চাপে জেরবার জীবন, স্বস্তি আসবে কবে?
বিগত সরকারের সময়ে বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে যে লুটপাট করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমন কিছু থাকবে না বলেও মানুষ মনে করছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছেই এখনো জিম্মি বাজার।
চাল, ডাল, চিনিসহ প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বছরজুড়েই ভুগিয়েছে ক্রেতাদের। নতুন সরকার আসার পর এসব পণ্যের দামে খুব একটা হেরফের হয়নি। দাম কমাতে সরকারের তরফে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। কমানো হয় কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক। শুল্ক কমালেও এসব পণ্যের আমদানি বাড়েনি। কমেনি দামও।
সোমবার বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। দাম বাড়ানোর পরেই বাজারে স্বাভাবিক হতে শুরু করে সয়াবিনের সরবরাহ। সমানতালে মিলছে নতুন ও পুরাতন বোতলজাত তেল। এত দ্রুত কীভাবে স্বাভাবিক হলো- তা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই ক্রেতাদের। তাদের মতে, পণ্য আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করতে পারলেও ক্রেতারা পড়ছেন বিপদে।
ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন অবশ্য বলেছেন, বাস্তবতা মেনে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর আগে বাজার থেকে তেল উধাও হওয়া এবং পরে তা ফিরে আসার বিষয়ে আসলে কারও কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা মিলেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের উপদেষ্টাদের কথার মধ্যেও কোনো আশার ইঙ্গিত পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় হতাশ তারা।
রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন আকিল উদ্দিন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। জীবনযাত্রা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুই বছর ধরে একই বেতন পাচ্ছি। কিন্তু এই সময়ে খরচ বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ। এখন প্রয়োজনীয় অনেক কিছু বাদ দিয়ে চলতে হচ্ছে। ছয় মাস আগে বাসা বদল করেছি ভাড়া কমানোর জন্য। নিত্যপণ্যের দামের কারণে পরিবারের সবার সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মো. ফুরকান কচু ক্ষেতের একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। তিনি বলেন, বেতনের সঙ্গে খরচের হিসাব মিলছে না। যে হারে বেতন বাড়ছে তার চেয়ে দ্বিগুণ খরচ বাড়ছে। এতে জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজে এখন একটি মেসে থেকে চাকরি করেন।
বুধবার সরকারি ক্রয় কমিটির বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারে আলুর দাম বাড়লেও, অন্য জিনিস সাশ্রয়ী হয়েছে। দাম বাড়ার বিষয়টি সবাই বলে, কিন্তু দাম কমারটা বলে না। বাজারে প্রত্যেকটার দাম কমানো সম্ভব না। বাজার এমন একটা জিনিস একটার দাম কমবে, একটার দাম বাড়বে। সরকার তাড়াতাড়ি প্রসেস করে, যৌক্তিক যে জিনিসগুলো ক্রয় করা প্রয়োজন সেগুলো অনুমোদন দিচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, ইচ্ছাকৃত সংকট তৈরি করে ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা প্রথমে সংকট তৈরি করলো। এরপর বাণিজ্য উপদেষ্টার উপস্থিতিতে দাম বাড়ানো হলো। স্বাভাবিক হলো বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজার। ক্রেতাদের জিম্মি করে এ ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি বলে দেয় বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন দরের পাশাপাশি মিলছে পুরনো দামের তেলও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেট যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। ডিলারদের দাবি, দাম বাড়ার পর বাড়ছে সরবরাহ।
সরকার যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তার প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাব যে একেবারে নাই তা নয়। আপনারা খালি দেখেন আলুর দাম বেড়ে গেছে, অন্যগুলোতো সাশ্রয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের প্রভাব পড়ছে এখন। তবে, সব পণ্যের দাম একসঙ্গে কমানো সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো সরবরাহ ও ঘাটতির বিপরীতে যে জোগান দরকার, সেটা ঠিক রাখা। যে কারণে সম্প্র্রতি আমরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছি। তবে সেটা সাধারণ ক্রেতার জন্য কষ্টসাধ্য হলেও বাস্তবতার জন্য দরকার ছিল। এটা না করলে বাজারে ব্যাপক সংকট তৈরি হতো, ঘাটতি বেড়ে যেতো। এখন আমরা অন্য কোনো পণ্যের দাম কমিয়ে সেটা সমন্বয়ের চিন্তা করছি। শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, এখনো বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে কথা হচ্ছে। তেল-চিনির সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তারা বাজারের একটা বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। পালিয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহে ঘাটতি হয়েছে।
বাজারে পণ্যের ঘাটতি পুরনো সরকার আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কমানো হয়েছিল শুল্ক ও কর। তবে আমদানি খুব একটা বাড়েনি। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেয়া ও শুল্ককর কমানোর কারণে বাজার স্থিতিশীল আছে। নতুন করে কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে না। তবে দাম কমছে না কেন এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারও কাছ থেকে। সরকার শুল্ককর তুলে নিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন চাল।
সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ই অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯শে নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে ৫ শতাংশে। তাতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর ১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। কিন্তু দাম কমেনি। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসে এক লাখ টন ভোজ্য তেল এসেছে। সাধারণত দেশে মাসে দুই লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। একইভাবে আলু, পিয়াজের আমদানি শুল্ক কমালেও দাম কমেনি।
No comments