প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ও অঙ্গীকারে দৃঢ় একজন মানুষ
মুহাম্মদ
হাবিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখি ছাত্রজীবনে। তখনও আমি কলেজের ছাত্র।
থাকতাম আজিমপুরের সরকারি কর্মচারীদের একটি এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেই
আমাদের চলাফেরা ছিল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রসংসদের নির্বাচন ছিল
একটি উৎসবের মতো। আমরা তার চাঞ্চল্যটা অনুভব করতাম। ওই ছাত্র সংসদেরই এক
নির্বাচনে হাবিবুর রহমান সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই উপলক্ষেই তাকে
আমার প্রথম দেখা। প্রথা ছিল যে মেধাবী ছাত্ররাই নির্বাচনে দাঁড়াবে,
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো তাদের মধ্য। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী
ছাত্র ছিলেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী প্রয়াত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অনেক দিক দিয়েই বিশিষ্ট ছিলেন।
তার কর্মক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত, আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু তার সব
কাজের মধ্যেই দৃঢ়তা ও অভিনিবেশের প্রকাশ ঘটত। কোনো কাজই তিনি অমনোযোগের
সঙ্গে করতেন না, যদিও সব কাজই করতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তিনি যে ‘যথাশব্দ’ নামে
একটি গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন তাতে তার দৃষ্টিভঙ্গির একটা প্রকাশ আমরা দেখতে
পাই। ভাষার ব্যবহারে তিনি ছিলেন যথাযথ এবং তার সব কাজের মধ্যেই সুশৃংখলা ও
যথার্থতা দেখা যেত। সহজভাবে লিখতেন এবং কথা বলতেন কিন্তু তার লেখা এবং
কথায় দীপ্তি থাকত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের। জেনেশুনেই লিখেছেন এবং বলেছেন।
তার লেখার জন্য মানুষ প্রতীক্ষা করত। প্রত্যেক বছরই তার একাধিক বই বেরুত এবং সে বইয়ের জন্য পাঠকদের আগ্রহ থাকত। তিনি সভা, সমিতি ও সম্মেলনে খুব যে যেতেন তা নয়। কিন্তু যখনই যেতেন তখন আমরা দেখতাম তার বক্তব্যে কেবল যে মৌলিকতা আছে তা নয়, গভীরতাও রয়েছে। তার অনেক বক্তব্যই মানুষকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করত, এমনকি চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করত।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখি ছাত্রজীবনে। তখনও আমি কলেজের ছাত্র। থাকতাম আজিমপুরের সরকারি কর্মচারীদের একটি এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেই আমাদের চলাফেরা ছিল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রসংসদের নির্বাচন ছিল একটি উৎসবের মতো। আমরা তার চাঞ্চল্যটা অনুভব করতাম। ওই ছাত্র সংসদেরই এক নির্বাচনে হাবিবুর রহমান সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই উপলক্ষেই তাকে আমার প্রথম দেখা। প্রথা ছিল যে মেধাবী ছাত্ররাই নির্বাচনে দাঁড়াবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো তাদের মধ্য। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তিনি প্রত্যক্ষ যুক্ত ছিলেন। বাহান্ন সালে একুশে ফেব্র“য়ারিতে যে ঘটনা ঘটে তা ঐতিহাসিক। তার তাৎপর্য তখন এতটা বোঝা যায়নি যতটা পরে স্পষ্ট হয়েছে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। ছাত্ররা ঠিক করেছিল তা ভঙ্গ করবে। সে বছর আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে সমাবেশ হয় সেখানে আমাদের অন্য অনেক সহপাঠীর সঙ্গে আমিও ছিলাম। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে এবং ১০ জন ১০ জন করে গেট দিয়ে বের হয়ে যাবে। প্রথম যে ১০ জন বের হয় তার নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
ওই যে ছাত্র সংসদের সহসভাপতি হলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সামনে ছিলেন, এ দুটো ঘটনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বোঝা যায়, ছাত্র জীবনে তিনি মানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভালো ছাত্ররা কেউ কেউ রাজনীতিবিমুখ হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তেমনটি ছিলেন না। ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হিসেবে এমএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে পুলিশের ছাড়পত্র প্রয়োজন হতো। পুলিশ দেখত নিয়োগ প্রার্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে তারা রিপোর্ট দিয়েছিল। তা না হলে নিয়োগের পরপরই তিনি চাকরি হারাবেন কেন। চাকরি হারিয়ে তিনি যে হতাশ হওয়ার পাত্র ছিলেন না সেটা বোঝা গেল যখন তিনি ওই সলিমুল্লাহ হলেরই প্রবেশদ্বারে পান-সিগারেট বিক্রেতা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটা ট্রের মধ্যে সিগারেট ও পান সাজিয়ে সেটি গলায় ঝুলিয়ে হকার হিসেবে অন্তত একদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রের গায়ে লেখা ছিল- ‘শেলী ইজ ওউন স্টল’। তার ডাক নাম ছিল শেলী এবং হাবিবুর রহমান শেলী নামে তখন তিনি পরিচিত ছিলেন।
ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তখনকার দিনে প্রধান সংবাদপত্র ছিল পাকিস্তান অবজারভার। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বন্ধুরা ওই পত্রিকায় তার হকার হওয়ার ঘটনায় একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তার পরের দিন ভারতীয় একটি দৈনিকে প্রতিবেদনটি উদ্ধৃত করে বলা হয়, পূর্ববাংলার বেকার সমস্যা এমনই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, এমএতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ছাত্র সেখানে পান-সিগারেট বিক্রি করছে। এতে সরকার কতটা বিব্রত হয়েছিল আমরা জানি না কিন্তু হাবিবুর রহমান জগন্নাথ কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন।
তার ওই নাটকীয় প্রতিবাদে অতিনাটকীয়তা ছিল এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু মৌলিকত্ব অবশ্যই ছিল, সেই সঙ্গে ছিল একটি প্রসন্ন কৌতুকবোধ। এক তরুণ যুবকের দুঃসাহসও এ কাজের মধ্য দেখতে পাই। এ গুণগুলো মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মধ্যে আমরা সব সময় দেখতে পেয়েছি। তার চিন্তায় যেমন গভীরতা থাকত, তেমনি থাকত মৌলিকত্ব। সেই সঙ্গে প্রকাশ পেত একটি প্রসন্ন কৌতুকবোধও।
ছাত্রজীবনে তিনি আইনও পড়েছেন। তার পিতা আইনজীবী ছিলেন সেই উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ডে যান। সেখানে আধুনিক ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে লিংকনস ইন-এ তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রিও নিয়েছেন। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা খুশি হতাম যদি তিনি অধ্যাপনায় থাকতেন। কিন্তু সেখানে না থেকে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। এই নতুন পেশা তার জন্য একটা বড় কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। কিন্তু বেশি দিন তিনি আইনজীবী থাকেননি, অল্প সময় পরেই হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি হিসেবে সমধিক পরিচিত হন। তার অনেক রায়ের মধ্যেই বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যেত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের পরেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। সময়টা ছিল সমস্যাসংকুল। তিন মাসের সেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনেও তিনি যে দক্ষতার প্রমাণ দেন, তা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে। তার সব কাজেই প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ, জ্ঞান ছিল গভীর, অভাব ছিল না অভিনিবেশের। দেখা যেত তিনি অধ্যয়নে কখনও বিরতি দেননি। তার রচনাতে আমরা গবেষণামনস্কতারও প্রমাণ পাই। তিনি ইতিহাসের ওপর বই লিখেছেন ‘গঙ্গায় হৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নামে। বোঝা যায়, ইতিহাস পাঠে তার আগ্রহ তাকে কখনোই পরিত্যাগ করেনি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও তিনি গবেষণা করেছেন। ‘রবীন্দ্ররচনায় রবীন্দ্র ব্যাখ্যা’, ‘মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘রবীন্দ্র বাক্যে আর্ট সঙ্গীত ও সাহিত্য’ নামে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বই লিখেছেন। তিনি কোরআন পাঠ করেছেন গভীর মনোযোগে এবং তার একটি স্বচ্ছন্দ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। ‘কোরআন সূত্রকোষ’ নামেও তার একটি গ্রন্থ রয়েছে।
নিজের জ্ঞানকে তিনি সর্বদাই অতি সহজে বহন করেছেন। এর প্রকাশ ছিল সহজ স্বচ্ছন্দ ও প্রসন্ন। যত্নের সঙ্গে লিখেছেন কিন্তু যত্নের কৃত্রিমতা প্রকাশ ভঙ্গিতে প্রশ্রয় পায়নি। পাঠক আকর্ষণ করার একটা স্বাভাবিক শক্তি তার রচনার মধ্যে ছিল। আলাপচারিতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। কথাবার্তায় একটা কৌতুকবোধের প্রকাশ দেখা যেত। তার শরীরের হার ভাঙলে স্টিল দিয়ে জোড়া দিতে হয়েছিল। এ নিয়েও তিনি কৌতুক করতেন, বলতেন আমি একজন স্টিলম্যান।