সরকার দু-একটি পদক্ষেপ অনতিবিলম্বে নিতে পারে। নবম সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষ মুহূর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধনী বিল পাস করে দুদককে সম্পূর্ণ অকার্যকর করার আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যা একদিকে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী ও অন্যদিকে অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক। দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই আইনটির যথাযথ সংশোধন করে দুদককে কার্যকর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি সরকার নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, মহাজোট সরকারের পুরো মেয়াদে সংঘটিত দুর্নীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তার পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে দুর্নীতির অপরাধে দায়ী ব্যক্তিদের কোনো প্রকার ভয় ও করুণার ঊর্ধ্বে থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে দুর্নীতিবিরোধী সব ঘোষণা ফাঁকা বুলি হিসেবে আরও একবার প্রমাণিত হবে।
একদিকে পুরোনো-নতুনের সংমিশ্রণ ও অন্যদিকে তথাকথিত বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির এক অভিনব ও বিভ্রান্তিকর মন্ত্রিসভা আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে—এরূপ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতির মূল উপাদান যে দুর্নীতি, ক্ষমতায় থাকলে পর্বতসম সম্পদ অর্জনের সুযোগকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে, রাষ্ট্রক্ষমতা যেভাবে দুর্নীতি-সহায়ক শক্তির করায়ত্ত হতে চলেছে, দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করার মানসিকতা যেভাবে রাজনৈতিক চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
আর এই চ্যালঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কতটুকু অনমনীয় থাকতে পারবে, তার এক তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশেষ দূত নিয়োগের মাধ্যমে। নির্বাচনে তাঁর দলের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে মঞ্চায়িত সিরিজ নাটকে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা যে দর-কষাকষির অন্যতম উপাদান ছিল, তা গোপন কিছু নয়। বিশেষ দূত হিসেবে তাঁর ভূমিকা যা-ই হোক না কেন, আইনের শাসন আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত অবস্থান যে মূলত দলীয় রাজনৈতিক এজেন্ডার হাতিয়ার, এই নিয়োগ তারই দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন সুশাসনের অঙ্গীকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি দলের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি প্রতীকী অনশনের আরেক নাটক মঞ্চস্থ করে আট মামলার এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে আটকাবস্থা থেকে সগৌরবে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছেন। জানামতে, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি, হলেও তা কতটুকু কার্যকর হবে, তাও বোধ হয় সবারই জানা।
সুশাসনের পথে আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে দশম সংসদকে কেন্দ্র করে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর মূলত বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের কারণে সংসদ তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। নবম সংসদের মোট কার্যকালের প্রায় ৯০ শতাংশ তৎকালীন বিরোধী দল বর্জন করে রেকর্ড স্থাপন করে। নেতিবাচক রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের তুলনায় খারাপ রেকর্ড করার প্রতিযোগিতা এমনই আত্মঘাতী যে এবারের সংসদকে রূপান্তরিত করা হয়েছে কার্যত বিরোধী দলহীন একচ্ছত্র ভুবনে। নির্বাচনী বৈধতার মুখোশ হিসেবে মঞ্চায়িত জাপা নাটকের শেষ দেখতে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে, এবারের সংসদে থাকবে সরকারের আজ্ঞাবহ একধরনের ক্যাঙারু বিরোধী দল; থাকবে না কোনো অর্থবহ সংসদীয় কমিটি; থাকবে না কোনো কার্যকর সংসদীয় বিতর্ক, থাকবে না বাস্তব অর্থে কোনো গঠনমূলক সমালোচনা। বিরোধীদলীয় অবস্থান বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের জন্যই অগ্রহণযোগ্য; জাতীয় পার্টির জন্য তো বটেই। তবে নামে বিরোধী দল হয়েও মন্ত্রিত্বের জন্য যে আকুতি-মিনতি, আবার যেভাবে তার প্রশ্রয়, তা অভূতপূর্ব।
একদিকে ম্যান্ডেটহীন সরকার, অন্যদিকে সরকারের আজ্ঞাবহ সংসদ—এরূপ অবস্থায় আইনের শাসন যে আকাশকুসুম নয়, তা প্রমাণ করা হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আইনের রক্ষক হয়ে উঠতে পারে ভক্ষক। নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হতে পারে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার-বাণিজ্য আর জামিন-বাণিজ্যের সহজ শিকার। রয়েছে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ক্রসফায়ারের ঘটনা বৃদ্ধির ঝুঁকি। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে বাক্স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার বৃহত্তর ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।
বিপরীতমুখী দুই পক্ষের ঊর্ধ্বে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার অবস্থানকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা বৃদ্ধি পেতে পারে। সমালোচনামাত্রই বিবেচিত হতে পারে শত্রুতা হিসেবে। বার্তাবাহককে স্তব্ধ করার ঝুঁকি প্রকটতর হতে পারে কপটাচারীদের স্তাবকতার কারণে। এরূপ সম্ভাবনা ভুল প্রমাণ করতে চাই সমালোচনা সইবার ও ভুলত্রুটি সংশোধনের সৎ সাহস, যা হতে পারে জনগণের আস্থা অর্জনের অন্যতম চাবিকাঠি।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
No comments