হজযাত্রায় দালাল ঠেকাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে ধর্ম মন্ত্রণালয়
হজযাত্রায়
মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ জন্য
চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় হজ প্যাকেজের সব টাকা ব্যাংকে জমা নেয়ার বিধান করতে
যাচ্ছে তারা। এতে হজযাত্রার শেষদিকে প্রতি বছর বিমান টিকিটের অভাবে অনেকেই
হজে যেতে না পারার বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া
আগামী হজে ট্রলি ব্যাগ হাবের পরিবর্তে হাজীদের নিজেদের কিনে নেয়ার বিধান
করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। এভাবে হাজীবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ২০১৮ সালের
হজের নীতিমালা করতে যাচ্ছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। আগামী সপ্তাহে এ নীতিমালা
মন্ত্রিসভায় উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গত বছর হজ
ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সঙ্কট দেখা দেয়। দফায় দফায় ফ্লাইট বিপর্যয়ের পর শেষ
দিকে অনেক হাজী প্রতারণার শিকার হয়ে হজে যেতে পারেননি। ফলে তারা হজক্যাম্পে
কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তদন্তে জানা যায়, গত বছর দু’টি হজ
প্যাকেজের সর্বনি¤œ প্যাকেজ ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু
মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা গ্রামের হজযাত্রীদের এর থেকে কম টাকায় হজ করানোর
প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ ১৯ হাজার টাকা
পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। মূল হজ এজেন্সির সাথে হজযাত্রীদের সরাসরি যোগাযোগ না
থাকায় এসব দালাল হজযাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিলেও এজেন্সিগুলোকে কম
টাকা দেন। বাকি টাকা তারা নিজেরা রেখে দেন। আর হজ প্যাকেজ থেকে কম টাকা
পাওয়ায় বেসরকারি এজেন্সিগুলো এসব হজযাত্রীকে এড়িয়ে চলেন। তাদের পরিবর্তে
রিপ্লেসমেন্টের সুবিধা নিয়ে তালিকার বাইরে থাকা হজযাত্রীদের কাছ থেকে
অতিরিক্ত টাকা নিয়ে হজে পাঠিয়ে থাকেন। এসব হজযাত্রী শেষ দিকে সমস্যায় পড়লে
যেমন দালালদের খুঁজে পান না, তেমনি হজ এজেন্সিগুলোরও দেখা পান না।
হজক্যাম্পে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায় তাদের। কয়েক বছর থেকেই এ রকম
ঘটনা ঘটে আসছে। এ জন্য বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের
কর্মকর্তাদের। ২০১৮ সালের হজ নীতিমালায় এ জন্য বেশ কিছু নতুন নিয়ম সংযোজন
করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। জানা যায়, এরই মধ্যে হজ নীতিমালা তৈরির পর
মন্ত্রিপরিষদ দফতরে পাঠানো হয়েছে। আগামী সভায় এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেতে
পারে। জানা যায়, প্রতি বছরই হজ প্যাকেজের সব টাকা আগাম পরিশোধ করে ভিসা
থাকার পরও শুধু টিকিটের টাকা নিয়ে ঝামেলায় হজে যাওয়া হয় না অনেক হজযাত্রীর।
গত বছরও এ ধরনের প্রায় দুই শ’ প্রতারিত হজযাত্রী টিকিটের টাকা পরিশোধ করেও
হজে যেতে পাারেননি। দালাল-ফড়িয়া ও সাব-এজেন্ট টিকিটের টাকা আত্মসাৎ করায়
এবার এ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এবারের নীতিমালায় ব্যাংক
অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া বিমানের টিকিটের টাকা কিছুতেই মূল বা সাব-এজেন্ট
উত্তোলন করতে পারবে না। হজ প্যাকেজের ঘোষিত টাকা ব্যাংকে জমার পর তা ব্লক
করে রাখা হবে। পরে এ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে শুধু বিমান টিকিট বাবদ
বাংলাদেশ বিমান বা সৌদি এয়ারলাইন্সের অনুকূলে ব্যয় করতে পারবে হজ এজেন্সি।
