পোশাক খাতে অস্থিরতা থামছেই না

রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধে সরকার ও মালিকপক্ষ থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও অস্থিরতা থামছেই না। মাসের পর মাস চেষ্টার পরও কেন থামানো যাচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান এই খাতে শ্রমিক অসন্তোষ? অনেকে বলছেন, পরিকল্পিতভাবে পোশাক শিল্পকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে শ্রমিকদের পাশাপাশি কিছু কারখানা মালিকও। বেশকিছু মালিক ব্যবসা করলেও শ্রমিকদের বেতন দিতে গড়িমসি করছেন। আবার ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাঝেও রয়েছে কোন্দল। ফলে অস্থিরতা লেগেই আছে।

সূত্র মতে সরকার পরিবর্তনের পর আগস্টের শেষ দিকে সাভার ও আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পে শুরু হয় শ্রমিক অসন্তোষ। এরপর দফায় দফায় বৈঠকে বসে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিসহ নানাপক্ষ। বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যাংক থেকেও দেয়া হয়েছে বিশেষ ঋণ সুবিধা। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেনে নেয়া হয়েছে শ্রমিকদের ১৮ দফা। তারপরও মেলেনি সুফল। বিজয়ের মাসেও শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পোশাক কারখানা।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল ইসলাম আমিন বলেন, কম মজুরি হওয়ায় শ্রমিকরা অতি কষ্টে জীবনযাপন করছেন। ফলে তাদের বেতন বাড়ানো দরকার।

পোশাক মালিকদের মতে, বিগত সরকারের সময়েও প্রায় ৪ হাজার কারখানার মধ্যে দুয়েকটি কারখানায় সবসময়ই সমস্যা ছিল, কিন্তু শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেনি। এখন সমস্যা সৃষ্টি করে বা সামান্য সমস্যা হলেই একটি পক্ষ শ্রমিকদের মহাসড়কে নিয়ে যায়। একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, বিগত সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়াদের একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যেকোনো একটি বা দুটি কারখানায় সমস্যা দেখা দিলেই শ্রমিকদের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে উদ্যোক্তাদের দাবি, অভ্যন্তরীণভাবেই মিটমাট সম্ভব এমন ঘটনাকেও বড় ইস্যু বানানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, চলমান শ্রমিক অসন্তোষের সঙ্গে শুধু শ্রমিকরা জড়িত নয়। এর পেছনে অনেক ইন্ধনদাতা আছে। শ্রমিক অসন্তোষের সঙ্গে বহিরাগতরা জড়িত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, পোশাক খাতে অধিকাংশ শ্রমিকই নিরীহ। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হাতে গোনা কিছু শ্রমিক। এদের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতিকারী, কিছু এনজিও’র লোক এই নিরীহ শ্রমিকদের অপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে শ্রমিকদের একটি পক্ষ পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করছে।

এদিকে সাধারণত পোশাক খাতে যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, পোশাক মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যে সমন্বয় থাকা জরুরি ছিল, তা নেই বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি কারখানার মালিক।

এদিকে সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের যৌক্তিক সমাধান করা হবে।

দুইদিনে ১৯ কারখানা বন্ধ ঘোষণা: ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় বৃহস্পতিবারও শ্রমিকেরা নানা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। সরকার ঘোষিত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি ৯ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে তারা বার্ষিক মজুরি ১৫ শতাংশ ও ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছেন। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বৃহস্পতিবার আরও ৮টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার বন্ধ করা হয় ১১টি কারখানা। দুইদিনে মোট ১৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।

সাভার থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান: আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতিতে আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ১৩ (১) ধারায় ৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং আরও ৮টিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া। এদিকে যেকোনো ধরনের সহিংসতা  রোধে পুরো যৌথবাহিনী সতর্ক অবস্থানের পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরিসহ প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাঁজোয়া যান ও জল কামান।

সূত্র মতে, বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- নাসা গ্রুপ, ট্রাউজার লাইন ও আল মুসলিম। সাধারণ ছুটিতে থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিউ এইজ গার্মেন্টস, নিউ এইজ অ্যাপারেলস, মেডলার অ্যাপারেলা এবং ব্যান্ডো ডিজাইন। এ ছাড়া, শ্রমিকরা কারখানায় এলেও কাজ না করে বেরিয়ে গেছে এমন কারখানার মধ্যে রয়েছে- নিট এশিয়া লিমিটেড, নেক্সট কালেকশন লিমিটেড, ডেকো ডিজাইন লিমিটেড, শারমিন ফ্যাশন, শারমিন অ্যাপারেলস, ইথিকাল গার্মেন্টস, আগামী ফ্যাশন, ক্রসওয়্যার, ফ্যাশন ফোরাম এবং মুন রেডিওয়্যার লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি কারখানা।

নিউ এইজ গ্রুপের একটি কারখানার নারী শ্রমিক বলেন, গত শনিবার থেকেই সমস্যা হচ্ছিল। আজ মুঠোফোনে বার্তা পেয়েছেন কারখানা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।

শিল্প পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে প্রবেশ করলেও অন্তত ২৫টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রেখে শ্রমিকরা শুরু করেন কর্মবিরতি। হাজিরা নিশ্চিত করে বিভিন্ন কারখানায় ১ থেকে ২ ঘণ্টা অবস্থান করে তারা বেরিয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে নিউ এইজের তিনটা কারখানা, বান্দু ডিজাইন, মেডলার  অ্যাপারেলস ও শারমিন গ্রুপের কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও চলমান অস্থিরতার কারণে নাসা গ্রুপের একাধিক কারখানাসহ ছয়টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি বেতনে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বাৎসরিক বেতন ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, প্রতি মাসে অর্জিত ছুটির টাকা পরিশোধ, ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে কর্মবিরতিসহ আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকরা।

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকরা ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলেও, কর্মবিরতি পালন ছাড়া কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পুলিশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.