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উঁচুমাপের মানুষ ছিলেন। দৈহিক উচ্চতার কারণে ভিড়ের মধ্যে তাকে চোখে পড়ত। ওই উচ্চতা ছিল তার মেধাতেও। মেধাকে তিনি বিকশিত করেছেন অনুশীলনের দ্বারা। তার মধ্যে কোনো আলস্য ছিল বলে মনে হয় না। কাজকর্মেও বিরতি দেননি। সব কিছু ছিল আড়ম্ভরহীন। অঙ্গীকার ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সেই অঙ্গীকার একদিকে যেমন জ্ঞানের প্রতি, তেমনি সমাজ পরিবর্তনের দিকেও। সেই সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারেও তার অঙ্গীকার আমরা দেখেছি। ছাত্রজীবনে যেমন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, পরবর্তীতে প্রধানত পেশাগত কারণে সেটি থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু কখনোই রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। তার জীবনযাপন ছিল স্বাভাবিক। মৃত্যুর মধ্যেও সেই স্বাভাবিকতাটাই আমরা দেখলাম। খুব সহজেই চলে গেলেন। যেন দিনের কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আবারও উঠবেন। আক্ষরিক অর্থে জেগে উঠবেন না নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনি জেগে থাকবেন তার লেখা, কাজ ও দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্যে।
তার লেখার জন্য মানুষ প্রতীক্ষা করত। প্রত্যেক বছরই তার একাধিক বই বেরুত এবং সে বইয়ের জন্য পাঠকদের আগ্রহ থাকত। তিনি সভা, সমিতি ও সম্মেলনে খুব যে যেতেন তা নয়। কিন্তু যখনই যেতেন তখন আমরা দেখতাম তার বক্তব্যে কেবল যে মৌলিকতা আছে তা নয়, গভীরতাও রয়েছে। তার অনেক বক্তব্যই মানুষকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করত, এমনকি চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করত।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখি ছাত্রজীবনে। তখনও আমি কলেজের ছাত্র। থাকতাম আজিমপুরের সরকারি কর্মচারীদের একটি এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেই আমাদের চলাফেরা ছিল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রসংসদের নির্বাচন ছিল একটি উৎসবের মতো। আমরা তার চাঞ্চল্যটা অনুভব করতাম। ওই ছাত্র সংসদেরই এক নির্বাচনে হাবিবুর রহমান সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই উপলক্ষেই তাকে আমার প্রথম দেখা। প্রথা ছিল যে মেধাবী ছাত্ররাই নির্বাচনে দাঁড়াবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো তাদের মধ্য। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তিনি প্রত্যক্ষ যুক্ত ছিলেন। বাহান্ন সালে একুশে ফেব্র“য়ারিতে যে ঘটনা ঘটে তা ঐতিহাসিক। তার তাৎপর্য তখন এতটা বোঝা যায়নি যতটা পরে স্পষ্ট হয়েছে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। ছাত্ররা ঠিক করেছিল তা ভঙ্গ করবে। সে বছর আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে সমাবেশ হয় সেখানে আমাদের অন্য অনেক সহপাঠীর সঙ্গে আমিও ছিলাম। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে এবং ১০ জন ১০ জন করে গেট দিয়ে বের হয়ে যাবে। প্রথম যে ১০ জন বের হয় তার নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
ওই যে ছাত্র সংসদের সহসভাপতি হলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সামনে ছিলেন, এ দুটো ঘটনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বোঝা যায়, ছাত্র জীবনে তিনি মানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভালো ছাত্ররা কেউ কেউ রাজনীতিবিমুখ হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তেমনটি ছিলেন না। ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হিসেবে এমএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে পুলিশের ছাড়পত্র প্রয়োজন হতো। পুলিশ দেখত নিয়োগ প্রার্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে তারা রিপোর্ট দিয়েছিল। তা না হলে নিয়োগের পরপরই তিনি চাকরি হারাবেন কেন। চাকরি হারিয়ে তিনি যে হতাশ হওয়ার পাত্র ছিলেন না সেটা বোঝা গেল যখন তিনি ওই সলিমুল্লাহ হলেরই প্রবেশদ্বারে পান-সিগারেট বিক্রেতা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটা ট্রের মধ্যে সিগারেট ও পান সাজিয়ে সেটি গলায় ঝুলিয়ে হকার হিসেবে অন্তত একদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রের গায়ে লেখা ছিল- ‘শেলী ইজ ওউন স্টল’। তার ডাক নাম ছিল শেলী এবং হাবিবুর রহমান শেলী নামে তখন তিনি পরিচিত ছিলেন।
ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তখনকার দিনে প্রধান সংবাদপত্র ছিল পাকিস্তান অবজারভার। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বন্ধুরা ওই পত্রিকায় তার হকার হওয়ার ঘটনায় একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তার পরের দিন ভারতীয় একটি দৈনিকে প্রতিবেদনটি উদ্ধৃত করে বলা হয়, পূর্ববাংলার বেকার সমস্যা এমনই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, এমএতে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ছাত্র সেখানে পান-সিগারেট বিক্রি করছে। এতে সরকার কতটা বিব্রত হয়েছিল আমরা জানি না কিন্তু হাবিবুর রহমান জগন্নাথ কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন।
