কাশ্মীর: সর্বনাশের ঝুঁকি, তবুও বাকি বিশ্বের অনীহা by শাকিল আনোয়ার
ভারত শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর আড়াই মাস হতে চললো সেখানকার লাখ লাখ মানুষ কার্যত অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন।
জীবনযাপনের
ওপর নজিরবিহীন বিধিনিষেধ আর নিরাপত্তা নজরদারিতে ক্রোধে ফুঁসছে কাশ্মীর
উপত্যকা। একইসাথে ক্রুদ্ধ ভারতের পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী পাকিস্তান।
গতমাসে
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার ৫০ মিনিটের ভাষণে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
ইমরান খান বিশ্ব নেতাদের বলার চেষ্টা করেছেন কাশ্মীরে ভারতের সর্বশেষ
বিতর্কিত ভূমিকায় শুধু যে কাশ্মীরিরাই বিপর্যস্ত হচ্ছে তাই নয়, তা পুরো
বিশ্বকেই হুমকিতে ফেলেছে। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক যুদ্ধের
ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ইমরান খান যেটা বলার চেষ্টা করেছেন তা হলো -
কাশ্মীরে নিরাপত্তা বিধিনিষেধ একটু শিথিল হলেই ক্ষোভে ফেটে পড়বে
কাশ্মীরিরা। ভারত সবসময়কার মত পাকিস্তানকে দায়ী করবে, এবং তাতে দুই দেশের
সংঘর্ষ বেঁধে যাওয়া খুবই সম্ভব।
ইমরান খানের কথা ছিল এরকম- আয়তনে
সাত গুণ বড় একটি প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সামনে বিকল্প
যদি হয় - 'হয় আত্মসমর্পণ করো, না হয় লড়ো', তখন পাকিস্তানের সামনে
পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের পথ ছাড়া হয়তো আর কোনো উপায় থাকবে না।
ভারতের বাজার এবং পাকিস্তানের হতাশা
এত সাংঘাতিক হুঁশিয়ারি কেন উচ্চারণ করলেন ইমরান খান?
লন্ডনে
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রুসির গবেষক আদিত্য দেব
বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, পাকিস্তান গত কয়েক বছর ধরেই এই কৌশলই অনুসরণ
করছে।
"কাশ্মীর ইস্যুতে এই কথা বলেই তারা বিশ্বের নজর কাড়তে চাইছে।
কারণ ভারত যা করছে তার বিরুদ্ধে কার্যকরী কিছু করার বিকল্প তাদের খুব একটা
নেই। সুতরাং আমি মনে করি জাতিসংঘে ইমরান খান যা বলেছেন সেটা হতাশার
প্রকাশ।"
আদিত্য দেবের মতে কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না, সেই কারণেই ইমরান খনের এই হতাশা।
কিন্তু কেন কাশ্মীর নিয়ে, পাকিস্তানের উদ্বেগ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এতটা অনীহা?
আদিত্য দেব মনে করেন, কৌশলগত সহযোগী দেশ হিসাবে ভারতের গুরুত্ব বিশ্বে অনেকটাই বেড়ে গেছে।
"ভারতকে
অনেক দেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সহযোগী দেশ হিসাবে মনে করছে। অর্থনৈতিক
এবং সামরিক কৌশলগত-ভাবে তারা ভারতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে
যুক্তরাষ্ট্র। আপনি দেখবেন, এমনকী ওআইসি সংগঠন হিসাবে বিবৃতি দিলেও, ঐ
সংগঠনের অনেক সদস্য দেশ অন্যরকম কথা বলছে। সৌদি আরব সম্প্রতি ভারতে
বড়মাপের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।"
"আসলে বাণিজ্যিক সহযোগী হিসাবে ভারতের যে গুরুত্ব সেটা অন্যান্য গুরুত্ব এবং বিবেচনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।"
তবে
নিরাপত্তা পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তার ওপরে ভিত্তি করে সেই অবস্থান বদলে
যেতে পারে। এখন যে অবরোধ চলছে, সেটা প্রত্যাহার করে নিলে, যোগাযোগ
ব্যবস্থা শুরু হলে - কাশ্মীরের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটাই এখন সবচেয়ে
বড় চিন্তা।
কাশ্মীরে অনীহা এবং চীন ফ্যাক্টর
দক্ষিণ
এশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন কুয়ালালামপুরে মালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী। তিনি বলছেন, কাশ্মীর নিয়ে