হজ চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় সব টাকা নেয়ার বিষয়ে বেসরকারি হজ এজেন্সি
মালিকদের সংগঠন হাবের পক্ষ থেকেও হজ এজেন্সিগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি হাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তা
এজেন্সিগুলোকে ডেকে নিয়ে বলে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে হাবের মহাসচিব শাহাদাত
হোসাইন তসলিম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের দৌরাত্ম্য
বন্ধ করতে চাই। এ জন্য পুরো টাকা নিয়ে তার পর নিবন্ধন করার জন্য বেসরকারি
হজ এজেন্সি মালিকদের বলে দেয়া হয়েছে। পরে কোনো সমস্যা হলে দায়ভার তাদের বহন
করতে হবে। তিনি বলেন, দালাল প্রতিরোধ ছাড়া হজযাত্রার প্রতারণা বন্ধ করা
যাবে না। এ দিকে প্রতি বছর হাজীদের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। গত
বছরও ব্যাগ না পেয়ে চার শতাধিক হজযাত্রী সৌদি চলে যেতে বাধ্য হন। এ ছাড়া
অনেক এজেন্সি নি¤œমানের ব্যাগ সরবরাহ করেন। মূলত গত বছর ট্রলি ব্যাগ
বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয় হাবকে। কিন্তু বিগত সময়ের দুর্নামের কারণে গত বছর
তারা নিজেরা না করে এজেন্সিগুলোকে ব্যাগ বানানোর দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ধর্ম
মন্ত্রণালয় সময়মতো তাদের আগেই জমা দেয়া টাকা ফেরত না দেয়ায় গত বছরও ট্রলি
ব্যাগ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এ জন্য এ বছর ট্রলি ব্যাগের দায়িত্ব
হাজীদের নিজেদের ওপর দেয়ার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়।এ ছাড়া প্রস্তাবিত
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিমান টিকিটের পেছনে মক্কা-মদিনার বাড়ির ঠিকানা লেখা
থাকতে হবে। নইলে জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকেই তাকে ফেরত দেয়া হবে। ঢাকা থেকে
হজযাত্রী ফ্লাইটের টিকিট যখন বুঝে পাবেন, তখনই তার পেছনে মক্কা-মদিনার যেই
বাড়ি বা হোটেলে থাকবেন, তার নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে দেয়া হবে; যাতে
জেদ্দা বিমানবন্দরে নামার সাথে সাথে সেখানকার প্রতিনিধিরা বুঝতে পারেন এরই
মধ্যে তার বাড়িভাড়া নিশ্চিত করা হয়েছে। গত বছর অনেক হজযাত্রীকে বাড়িভাড়া না
করেই ঢাকা থেকে মক্কা নেয়া হয়। সেখানে তাদের হেরেম শরিফ থেকে অনেক দূরে
দুর্গম পাহাড়ি এলাকার বাসাবাড়িতে রাখা হয়। এয়ারকন্ডিশন নেই এমন বাড়িঘর,
এমনকি কবুতরের খোপের মতো ঘরে হজযাত্রীদের রাখা হয়। গতবারের মতো এ ধরনের
বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আর যাতে কোনো হজযাত্রীকে পড়তে না হয় সে জন্য এবার
ঢাকা থেকেই হজযাত্রীর সুনির্দিষ্ট বাসাবাড়ি বা হোটেলের ঠিকানা নিশ্চিত করতে
হবে। যদি কোনো এজেন্ট এ কাজটি না করে তাহলে ওই হজযাত্রীকে ফ্লাইটের টিকিট
দেয়া হবে না। এবার রিপ্লেসমেন্টের বিষয়ে খুব কড়াকড়ি করার প্রস্তাব রাখা
হয়েছে। গত বছর প্রথমে ছিল ৫ শতাংশ। পরে সেটি ১৫ শতাংশ করা হয়। এবার তা
কিছুতেই ৫ শতাংশের বেশি করা হবে না বলে জানা গেছে। মৃত্যু ও গুরুতর
অসুস্থতাজনিত কারণ ছাড়া অতিরিক্ত রিপ্লেসমেন্ট হবে না। এ ব্যাপারে ধর্ম
মন্ত্রণালয়রে যুগ্মসচিব (হজ) হাফিজ উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, হজযাত্রীদের
সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাবনা
রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে এবারের হজ নীতিমালা। নীতিমালা ইতোমধ্যে কেবিনেট
শাখায় পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী সপ্তাহেই এ নীতিমালা কেবিনেট
বৈঠকে অনুমোদিত হবে।
No comments