তার ওই নাটকীয় প্রতিবাদে অতিনাটকীয়তা ছিল এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু মৌলিকত্ব অবশ্যই ছিল, সেই সঙ্গে ছিল একটি প্রসন্ন কৌতুকবোধ। এক তরুণ যুবকের দুঃসাহসও এ কাজের মধ্য দেখতে পাই। এ গুণগুলো মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মধ্যে আমরা সব সময় দেখতে পেয়েছি। তার চিন্তায় যেমন গভীরতা থাকত, তেমনি থাকত মৌলিকত্ব। সেই সঙ্গে প্রকাশ পেত একটি প্রসন্ন কৌতুকবোধও।
ছাত্রজীবনে তিনি আইনও পড়েছেন। তার পিতা আইনজীবী ছিলেন সেই উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ডে যান। সেখানে আধুনিক ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে লিংকনস ইন-এ তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রিও নিয়েছেন। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা খুশি হতাম যদি তিনি অধ্যাপনায় থাকতেন। কিন্তু সেখানে না থেকে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। এই নতুন পেশা তার জন্য একটা বড় কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। কিন্তু বেশি দিন তিনি আইনজীবী থাকেননি, অল্প সময় পরেই হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি হিসেবে সমধিক পরিচিত হন। তার অনেক রায়ের মধ্যেই বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যেত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের পরেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। সময়টা ছিল সমস্যাসংকুল। তিন মাসের সেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনেও তিনি যে দক্ষতার প্রমাণ দেন, তা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে। তার সব কাজেই প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ, জ্ঞান ছিল গভীর, অভাব ছিল না অভিনিবেশের। দেখা যেত তিনি অধ্যয়নে কখনও বিরতি দেননি। তার রচনাতে আমরা গবেষণামনস্কতারও প্রমাণ পাই। তিনি ইতিহাসের ওপর বই লিখেছেন ‘গঙ্গায় হৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নামে। বোঝা যায়, ইতিহাস পাঠে তার আগ্রহ তাকে কখনোই পরিত্যাগ করেনি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও তিনি গবেষণা করেছেন। ‘রবীন্দ্ররচনায় রবীন্দ্র ব্যাখ্যা’, ‘মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘রবীন্দ্র বাক্যে আর্ট সঙ্গীত ও সাহিত্য’ নামে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বই লিখেছেন। তিনি কোরআন পাঠ করেছেন গভীর মনোযোগে এবং তার একটি স্বচ্ছন্দ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। ‘কোরআন সূত্রকোষ’ নামেও তার একটি গ্রন্থ রয়েছে।
নিজের জ্ঞানকে তিনি সর্বদাই অতি সহজে বহন করেছেন। এর প্রকাশ ছিল সহজ স্বচ্ছন্দ ও প্রসন্ন। যত্নের সঙ্গে লিখেছেন কিন্তু যত্নের কৃত্রিমতা প্রকাশ ভঙ্গিতে প্রশ্রয় পায়নি। পাঠক আকর্ষণ করার একটা স্বাভাবিক শক্তি তার রচনার মধ্যে ছিল। আলাপচারিতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। কথাবার্তায় একটা কৌতুকবোধের প্রকাশ দেখা যেত। তার শরীরের হার ভাঙলে স্টিল দিয়ে জোড়া দিতে হয়েছিল। এ নিয়েও তিনি কৌতুক করতেন, বলতেন আমি একজন স্টিলম্যান।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উঁচুমাপের মানুষ ছিলেন। দৈহিক উচ্চতার কারণে ভিড়ের মধ্যে তাকে চোখে পড়ত। ওই উচ্চতা ছিল তার মেধাতেও। মেধাকে তিনি বিকশিত করেছেন অনুশীলনের দ্বারা। তার মধ্যে কোনো আলস্য ছিল বলে মনে হয় না। কাজকর্মেও বিরতি দেননি। সব কিছু ছিল আড়ম্ভরহীন। অঙ্গীকার ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সেই অঙ্গীকার একদিকে যেমন জ্ঞানের প্রতি, তেমনি সমাজ পরিবর্তনের দিকেও। সেই সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারেও তার অঙ্গীকার আমরা দেখেছি। ছাত্রজীবনে যেমন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, পরবর্তীতে প্রধানত পেশাগত কারণে সেটি থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু কখনোই রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। তার জীবনযাপন ছিল স্বাভাবিক। মৃত্যুর মধ্যেও সেই স্বাভাবিকতাটাই আমরা দেখলাম। খুব সহজেই চলে গেলেন। যেন দিনের কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আবারও উঠবেন। আক্ষরিক অর্থে জেগে উঠবেন না নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনি জেগে থাকবেন তার লেখা, কাজ ও দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্যে।
No comments