পাকিস্তানের উদ্বেগ নিয়ে কেন আগের মত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা
মিত্ররা এখন মাথা ঘামাচ্ছে না, তার পেছনে মূল কারণ চীন।
"শক্তিধর
দেশগুলো এখন সবচেয়ে উৎকণ্ঠার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে চীনকে। চীনের
শক্তি বৃদ্ধিতে তাদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। তারা শঙ্কিত যে তাদের
এতদিনের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।"
মাহমুদ আলীর বক্তব্য এরকম - চীন বিশ্বব্যাপী এমন এক রাজনীতি এবং
অর্থনীতির কাঠামো তুলে ধরছে যেটা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য আকর্ষণীয়
একটি মডেল হিসাবে দাঁড়াচ্ছে। এতে করে, গত কয়েক শতাব্দী পর, পাশ্চাত্যের
প্রভাব-প্রতিপত্তি হঠাৎ করে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
"আপনি
বলতে পারেন, চীনকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় তারা এখন নিমগ্ন। ফলে কাশ্মীর
নিয়ে চীন যখন ভারতের সমালোচনা করছে, তখন আমেরিকা বা অন্যান্যরা চীনের সুরে
সুর মিলিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে পারে না।"
তাছাড়া, মাহমুদ আলী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে যে জোট তৈরি করার চেষ্টা করছে সেখানে ভারত একটি বড় শরিক।
"ফলে
আপনি খেয়াল করবেন চীনের শিনজাং প্রদেশে মুসলিমদের ব্যাপারে চীনের নীতি
নিয়ে পশ্চিমা শক্তিদের যত হৈচৈ, কাশ্মীরের মুসলিমদের দুর্দশা নিয়ে তেমন
হৈচৈ নেই।"
'এতটাই গিলেছে যে হজম হবেনা'
কাশ্মীর
যদি চীন এবং আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক রেষারেষির বৃহত্তর ক্যানভাসের অংশ হয়ে
যায়, এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনে ভারতকে সাথে
রাখতেই উদগ্রীব থাকে তাহলে পাকিস্তানের কাছে বিকল্প কী ? যুদ্ধের ঝুঁকি
নেওয়া?
ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়াসমিন আফতাব আলি বিবিসি বাংলাকে বলেন, যুদ্ধ পাকিস্তানের সামনে কোনো বিকল্প নয়।
"একটি
বিষয় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান বা
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা, বুদ্ধিজীবীরা বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কখনই চায়
না ভারতের সাথে পারমাণবিক যুদ্ধের মত কোনো লড়াই হোক। সেটা পাগলামি।"
মিজ আলি বলছেন, কাশ্মীরের মানুষের দুর্দশা, দুর্ভোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বিশ্বের মানুষের কাছে পাকিস্তানকে বলে যেতে হবে।
"আপনি
খেয়াল করবেন ইমরান খান জাতিসংঘে তার ভাষণে বারবার কাশ্মীরের মানুষের
দুর্দশা, দুর্ভোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেছেন। এগুলোই পৃথিবীর মানুষের
মনে দাগ কাটে। সেটার শক্তি অনেক। আমাদের এখন বুঝতে হবে বর্তমানে যুদ্ধের
চরিত্র ভিন্ন। এখানে ক্যামেরার চোখ, যোগাযোগ, ক্রমাগত কথা বলে যাওয়া -
এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
ইয়াসমিন আফতাব আলি বলেন, তার বরঞ্চ বিশ্বাস যে কাশ্মীরে ভারতের পদক্ষেপ ভারত নিজেই সামলাতে পারবে না।
"মোদী
সরকার এতটাই গিলেছে যা হজম করার ক্ষমতা তাদের নেই। ভারতের বিশ্বস্ত কিছু
সূত্র আমাকে বলেছেন যে কাশ্মীরে সরকারের এই পদক্ষেপে সেখানে মানুষ যে এতটা
ক্ষেপে যাবে তা সরকার অনুধাবন করতে পারেনি।"
পাকিস্তানের আফগান অস্ত্র
তাহলে
দেন-দরবার, আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে কাশ্মীরিদের দুর্দশা নিয়ে কথা বলা
ছাড়া কি পাকিস্তানের সামনে আর কোনো উপায় নেই? যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ
তৈরির ক্ষমতা কি পাকিস্তান পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে?
