ইতিহাসের দিল্লি ও ক্ষমতার দিল্লি by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
এই কলামের প্রেক্ষাপট
দিল্লি দূর-আস্ত। মানে, দিল্লি অনেক দূর। ‘দিল্লি’ শহরের নামটি প্রতীকী অর্থে নিলাম। আজকের কলামের প্রথম অর্ধেকে ইতিহাসের একটি গল্প তুলে ধরব; দ্বিতীয় অর্ধেকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর মন্তব্য করছি। ইতিহাসের গল্পটি এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার জন্য সম্মানিত পাঠককে অনুরোধ করব। ইতিহাসের গল্পটিতে ছয় শ’ বছর আগের তুঘলক বংশের এবং প্রসিদ্ধ আউলিয়া হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার কথা আছে। মোগল সম্রাটরা তথা ভারত শাসনকারী মোগল বংশের কথা সবারই জানা। এর আগে যারা ভারত শাসন করেছিলেন, সে সম্বন্ধে জানার সুযোগ কম। মামলুক বংশ ও খিলজি বংশের পর ভারত শাসন করেছিল তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৪)। তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতার আদি নাম গাজী মালিক; কিন্তু তিনি সুলতান হিসেবে গিয়াস আল-দ্বীন তুঘলক বা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নামেই ইতিহাসে সুপরিচিত; তার পরবর্তী সুলতান ছিলেন তারই দ্বিতীয় ছেলে জুনা খান, যিনি মুহাম্মদ বিন তুঘলক নামে শাসন করেছেন। ‘আউলিয়া’ শব্দের অর্থ অনেকটা এ রকম : আল্লাহর বন্ধু তথা সৎ কর্মশীল বান্দাগণ বা প্রকৃত মুমিনগণ অর্থাৎ সার্বিকভাবেই দ্বীন ইসলামের শরিয়ত ও মারেফত পালনকারী ব্যক্তিগণ। পবিত্র কুরআনের দশম সূরা (ইউনুস) ৬২ নম্বর আয়াতে বলা আছে : নিশ্চয়ই আল্লাহর আউলিয়াগণের দুঃখিত বা শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যা হোক, আমার আলোচনা ‘আউলিয়া’ শব্দের সংজ্ঞার ওপরে নয়; আমার আলোচনা মানুষের আশা আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের মাঝখানের অংশ নিয়ে। অর্থাৎ, ইংরেজিতে যাকে বলে- ‘ম্যান প্রপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস।’
ইতিহাসের একটি গল্প
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কঠোর প্রকৃতির শাসনকর্তা ছিলেন। মানুষ তার শাসন থেকে নিষ্কৃতি চাচ্ছিল। তৎকালীন রাজধানী দিল্লি শহরে একদিন প্রত্যুষে গুজব রটে গেল যে, বাদশাহ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মারা গেছেন। রাজধানীর নাগরিকরা, সত্য মনে করে খবরটিতে খুব আনন্দিত হলো, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। এই খবর যখন বাদশাহ’র কাছে পৌঁছল, তখন তিনি রাগান্বিত হলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- ‘মানুষ আমাকে গুজবের মধ্যে মেরেছে, আমি তাদেরকে আসলেই মারব।’ নগরীর কোতোয়ালকে হুকুম দিলেন, গুজব রটনাকারীদের হত্যা করা হোক। কোতোয়াল এই কার্য সম্পাদনে লিপ্ত হলেন। কে গুজব রটনা করেছিল আর কে করেনি, এটা বের করা কঠিন ছিল। অতএব, নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু হলো। কয়েক হাজার মারা গেল, হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকে। সম্রাটের হুকুমে মারা যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দিল্লির নাগরিকরা আশ্রয়ের সন্ধান করলেন। তৎকালীন দিল্লি থেকে মাইল তিরিশেক দূরে ছিল ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানা। দিল্লি থেকে নাগরিকরা পালিয়ে সেই আস্তানায় উপস্থিত হলেন। আস্তানায় মানুষ বাড়তে লাগল; খাবার পানি ও ব্যবহারের পানির সঙ্কট দেখা দিলো। ভূগোলের জ্ঞান আছেÑ এমন মানুষমাত্রই জানেন যে, অতীতের বা বর্তমানের দিল্লি মহানগরী চতুর্দিকে মরুভূমি দ্বারা বেষ্টিত। পানির সঙ্কট মেটানোর জন্য নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ভক্তদের বললেন, পুকুর খনন করো। যেই কথা সেই কাজ; বিনা পারিশ্রমিকে শত শত, হাজার হাজার ভক্ত পুকুর খননের কাজে লাগলেন। রাজধানী দিল্লিতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এই সংবাদ পেয়ে রেগে গেলেন। উজিরকে হুকুম দিলেন, ঘোষণা করে দাও, আমার এখানে পুকুর খোঁড়া হবে এবং পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যেকেই দিনে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা পাবে। বাদশাহ অনুমান করলেন, স্বর্ণমুদ্রার আশায় দিল্লিবাসী দূরে যাবে না এবং যারা গেছে তারা ফেরত আসবে। কিন্তু বাদশার ঘোষণায় কাজ হলো না। দিল্লিবাসী ফকির নিজাম উদ্দিনের আস্তানার দিকে যেতেই থাকলেন। এতে বাদশাহ আরো ক্রুদ্ধ হলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘তবে রে!’ সেনাপতিকে বললেন, ‘ফকিরের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া হোক, সৈন্যদল পাঠাও।’ ফকিরের আস্তানা ধ্বংসের অভিযান শুরু করার আগেই সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কাছে সংবাদ এলো, দূরবর্তী প্রদেশে বিদ্রোহ হয়েছে। সুলতান বিবেচনা করলেন, বিদ্রোহ দমন করা অতিশয় জরুরি; ফকিরের আস্তানা পরে ধ্বংস করা যাবে। তিনি দূর প্রদেশে বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে রওনা দিলেন। হাতে-কলমে যুদ্ধবিদ্যা ও সেনানায়কত্ব শিক্ষা দেয়ার জন্য, বড় ছেলে আহমদ বিন তুঘলককে সাথে নিলেন। রাজধানী দেখাশোনা করার জন্য রেখে গেলেন দ্বিতীয় ছেলে মুহাম্মদ বিন তুঘলককে। ইতিহাস বলে, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ফকির নিজাম উদ্দিনের ভক্ত ছিলেন। সুলতান বিদ্রোহ দমনার্থে দূরবর্তী প্রদেশে পৌঁছলেন, বিদ্রোহ দমন করলেন এবং পুনরায় দিল্লি অভিমুখে রওনা দিলেন। প্রতিদিন যোজন পথ অতিক্রম করে দিল্লির নিকটবর্তী হতে থাকেন। ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানায় ভক্তরা নিবেদন করেন, হুজুর বাদশাহ এসে তো আপনাকে এবং আমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে। নিজাম উদ্দিন আউলিয়া উত্তর দেনÑ দিল্লি দূর-আস্ত। এর বাংলায় অর্থ, দিল্লি অনেক দূর। ভক্ত, যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক নিজেও ফকিরের নিকট এসে আরজি পেশ করলেন : ‘আমার বাবা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তিনি দিল্লির অনেক কাছে চলে এসেছেন। তিনি এসেই আস্তানা আক্রমণ করবেন। তিনি আপনাকে অপমান করবেন। আস্তানা ধ্বংস করবেন। আপনি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যান ভক্তদের নিয়ে, আমি সাহায্য করব। রাজকোষ থেকে কিছু লাগলে আমি দেবো, বাদশার নিষ্ঠুরতার কথা কল্পনা করে আমার আত্মা কাঁদছে। হুজুর, আপনি চলে যান।’ ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া যুবরাজ মুহাম্মদকে উদ্দেশ করে বললেনÑ ‘বাবা, চিন্তা করো না। দিল্লি অনেক দূর, দিল্লি দূর-আস্ত। সম্রাটের বহর রাজধানীতে ঢোকার মাত্র দুই দিনের পথ বাকি। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ঠিক করলেন বিদ্রোহ দমনকারী পিতাকে সংবর্ধনা দেবেন, জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা দেবেন, বিরাট প্যারেডের মাধ্যমে স্যালুট দেবেন। যেই কথা সেই কাজ। যুবরাজ ভাবলেন, এই অছিলায় একটা দিন তো পাওয়া যাবে; নিজাম উদ্দিন আউলিয়া সিদ্ধান্ত নিতেও পারেন আস্তানা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। ফকিরের নিকট পুনরায় সংবাদ গেল; কিন্তু তিনি জানালেন. দিল্লি এখনো অনেক দূর, দিল্লি হনুজ দূর-আস্ত।’ যুবরাজ মুহাম্মদ কিছুই বুঝলেন না। কারণ, তিনি দেখছেন সবাই দেখছে, বাদশাহ দিল্লি ঢোকার জন্য মাত্র এক দিনের পথ বাকি। কিন্তু কথাটা কেউ বলতে পারছে না মুখ ফুটে। কেউ ফকির নিজাম উদ্দিনের কথার হিসাবও মেলাতে পারছে না। সংবর্ধনা শুরু হলো; মঞ্চের সামনে দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনী, উট আরোহী বাহিনী পার হয়ে গেল। সবশেষে পার হচ্ছে হাতি-বাহিনী। অনেকগুলো হাতি সুশৃঙ্খলভাবে, মাহুতের নির্দেশে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং শুঁড় তুলে বাদশাহকে সালাম দিচ্ছে। হঠাৎ একটি হাতি উত্তেজিত হয়ে উঠল; প্রথমে নিজের পিঠে চড়া মাহুতকে পিঠের ওপর থেকে শুঁড় দিয়ে তুলে ধরে দূরে নিক্ষেপ করল। তারপর উন্মত্ত হাতি ছুটে গেল মঞ্চের দিকে। মঞ্চের মোটা মোটা থাম ধরে দিলো টান। ফলে মঞ্চ ভেঙে পড়ল। অনেক হতাহত হলো। উন্মত্ত হাতি আশ্রয় নিলো উন্মুক্ত মরুভূমিতে। উদ্ধারকারী কর্মীরা মঞ্চের ভগ্নস্তূপ সরালেন; দেখলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক উপুড় হয়ে তার ছেলে আহমদ বিন তুঘলককে আগলে রেখেছেন। সুলতান চেয়েছিলেন নিজে মারা গেলেও প্রিয় ছেলে আহমদ যেন বাঁচে। কেউই বাঁচেননি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও আহমদÑ দু’জনই নিহত হয়েছিলেন। ফলে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক অপ্রত্যাশিতভাবেই সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
এ কাহিনীর উপসংহার
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক পরবর্তী প্রথম প্রহরেই ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানায় ছুটে গেলেন; মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তিনি নতুনভাবে নব উদ্যমে ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের জন্য দিল্লি নিজের হয়ে গেল। অপর দিকে, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও তার সন্তান আহমদ বিন তুঘলকের জন্য দিল্লি অনেক দূরেই থেকে গেল। অপবিত্রদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় পবিত্ররা; যারা লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরেই থাকে। দয়াবানগণ আক্রমণের শিকার হন নিষ্ঠুরদের; নিষ্ঠুরতারও একটা শেষ থাকে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। ক্লাস এইটে অথবা নাইনে যখন পড়ি, র্যাপিড রিডার হিসেবে একটি বইয়ের অংশ পড়েছিলাম। বিংশ শতাব্দীর মধ্য অংশের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিনয় চাঁদ মুখোপাধ্যয় (বহুলপরিচিত ছদ্মনাম যাযাবর)-এর লেখা অন্যতম উপন্যাস বা গল্পের বইয়ের নাম দৃষ্টিপাত; যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ‘দৃষ্টিপাত’-এর একটা অংশ আমাদের পড়তে হয়েছিল। ওই অংশেই ছিল, নিরীহ প্রজাদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো এবং আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার সাথে বেয়াদবি করার পরিণতিতে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিনের ভাগ্যে যা ঘটেছিল, তার বর্ণনা। পরবর্তীকালে নিজের উদ্যোগে ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাস পুরোটাই পড়েছি। আমার মূল্যায়নে সুখপাঠ্য ইতিহাসনির্ভর গল্পের বই এটি। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতেই হয় আমাকে। কারণ নিজে একজন সাবেক সেনা কর্র্মকর্তা এবং এখন রাজনৈতিক কর্মী। কারণ, আমি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান। কল্যাণ পার্টি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। এরূপ চিন্তা করতে গেলে মাথায় অনেক কিছুই আসবে। ওপরের অনুচ্ছেদগুলোতে প্রকাশিত বা উদ্ভাসিত বিষয় অনেকগুলো। আমরা কয়েকটা সংক্ষিপ্ত বাক্যে মূল বিষয়টা তুলে ধরি। এক. সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নৃশংস ছিলেন। দুই. তিনি ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার প্রতি আক্রমণাত্মক তথা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক ছিলেন। তিন. গিয়াস উদ্দিন তুঘলক চেয়েছিলেন, তার পরে তার প্রথম ছেলে যখন সালতানাতের দায়িত্ব নেবে, সে যেন শাসনকার্যে ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়। চার. মুহাম্মদ বিন তুঘলক ফকির নিজাম উদ্দিনের ভক্ত এবং প্রজাবৎসল ছিলেন। পাঁচ. নিজাম উদ্দিন আউলিয়া মানুষকে ভালোবাসতেন; মানুষকে ফেলে তিনি অন্যত্র চলে যাননি। ছয়. সাধারণত মানুষ জানে না, তার ভাগ্যে কী আছে; যেমনÑ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক জানতেন না যে, অদৃষ্টে অপমৃত্যু আছে বা মুহাম্মদ বিন তুঘলক জানতেন না যে, তার ভাগ্যে সিংহাসন আছে।
টেইলর মেড কাকে বলে বা কেন বলে?
আজকাল রেডিমেড পোশাক প্রচুর। ঈদের সময় ছাড়া দর্জির কাছে গিয়ে প্যান্ট ও জামার মাপ দিয়ে কাপড় বানানোর রেওয়াজ প্রায় উঠে যাচ্ছে। দর্জি প্রত্যেকের পছন্দ মোতাবেক কাপড় সেলাই করে দেন। কাস্টমারের শরীরে যেন ফিট হয় সে ভাবেই কাপড়টি সেলাই করা হয়। তাই এটার নাম টেইলর মেইড, অর্থাৎ দর্জির বানানো। সেই থেকে ইংরেজি শব্দযুগল ‘টেইলর মেইড’। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কর্তৃক প্রদত্ত রায়টিও ছিল আমার মূল্যায়নে টেইলর মেড; তদ্রƒপ জনমনে ব্যাপক ধারণা হলোÑ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়টিও টেইলর মেইড, অর্থাৎ ফরমায়েশ মোতাবেক বানিয়ে দেয়া। চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বের হলো বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে সেই রায়। এটা স্পষ্ট যে, এ মামলাটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা এবং রায়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে টেইলর মেইড।
সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো, যে নিয়মেই হোক না কেন, ইংরেজিতে : বাই হুক অর বাই ক্রুক, অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন, আগামী নির্বাচনে জিততে হবে। ইংরেজি পরিভাষায় : বাই ফেয়ার মিনস অর আনফেয়ার মিনস, দ্যাট ইজ, টু সে বাই এনি মিনস। অর্থাৎ সৎ বা অসৎ নিয়মে, যেভাবেই হোক, আগামী নির্বাচনে জয়ী হতেই হবে। এ কথাটাকে খেয়ালে রেখেই বর্তমান রাজনৈতিক সরকার তাদের কর্মপন্থাগুলো স্থির করছে। তাদের উদ্দেশ্য পূরণের পথে অনেক প্রকার বাধা আছে; যথা এক. অপহরণ গুম ও খুনের অভিযোগ। দুই. অব্যাহত ও বিবিধমুখী ‘ঐতিহাসিক’ দুর্নীতিগুলো। তিন. বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড যথা ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এর বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, একতরফাভাবে ভারতকে সুবিধা দেয়া। তাদের সামনে বাধাগুলোর মধ্যে ভিন্ন ধরনের বাধা হলোÑ বিএনপির জনপ্রিয়তা তথা বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা। আপাতত আমরা কলামের এই অংশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং বেগম জিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : যুগে যুগে দেশে দেশে
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য অস্বচ্ছ অবৈধ পন্থা অবলম্বনের উদাহরণ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আছে। ১৯১৭ সালে লেনিন রাশিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলে, ট্রটস্কি তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেন। একপর্যায়ে লেনিন ট্রটস্কিকে সশরীরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেন। পরবর্তী শাসক স্টালিনও অনুরূপ কাজ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত ও মালয়েশিয়ার ২২ বছরের প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তার প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইবরাহিমকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিতাড়নের জন্য তার বিরুদ্ধে সমকামিতার মতো অবিশ্বাস্য অভিযোগ এনে ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে তাকে দণ্ডিত করেন। আমেরিকার এককালীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে হয়রানি করার জন্য এর হেডকোয়ার্টারে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়েছিলেন (ইতিহাসে এটা ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত)। নিকট অতীতে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল আইডি থেকে সরকারি বার্তা আদান-প্রদান করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তার দেশের, সরকারি অর্থ তহবিল, সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি গোয়েন্দাবাহিনী ও বিচার বিভাগের অনুগত ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছেন নিজের ক্ষমতার স্বার্থে। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, ইরানের শাহানশাহ রেজা পাহলভী, রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চসেস্কু ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এ ক্ষেত্রে কয়েকটি মাত্র উদাহরণ।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উত্তরসূরি
রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান তথা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও এর নেত্রী চক্ষুশূল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চক্ষুশূল। আগামী দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। তবে প্রতিযোগিতা স্বচ্ছ হওয়া বাঞ্ছনীয়; কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ওইরূপ স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তাই তারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে দৃশ্যপট থেকে অপসারণ করতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য বেছে নেয়া বেশ কিছু পন্থার মধ্যে অন্যতম পন্থা বা অস্ত্র হলো রাজনৈতিক মামলা। ২০০৭ ও ২০০৮ এই দু’টি বছরকে বাংলাদেশে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময় বলা হয়। ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রকাশ্য প্রধান ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ এবং অপ্রকাশ্য প্রধান ছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। তাই বলা হয়, এটা উদ্দীনদের সরকার। ওই সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকার বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের লক্ষ্যে ওই সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা দিয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেন সরকার দু’নেত্রীকে বিভিন্ন প্রকারের হয়রানি করে। হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী মাননীয় শেখ হাসিনা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে আশ্বাস দেয়া যে, আমি তোমাদের পক্ষে আছি এবং তোমাদের সব কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দেবো; তথা তোমাদেরকে অভিযুক্ত করব না।’ ওয়ান-ইলেভেন সরকার যখন দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কাবু করতে পারল না, তখন সেই সরকার দু’জনের যেকোনো একজনের সাথে আপস করার সিদ্ধান্ত নিলো। বেগম জিয়া ছিলেন আগ থেকেই আপসহীন নেত্রী; তিনি আপস করতে রাজি হলেন না। শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের সাথে আপস করেছিলেন, ফলে আপসের কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা ছিল; তিনি ‘উদ্দীন’দের সাথে আপস করলেন। অতিসম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ভারতের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০০৮ সালে এই কাজে মধ্যস্থতা করেছিলেন। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন হলো। ‘উদ্দীন’দের সরকার এবং আওয়ামী নেত্রীর মধ্যকার আপসের শর্ত মোতাবেক, ওই সরকারের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কোথাও উপস্থাপিত হলো না। সে আপসের শর্ত মোতাবেক, তিনি ওই সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দিলেনÑ কোনো ক্ষেত্রে নীরবে, কোনো ক্ষেত্রে সরবে। অনুমোদন দেয়া কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ওয়ান-ইলেভেন সরকার কর্তৃক বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চালু রাখা। ওই রকমই অব্যাহত রাখা একটা মামলার রায় প্রকাশ করা হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। সম্মানিত পাঠককে আমার পক্ষ থেকে জানিয়ে রাখতেই হবে, ওয়ান-ইলেভেন সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা দিয়েছিল; সেই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে আইনকানুনের ফাঁক ব্যবহার করে ‘আইনি’ পন্থাতেই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কোনো আদালতে সে মামলাগুলোর বিচার হয়নি। এই যে পুরো প্রক্রিয়া, এটাকে কি বলা যায়- দুই নেত্রীর মধ্যকার ভালোবাসার নমুনা, নাকি এটা প্রতিহিংসার নমুনা? প্রতিহিংসা বেশির ভাগ সময়েই খারাপ পরিণতি বয়ে আনে। প্রতিহিংসার মাধ্যমে, আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আরো পাঁচ বা সাত বা দশ বছর বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতে চায়। থাকতে চাওয়া অপরাধ নয়, বিতর্কিত ও অবৈধপন্থায় থাকতে চাওয়া হলো অন্যায়। ক্ষমতায় পুনরায় আরোহণ কি দশ মাস দূরে নাকি অনেক দূরে, আমি জানি না। বর্তমান যুগের কোনো নিজাম উদ্দিন আউলিয়া থাকলে হয়তো বলতে পারেন, যদি মহান আল্লাহ চান যে, তিনি বলুন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com
