ইসরায়েলের হামলা ও সিরিয়ান বিদ্রোহী জোটের নীরবতা

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর, ইসরায়েলি বাহিনী সিরিয়ার সামরিক ক্ষমতার ৮০ শতাংশ ধ্বংস করার দাবি করেছে। খবর টাইমস অব ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় সিরিয়ায় ৩৫০টি বিমান হামলা চালানো হয়েছে, পাশাপাশি সিরিয়ার নৌবাহিনীর স্থাপনাগুলোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে।

এই হামলায় সিরিয়ার অস্ত্রাগার, বিমান ঘাঁটি এবং নৌবহরের বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও, ইসরায়েলি সেনারা গোলান মালভূমি দিয়ে ২৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে।

হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘সিরিয়ায় সাবেক আসাদ সরকারের সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস করা জরুরি ছিল, যাতে সেগুলো জঙ্গিদের হাতে না পড়ে। আমরা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাই না, তবে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা করব।’

এদিকে, ইসরায়েলের এই হামলা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ইরান, ইরাক, সৌদি আরব এবং কাতার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

তবে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কোনো কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিদ্রোহী জোটের নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সিরিয়া আরেকটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় এবং সেটি শুরু হবে না।’ তার মতে, সিরিয়ার জনগণ দীর্ঘ বছরের সংঘর্ষে ক্লান্ত।

সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এই নেতার নীরবতার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামরিক এবং কৌশলগত কারণ বিদ্যমান।

১.বিদ্রোহীদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন

আসাদের পতনের পর, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গুরুতর বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি এখন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত। প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব লক্ষ্য এবং কৌশল নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে, এবং এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে, তারা একত্রে ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

২. প্রধান লক্ষ্য : আসাদ শাসন উচ্ছেদ

বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য ছিল আসাদ শাসন উৎখাত করা। তারা শুরু থেকেই একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে সংগ্রাম করছে – আসাদ সরকারকে উৎখাত করা এবং নিজেদের ক্ষমতায় আসা। ইসরায়েলের হামলা তাদের জন্য একটি পার্শ্বিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্রোহীরা জানে, তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আসাদ সরকারের পতন, এবং এ লক্ষ্যে তারা নিজেদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করছে। তাই ইসরায়েলের হামলা তাদের কাছে এখন কোনো বড় বিষয় নয়, বরং এটি তাদের মূল লক্ষ্য থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতে পারে।

৩. আন্তর্জাতিক সমর্থন ও কৌশল


বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কিছু অংশ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সমর্থন পেয়ে থাকে। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জানে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন হারানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তারা বুঝে যে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করলে তারা আন্তর্জাতিক স্তরে একচেটিয়া সমর্থন হারাতে পারে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই, বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের হামলায় সরাসরি প্রতিরোধ গড়তে যেতে চায় না।

৪. সামরিক সক্ষমতার অভাব

ইসরায়েল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক শক্তি, যা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের তুলনায় ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে উন্নত। বিদ্রোহীদের মূল সামরিক শক্তি সীমিত এবং তারা গৃহযুদ্ধে অভ্যস্ত। তাদের কাছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক প্রযুক্তি এবং বাহিনী নেই। এতে করে, ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করতে বিদ্রোহীরা সক্ষম নয়।

৫. ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থন

আসাদ সরকারের মিত্র হিসেবে ইরান এবং হিজবুল্লাহ রয়েছে, যারা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য অপ্রতিরোধ্য শত্রু। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জানে যে, ইসরায়েলের হামলা আসাদ সরকারের শত্রুদের ক্ষতি করতে পারে, যা পরোক্ষভাবে তাদের সুবিধা দেবে। তাই, তারা ইসরায়েলের হামলাকে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান হিসেবে দেখছে। বিদ্রোহীরা মনে করে, ইসরায়েল আসাদ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, যা তাদের জন্য পরোক্ষভাবে সহায়ক হতে পারে।

৬. জনমত ও সামরিক কৌশল

সিরিয়ার সাধারণ জনগণ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেখতে চায়, কিন্তু বিদ্রোহীরা তাদের সীমিত শক্তির কারণে এই ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে না। তারা জানে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করা তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে এবং তাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে। এ কারণে, বিদ্রোহীরা চুপ করে থাকে এবং তারা জানে যে, ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে কিছু না করলেই তাদের জন্য কম ঝুঁকি রয়েছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ইসরায়েলের হামলায় নীরব থাকার পেছনে একাধিক কৌশলগত, সামরিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তারা এখনো আসাদ সরকারের পতন এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্যস্ত এবং সে কারণেই ইসরায়েলের হামলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সামর্থ্য বা ঐক্য তাদের নেই।

তবে, এই নীরবতা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

ইসরায়েলের হামলায় সিরিয়ার অস্ত্রাগার, বিমান ঘাঁটি এবং নৌবহরের বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি : সংগৃহীত
ইসরায়েলের হামলায় সিরিয়ার অস্ত্রাগার, বিমান ঘাঁটি এবং নৌবহরের বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি : সংগৃহীত



No comments

Powered by Blogger.