ইয়াসমিন আফতাব
আলি বলেন, ভারতের মত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক গুরুত্ব না থাকলেও আফগানিস্তান
ইস্যুতে আমেরিকাকে ইসলামাবাদের দিকে তাকাতে হবে।
"আফগানিস্তানের
শান্তি আলোচনা যেভাবে হঠাৎ করে ধসে পড়েছে, তাতে আফগান প্রশ্নে পাকিস্তানের
অবস্থান অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এখন পাকিস্তানের
সহযোগিতা দরকার।"
"এটা ঠিক যে ভারত আফগানিস্তানে প্রচুর বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে
অবকাঠামোতে। কিন্তু ভারত এখনও তালেবানের সাথে বা অন্যান্য নানা
জাতি-গোষ্ঠীর সাথে মীমাংসা করার মত অবস্থানে নেই। ফলে, কোনো সন্দেহ নেই যে
আফগান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে খুবই প্রয়োজন। সুতরাং
পাকিস্তানের উদ্বেগও যুক্তরাষ্ট্রকে শুনতে হবে।"
যু্দ্ধের কথা কি ফাঁকা আওয়াজ
কাশ্মীরের
সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ বিপজ্জনক যুদ্ধে
গড়াতে পারে বলে যে হুঁশিয়ারি ইমরান খান দিয়েছেন, তা কি শুধুই আতঙ্ক
তৈরির চেষ্টা?
গবেষক আদিত্য দেব বলেন, যুদ্ধের ঝুঁকি যে নেই সেটা পুরোপুরি বলা যায় না। কিন্তু তার আগে আরো অনেক কিছু ঘটতে হবে।
"আসলে
এর আগে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হলে, কিছু দেশ,
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসতো। কিন্তু গত কয়েক
সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে প্রধান যে উদ্বেগ শোনা যাচ্ছে তা
হলো কাশ্মীরে যোগাযোগ ব্যবস্থা বা চলাফেলার ওপর বিধিনিষেধ নিয়ে। অঞ্চলের
স্ট্যাটাস নিয়ে তাদের চিন্তিত মনে হচ্ছে না, তারা মনে করছে এটা ভারতের
অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।"
সৈয়দ মাহমুদ আলী পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ নাকচ করছেন না।
"সবাই এটা জানে পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের জন্য নয়, বরঞ্চ যুদ্ধ যাতে না বাঁধে তা নিশ্চিত করার একটি অস্ত্র।"
কিন্তু তারপরও তেমন কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করছেন না মাহমুদ আলী।
তার
মতে - পাকিস্তান ভারতের তুলনায় এতই দুর্বল এবং এখন এতই বন্ধুহীন যে ভারত
যদি কখনো পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায় তখন পাকিস্তান উপায়হীন হয়ে সীমিত
মাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা করলেও করতে পারে।
তবে
ভারত হুঁশিয়ার করেছে, তেমন কিছু পাকিস্তান করলে তারা পুরো পাকিস্তানকে
ধ্বংস করে দেবে। এবং মাহমুদ আলীর মতে, সেই ক্ষমতা ভারতের রয়েছে।
মি আলী মনে করেন, ভারতের রাজনীতির মানচিত্র বদলে যাওয়ার কারণে তিনি বড় কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা একবারে নাকচ করতে পারছেন না।
"ভারতের
সেনা কর্মকর্তাদের সূত্রে আমি জানি যে ২০০৮ সালে (মুম্বাইতে সন্ত্রাসী
হামলার পর) তৎকালীন ভারত সরকার তাদের সেনা নেতৃত্বের কাছে জানতে চেয়েছিলেন
তারা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয় তাহলে পাকিস্তানের
পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটা। সরকারকে বলা হয়েছিল সে
সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ। ফলে সেই পথে তখনকার সরকার যাননি। বর্তমানে ভারতের যে
সরকার রয়েছে তারা সে ধরণের বিবেচনা করবেন, তা আমার শতভাগ বিশ্বাস হয় না।"
কাশ্মীর
পরিস্থিতি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তা অনেকটাই নির্ভর করছে সেখানে
বর্তমানের কঠোর বিধিনিষেধে শিথিল করার পর পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার ওপর।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ভারত শাসিত কাশ্মীরে মানুষজন অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে |
No comments