দিল্লি দূর-আস্ত। মানে, দিল্লি অনেক দূর। ‘দিল্লি’ শহরের নামটি প্রতীকী অর্থে নিলাম। আজকের কলামের প্রথম অর্ধেকে ইতিহাসের একটি গল্প তুলে ধরব; দ্বিতীয় অর্ধেকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর মন্তব্য করছি। ইতিহাসের গল্পটি এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার জন্য সম্মানিত পাঠককে অনুরোধ করব। ইতিহাসের গল্পটিতে ছয় শ’ বছর আগের তুঘলক বংশের এবং প্রসিদ্ধ আউলিয়া হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার কথা আছে। মোগল সম্রাটরা তথা ভারত শাসনকারী মোগল বংশের কথা সবারই জানা। এর আগে যারা ভারত শাসন করেছিলেন, সে সম্বন্ধে জানার সুযোগ কম। মামলুক বংশ ও খিলজি বংশের পর ভারত শাসন করেছিল তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৪)। তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতার আদি নাম গাজী মালিক; কিন্তু তিনি সুলতান হিসেবে গিয়াস আল-দ্বীন তুঘলক বা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নামেই ইতিহাসে সুপরিচিত; তার পরবর্তী সুলতান ছিলেন তারই দ্বিতীয় ছেলে জুনা খান, যিনি মুহাম্মদ বিন তুঘলক নামে শাসন করেছেন। ‘আউলিয়া’ শব্দের অর্থ অনেকটা এ রকম : আল্লাহর বন্ধু তথা সৎ কর্মশীল বান্দাগণ বা প্রকৃত মুমিনগণ অর্থাৎ সার্বিকভাবেই দ্বীন ইসলামের শরিয়ত ও মারেফত পালনকারী ব্যক্তিগণ। পবিত্র কুরআনের দশম সূরা (ইউনুস) ৬২ নম্বর আয়াতে বলা আছে : নিশ্চয়ই আল্লাহর আউলিয়াগণের দুঃখিত বা শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যা হোক, আমার আলোচনা ‘আউলিয়া’ শব্দের সংজ্ঞার ওপরে নয়; আমার আলোচনা মানুষের আশা আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের মাঝখানের অংশ নিয়ে। অর্থাৎ, ইংরেজিতে যাকে বলে- ‘ম্যান প্রপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস।’
ইতিহাসের একটি গল্প
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কঠোর প্রকৃতির শাসনকর্তা ছিলেন। মানুষ তার শাসন থেকে নিষ্কৃতি চাচ্ছিল। তৎকালীন রাজধানী দিল্লি শহরে একদিন প্রত্যুষে গুজব রটে গেল যে, বাদশাহ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মারা গেছেন। রাজধানীর নাগরিকরা, সত্য মনে করে খবরটিতে খুব আনন্দিত হলো, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। এই খবর যখন বাদশাহ’র কাছে পৌঁছল, তখন তিনি রাগান্বিত হলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- ‘মানুষ আমাকে গুজবের মধ্যে মেরেছে, আমি তাদেরকে আসলেই মারব।’ নগরীর কোতোয়ালকে হুকুম দিলেন, গুজব রটনাকারীদের হত্যা করা হোক। কোতোয়াল এই কার্য সম্পাদনে লিপ্ত হলেন। কে গুজব রটনা করেছিল আর কে করেনি, এটা বের করা কঠিন ছিল। অতএব, নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু হলো। কয়েক হাজার মারা গেল, হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকে। সম্রাটের হুকুমে মারা যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দিল্লির নাগরিকরা আশ্রয়ের সন্ধান করলেন। তৎকালীন দিল্লি থেকে মাইল তিরিশেক দূরে ছিল ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানা। দিল্লি থেকে নাগরিকরা পালিয়ে সেই আস্তানায় উপস্থিত হলেন। আস্তানায় মানুষ বাড়তে লাগল; খাবার পানি ও ব্যবহারের পানির সঙ্কট দেখা দিলো। ভূগোলের জ্ঞান আছেÑ এমন মানুষমাত্রই জানেন যে, অতীতের বা বর্তমানের দিল্লি মহানগরী চতুর্দিকে মরুভূমি দ্বারা বেষ্টিত। পানির সঙ্কট মেটানোর জন্য নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ভক্তদের বললেন, পুকুর খনন করো। যেই কথা সেই কাজ; বিনা পারিশ্রমিকে শত শত, হাজার হাজার ভক্ত পুকুর খননের কাজে লাগলেন। রাজধানী দিল্লিতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এই সংবাদ পেয়ে রেগে গেলেন। উজিরকে হুকুম দিলেন, ঘোষণা করে দাও, আমার এখানে পুকুর খোঁড়া হবে এবং পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যেকেই দিনে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা পাবে। বাদশাহ অনুমান করলেন, স্বর্ণমুদ্রার আশায় দিল্লিবাসী দূরে যাবে না এবং যারা গেছে তারা ফেরত আসবে। কিন্তু বাদশার ঘোষণায় কাজ হলো না। দিল্লিবাসী ফকির নিজাম উদ্দিনের আস্তানার দিকে যেতেই থাকলেন। এতে বাদশাহ আরো ক্রুদ্ধ হলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘তবে রে!’ সেনাপতিকে বললেন, ‘ফকিরের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া হোক, সৈন্যদল পাঠাও।’ ফকিরের আস্তানা ধ্বংসের অভিযান শুরু করার আগেই সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কাছে সংবাদ এলো, দূরবর্তী প্রদেশে বিদ্রোহ হয়েছে। সুলতান বিবেচনা করলেন, বিদ্রোহ দমন করা অতিশয় জরুরি; ফকিরের আস্তানা পরে ধ্বংস করা যাবে। তিনি দূর প্রদেশে বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে রওনা দিলেন। হাতে-কলমে যুদ্ধবিদ্যা ও সেনানায়কত্ব শিক্ষা দেয়ার জন্য, বড় ছেলে আহমদ বিন তুঘলককে সাথে নিলেন। রাজধানী দেখাশোনা করার জন্য রেখে গেলেন দ্বিতীয় ছেলে মুহাম্মদ বিন তুঘলককে। ইতিহাস বলে, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ফকির নিজাম উদ্দিনের ভক্ত ছিলেন। সুলতান বিদ্রোহ দমনার্থে দূরবর্তী প্রদেশে পৌঁছলেন, বিদ্রোহ দমন করলেন এবং পুনরায় দিল্লি অভিমুখে রওনা দিলেন। প্রতিদিন যোজন পথ অতিক্রম করে দিল্লির নিকটবর্তী হতে থাকেন। ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানায় ভক্তরা নিবেদন করেন, হুজুর বাদশাহ এসে তো আপনাকে এবং আমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে। নিজাম উদ্দিন আউলিয়া উত্তর দেনÑ দিল্লি দূর-আস্ত। এর বাংলায় অর্থ, দিল্লি অনেক দূর। ভক্ত, যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক নিজেও ফকিরের নিকট এসে আরজি পেশ করলেন : ‘আমার বাবা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তিনি দিল্লির অনেক কাছে চলে এসেছেন। তিনি এসেই আস্তানা আক্রমণ করবেন। তিনি আপনাকে অপমান করবেন। আস্তানা ধ্বংস করবেন। আপনি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যান ভক্তদের নিয়ে, আমি সাহায্য করব। রাজকোষ থেকে কিছু লাগলে আমি দেবো, বাদশার নিষ্ঠুরতার কথা কল্পনা করে আমার আত্মা কাঁদছে। হুজুর, আপনি চলে যান।’ ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া যুবরাজ মুহাম্মদকে উদ্দেশ করে বললেনÑ ‘বাবা, চিন্তা করো না। দিল্লি অনেক দূর, দিল্লি দূর-আস্ত। সম্রাটের বহর রাজধানীতে ঢোকার মাত্র দুই দিনের পথ বাকি। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ঠিক করলেন বিদ্রোহ দমনকারী পিতাকে সংবর্ধনা দেবেন, জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা দেবেন, বিরাট প্যারেডের মাধ্যমে স্যালুট দেবেন। যেই কথা সেই কাজ। যুবরাজ ভাবলেন, এই অছিলায় একটা দিন তো পাওয়া যাবে; নিজাম উদ্দিন আউলিয়া সিদ্ধান্ত নিতেও পারেন আস্তানা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। ফকিরের নিকট পুনরায় সংবাদ গেল; কিন্তু তিনি জানালেন. দিল্লি এখনো অনেক দূর, দিল্লি হনুজ দূর-আস্ত।’ যুবরাজ মুহাম্মদ কিছুই বুঝলেন না। কারণ, তিনি দেখছেন সবাই দেখছে, বাদশাহ দিল্লি ঢোকার জন্য মাত্র এক দিনের পথ বাকি। কিন্তু কথাটা কেউ বলতে পারছে না মুখ ফুটে। কেউ ফকির নিজাম উদ্দিনের কথার হিসাবও মেলাতে পারছে না। সংবর্ধনা শুরু হলো; মঞ্চের সামনে দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনী, উট আরোহী বাহিনী পার হয়ে গেল। সবশেষে পার হচ্ছে হাতি-বাহিনী। অনেকগুলো হাতি সুশৃঙ্খলভাবে, মাহুতের নির্দেশে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং শুঁড় তুলে বাদশাহকে সালাম দিচ্ছে। হঠাৎ একটি হাতি উত্তেজিত হয়ে উঠল; প্রথমে নিজের পিঠে চড়া মাহুতকে পিঠের ওপর থেকে শুঁড় দিয়ে তুলে ধরে দূরে নিক্ষেপ করল। তারপর উন্মত্ত হাতি ছুটে গেল মঞ্চের দিকে। মঞ্চের মোটা মোটা থাম ধরে দিলো টান। ফলে মঞ্চ ভেঙে পড়ল। অনেক হতাহত হলো। উন্মত্ত হাতি আশ্রয় নিলো উন্মুক্ত মরুভূমিতে। উদ্ধারকারী কর্মীরা মঞ্চের ভগ্নস্তূপ সরালেন; দেখলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক উপুড় হয়ে তার ছেলে আহমদ বিন তুঘলককে আগলে রেখেছেন। সুলতান চেয়েছিলেন নিজে মারা গেলেও প্রিয় ছেলে আহমদ যেন বাঁচে। কেউই বাঁচেননি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও আহমদÑ দু’জনই নিহত হয়েছিলেন। ফলে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন তুঘলক অপ্রত্যাশিতভাবেই সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
এ কাহিনীর উপসংহার
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক পরবর্তী প্রথম প্রহরেই ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার আস্তানায় ছুটে গেলেন; মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তিনি নতুনভাবে নব উদ্যমে ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের জন্য দিল্লি নিজের হয়ে গেল। অপর দিকে, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও তার সন্তান আহমদ বিন তুঘলকের জন্য দিল্লি অনেক দূরেই থেকে গেল। অপবিত্রদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় পবিত্ররা; যারা লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরেই থাকে। দয়াবানগণ আক্রমণের শিকার হন নিষ্ঠুরদের; নিষ্ঠুরতারও একটা শেষ থাকে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। ক্লাস এইটে অথবা নাইনে যখন পড়ি, র্যাপিড রিডার হিসেবে একটি বইয়ের অংশ পড়েছিলাম। বিংশ শতাব্দীর মধ্য অংশের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিনয় চাঁদ মুখোপাধ্যয় (বহুলপরিচিত ছদ্মনাম যাযাবর)-এর লেখা অন্যতম উপন্যাস বা গল্পের বইয়ের নাম দৃষ্টিপাত; যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ‘দৃষ্টিপাত’-এর একটা অংশ আমাদের পড়তে হয়েছিল। ওই অংশেই ছিল, নিরীহ প্রজাদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো এবং আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার সাথে বেয়াদবি করার পরিণতিতে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিনের ভাগ্যে যা ঘটেছিল, তার বর্ণনা। পরবর্তীকালে নিজের উদ্যোগে ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাস পুরোটাই পড়েছি। আমার মূল্যায়নে সুখপাঠ্য ইতিহাসনির্ভর গল্পের বই এটি। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতেই হয় আমাকে। কারণ নিজে একজন সাবেক সেনা কর্র্মকর্তা এবং এখন রাজনৈতিক কর্মী। কারণ, আমি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান। কল্যাণ পার্টি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। এরূপ চিন্তা করতে গেলে মাথায় অনেক কিছুই আসবে। ওপরের অনুচ্ছেদগুলোতে প্রকাশিত বা উদ্ভাসিত বিষয় অনেকগুলো। আমরা কয়েকটা সংক্ষিপ্ত বাক্যে মূল বিষয়টা তুলে ধরি। এক. সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নৃশংস ছিলেন। দুই. তিনি ফকির নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার প্রতি আক্রমণাত্মক তথা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক ছিলেন। তিন. গিয়াস উদ্দিন তুঘলক চেয়েছিলেন, তার পরে তার প্রথম ছেলে যখন সালতানাতের দায়িত্ব নেবে, সে যেন শাসনকার্যে ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়। চার. মুহাম্মদ বিন তুঘলক ফকির নিজাম উদ্দিনের ভক্ত এবং প্রজাবৎসল ছিলেন। পাঁচ. নিজাম উদ্দিন আউলিয়া মানুষকে ভালোবাসতেন; মানুষকে ফেলে তিনি অন্যত্র চলে যাননি। ছয়. সাধারণত মানুষ জানে না, তার ভাগ্যে কী আছে; যেমনÑ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক জানতেন না যে, অদৃষ্টে অপমৃত্যু আছে বা মুহাম্মদ বিন তুঘলক জানতেন না যে, তার ভাগ্যে সিংহাসন আছে।
টেইলর মেড কাকে বলে বা কেন বলে?
আজকাল রেডিমেড পোশাক প্রচুর। ঈদের সময় ছাড়া দর্জির কাছে গিয়ে প্যান্ট ও জামার মাপ দিয়ে কাপড় বানানোর রেওয়াজ প্রায় উঠে যাচ্ছে। দর্জি প্রত্যেকের পছন্দ মোতাবেক কাপড় সেলাই করে দেন। কাস্টমারের শরীরে যেন ফিট হয় সে ভাবেই কাপড়টি সেলাই করা হয়। তাই এটার নাম টেইলর মেইড, অর্থাৎ দর্জির বানানো। সেই থেকে ইংরেজি শব্দযুগল ‘টেইলর মেইড’। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কর্তৃক প্রদত্ত রায়টিও ছিল আমার মূল্যায়নে টেইলর মেড; তদ্রƒপ জনমনে ব্যাপক ধারণা হলোÑ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়টিও টেইলর মেইড, অর্থাৎ ফরমায়েশ মোতাবেক বানিয়ে দেয়া। চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বের হলো বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে সেই রায়। এটা স্পষ্ট যে, এ মামলাটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা এবং রায়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে টেইলর মেইড।
সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো, যে নিয়মেই হোক না কেন, ইংরেজিতে : বাই হুক অর বাই ক্রুক, অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন, আগামী নির্বাচনে জিততে হবে। ইংরেজি পরিভাষায় : বাই ফেয়ার মিনস অর আনফেয়ার মিনস, দ্যাট ইজ, টু সে বাই এনি মিনস। অর্থাৎ সৎ বা অসৎ নিয়মে, যেভাবেই হোক, আগামী নির্বাচনে জয়ী হতেই হবে। এ কথাটাকে খেয়ালে রেখেই বর্তমান রাজনৈতিক সরকার তাদের কর্মপন্থাগুলো স্থির করছে। তাদের উদ্দেশ্য পূরণের পথে অনেক প্রকার বাধা আছে; যথা এক. অপহরণ গুম ও খুনের অভিযোগ। দুই. অব্যাহত ও বিবিধমুখী ‘ঐতিহাসিক’ দুর্নীতিগুলো। তিন. বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড যথা ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এর বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, একতরফাভাবে ভারতকে সুবিধা দেয়া। তাদের সামনে বাধাগুলোর মধ্যে ভিন্ন ধরনের বাধা হলোÑ বিএনপির জনপ্রিয়তা তথা বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা। আপাতত আমরা কলামের এই অংশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং বেগম জিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : যুগে যুগে দেশে দেশে
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য অস্বচ্ছ অবৈধ পন্থা অবলম্বনের উদাহরণ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আছে। ১৯১৭ সালে লেনিন রাশিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলে, ট্রটস্কি তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেন। একপর্যায়ে লেনিন ট্রটস্কিকে সশরীরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেন। পরবর্তী শাসক স্টালিনও অনুরূপ কাজ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত ও মালয়েশিয়ার ২২ বছরের প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তার প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইবরাহিমকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিতাড়নের জন্য তার বিরুদ্ধে সমকামিতার মতো অবিশ্বাস্য অভিযোগ এনে ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে তাকে দণ্ডিত করেন। আমেরিকার এককালীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে হয়রানি করার জন্য এর হেডকোয়ার্টারে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়েছিলেন (ইতিহাসে এটা ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত)। নিকট অতীতে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল আইডি থেকে সরকারি বার্তা আদান-প্রদান করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তার দেশের, সরকারি অর্থ তহবিল, সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি গোয়েন্দাবাহিনী ও বিচার বিভাগের অনুগত ব্যক্তিদের ব্যবহার করেছেন নিজের ক্ষমতার স্বার্থে। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, ইরানের শাহানশাহ রেজা পাহলভী, রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চসেস্কু ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এ ক্ষেত্রে কয়েকটি মাত্র উদাহরণ।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উত্তরসূরি
রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান তথা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও এর নেত্রী চক্ষুশূল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চক্ষুশূল। আগামী দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। তবে প্রতিযোগিতা স্বচ্ছ হওয়া বাঞ্ছনীয়; কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা ওইরূপ স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তাই তারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে দৃশ্যপট থেকে অপসারণ করতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য বেছে নেয়া বেশ কিছু পন্থার মধ্যে অন্যতম পন্থা বা অস্ত্র হলো রাজনৈতিক মামলা। ২০০৭ ও ২০০৮ এই দু’টি বছরকে বাংলাদেশে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময় বলা হয়। ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রকাশ্য প্রধান ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ এবং অপ্রকাশ্য প্রধান ছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। তাই বলা হয়, এটা উদ্দীনদের সরকার। ওই সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকার বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের লক্ষ্যে ওই সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা দিয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেন সরকার দু’নেত্রীকে বিভিন্ন প্রকারের হয়রানি করে। হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী মাননীয় শেখ হাসিনা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে আশ্বাস দেয়া যে, আমি তোমাদের পক্ষে আছি এবং তোমাদের সব কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দেবো; তথা তোমাদেরকে অভিযুক্ত করব না।’ ওয়ান-ইলেভেন সরকার যখন দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কাবু করতে পারল না, তখন সেই সরকার দু’জনের যেকোনো একজনের সাথে আপস করার সিদ্ধান্ত নিলো। বেগম জিয়া ছিলেন আগ থেকেই আপসহীন নেত্রী; তিনি আপস করতে রাজি হলেন না। শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের সাথে আপস করেছিলেন, ফলে আপসের কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা ছিল; তিনি ‘উদ্দীন’দের সাথে আপস করলেন। অতিসম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ভারতের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০০৮ সালে এই কাজে মধ্যস্থতা করেছিলেন। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন হলো। ‘উদ্দীন’দের সরকার এবং আওয়ামী নেত্রীর মধ্যকার আপসের শর্ত মোতাবেক, ওই সরকারের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কোথাও উপস্থাপিত হলো না। সে আপসের শর্ত মোতাবেক, তিনি ওই সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দিলেনÑ কোনো ক্ষেত্রে নীরবে, কোনো ক্ষেত্রে সরবে। অনুমোদন দেয়া কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ওয়ান-ইলেভেন সরকার কর্তৃক বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চালু রাখা। ওই রকমই অব্যাহত রাখা একটা মামলার রায় প্রকাশ করা হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। সম্মানিত পাঠককে আমার পক্ষ থেকে জানিয়ে রাখতেই হবে, ওয়ান-ইলেভেন সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা দিয়েছিল; সেই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে আইনকানুনের ফাঁক ব্যবহার করে ‘আইনি’ পন্থাতেই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কোনো আদালতে সে মামলাগুলোর বিচার হয়নি। এই যে পুরো প্রক্রিয়া, এটাকে কি বলা যায়- দুই নেত্রীর মধ্যকার ভালোবাসার নমুনা, নাকি এটা প্রতিহিংসার নমুনা? প্রতিহিংসা বেশির ভাগ সময়েই খারাপ পরিণতি বয়ে আনে। প্রতিহিংসার মাধ্যমে, আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আরো পাঁচ বা সাত বা দশ বছর বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতে চায়। থাকতে চাওয়া অপরাধ নয়, বিতর্কিত ও অবৈধপন্থায় থাকতে চাওয়া হলো অন্যায়। ক্ষমতায় পুনরায় আরোহণ কি দশ মাস দূরে নাকি অনেক দূরে, আমি জানি না। বর্তমান যুগের কোনো নিজাম উদ্দিন আউলিয়া থাকলে হয়তো বলতে পারেন, যদি মহান আল্লাহ চান যে, তিনি বলুন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com
No comments